রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাতে জড়াতে পারেন স্থানীয়রা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাসনের নিশ্চয়তা দিতে গিয়ে স্থানীয় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের স্বার্থের সংঘাত হচ্ছে।

শরণার্থী গবেষক ও মানবাধিকারকর্মীরা  বলছেন, স্থানীয় জনগণ যদি তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব হচ্ছে বলে মনে করেন, তাহলে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের স্বার্থের সংঘাতে লিপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি দ্রুতই স্থানীয় জনগণের সম্পদ ও অধিকার রক্ষায় কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অতিরিক্ত জনগোষ্ঠী ও অপ্রতুল স্যানিটেশন, আবাসন বানাতে গিয়ে মাইলের পর মাইল পাহাড় কাটা, জ্বালানির জন্য বন উজাড়, আসবাবের জন্য বড় বড় গাছগুলো কাটার কারণে কক্সবাজারের উখিয়া এলাকায় ঘটে গেছে পরিবেশ বিপর্যয়।

অন্যদিকে বিপুল সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের আগমনে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। তাদের চাষের জমি দখল হয়ে গেছে। বিনিয়োগ করা বাগান নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। স্কুলগুলোতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ায় সন্তানদের পড়ালেখা ব্যাহত হচ্ছে। এসব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয়দের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, কেবল সরকারের জমিতে বসবাস শুরু করেছে তা নয়, তাদের জমিতেও থাকা শুরু করেছে অনেক রোহিঙ্গা। আর জ্বালানির জন্য উজাড় করছে গাছ।

রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কাজ করছেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দোষারোপ না করে এ ধরনের ঘটনাগুলো যেন না ঘটে, সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। স্থানীয়দের স্বাভাবিক জীবন-যাপন যেন ব্যাহত না হয়, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর গবেষণা বলছে, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও স্থান গ্রহণ স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস, যোগাযোগ ব্যয় বৃদ্ধি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ নানাবিধ সেবার স্থবিরতা, মান ও অভিগম্যতার অবনতি এরমধ্যে অন্যতম। তাছাড়া, উখিয়া ও টেকনাফে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থানীয় বাংলাদেশিদের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশি (স্থানীয় বাংলাদেশি জনসংখ্যা চার লাখ ৭৫ হাজার, আর রোহিঙ্গা জনসংখ্যা প্রায় ১০ লাখ)। দীর্ঘ মেয়োদে এই পরিস্থিতি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে।’

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদেরকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আমরা মানবিক জায়গা থেকে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু তাদের চিরদিন রাখতে পারা যৌক্তিক নয়। আমাদের সেই সামর্থ্যও নাই। টিআইবি’র পর্যবেক্ষণে ওপরের কারণগুলো বেরিয়ে এসেছে এবং সেগুলো নিয়ে স্থানীয়রা ইতোমধ্যে ভুগতে শুরু করেছে। এর ফল আগামীতে ভালো হবে না। যখন তাদের প্রাপ্যগুলোতে ভাগ বসবে, তখন তারা কেউই সেটা মেনে নেবে না এবং সংঘাত তৈরি হবে। ফলে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে। এটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব না।’

এদিকে উখিয়ার কুতুপালং লম্বাশিয়া এলাকার স্থানীয় ভুক্তভোগী বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, ‘কিভাবে রোহিঙ্গারা সবুজ গাছগাছালি কেটে ফেলেছে। তাদের ভাষ্য, ‘পাহাড়ের মাটি কাটার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রজাতির গাছের মূল ও শেকড় উৎপাটন করছেন রোহিঙ্গারা। এসব শরণার্থী একের পর এক পাহাড় কাটলেও স্থানীয় বনবিভাগ থেকে কোনও নড়াচড়া নেই। এদিকে উখিয়ার কুতুপালং টেলিভিশন রিলে কেন্দ্রের পাশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়প্রার্থী এক তরুণকে ছেলেধরা সন্দেহে  মারধর করলে তার মৃত্যু হয়।

লাখ লাখ রোহিঙ্গা চলে আসার দু’মাসের মধ্যেই এধরনের অস্থিরতা হওয়ারই কথা উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সি আর আবরার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা এসেছেন তারা ট্রমা ভিক্টিম। ওপারে  চরম অবস্থা দেখে জীবন আর অনিশ্চয়তা নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। ফলে তারা মানসিকভাবে স্বাভাবিক নেই। খাবার সুপেয় পানি যতই দেওয়া হোক অপর্যাপ্ততা আছে। এধরনের পরিস্থিতিতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে।’

জ্বালানি সংকটের কারণে বন উজাড় হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘চাল দেবেন, জ্বালানি দেবেন না, তখন তারা কী করবে। ওই এলাকায় স্থানীয়দের সম্পদ  আছে। রোহিঙ্গারা এটা মানবে না- এটাই স্বাভাবিক। এখন দু’মাস হয়ে গেছে। এসব চিহ্নিত করার সময় এসেছে।’

সি আর আবরার আরও বলেন, ‘তারা সমস্যা সৃষ্টি করছে, এটা না ভেবে সমস্যার  কারণগুলো চিহ্নিত করতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বারবার মানবিক দিক বিবেচনা করে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু আমাদের পক্ষে এটা এফোর্ট করা খুবই কঠিন। কক্সবাজারে এমনিতেই ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই অবস্থা। সেখানে রোহিঙ্গাদের এত বেশি সংখ্যক উপস্থিতি সামাজিকভাবেও একটা বিপর্যয় ঘটাতে পারে। উখিয়ায় এখন স্থানীয়দের এলাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে নিজেদেরকে ‘রোহিঙ্গা নয়’ সে পরিচয় প্রমাণ দেখাতে হয়। এটি তাদের জন্য পীড়নের কারণ হয়েছে।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী গওহার নঈম ওয়ারা মনে করেন, এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে ক্যাম্পে আটকে রাখা সম্ভব না এবং এতে করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখনও হাজার হাজার লোক ওই দেশ থেকে আসছে। আমরা হঠাৎ করে দেখবো যারা এসেছিল, তারা সব চলে গেছে, সেটা অবাস্তব চিন্তা। সে কারণে এখন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা জরুরি। তাদের কমিউনিটির মধ্যে নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্থানীয়দের কাছে যদি একটি করে রোহিঙ্গা পরিবারকে দেওয়া হয় এবং তাদের যাবতীয় বিষয় তারা দেখবে। সরকার এখনকার মতো তাদের সহায়তা দেবে। সেক্ষেত্রে সংঘাতের এবং শঙ্কার জায়গাগুলো কমবে।

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন