রোহিঙ্গা নিধনে ফেসবুকের অপব্যবহার এবং পার্বত্যাঞ্চলে বাঙ্গালী বিদ্বেষী অপপ্রচার

মাহের ইসলাম:

সম্প্রতি ফেসবুকের উদ্যোক্তা ও প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ স্বীকার করেছেন যে, মায়ানমারের চলমান রোহিঙ্গা নিধনে ফেসবুকের ভূমিকা রয়েছে। এই স্বীকারোক্তি এসেছে তখনই, যখন রাখাইনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার প্রেক্ষাপট তৈরিতে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী কাজে ফেসবুকই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংস্থা অভিযোগ করছে।

উল্লেখ্য, গত ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮ তারিখে লন্ডনে ১৫৯টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রকাশিত ‘দ্য স্টেস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’স হিউম্যান রাইটস’- শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে যে, বিশ্বনেতাদের ছড়িয়ে দেয়া ঘৃণা ও রাজনৈতিক মতাদর্শ সিরিয়া ও মিয়ানমারে সংখ্যালঘু নির্যাতন উস্কে দিয়েছে। মিয়ানমারের পাশাপাশি ইরাক, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেনেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যর্থ হয়েছে। (দি গার্ডিয়ান, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮)

মায়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘের “ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশন” এর চেয়ারম্যান মারজুকি দারুসমান একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাবের জন্য বহুলাংশে অবদান রাখছে।” তিনি আরও যোগ করেন, “মায়ানমারে সামাজিক মাধ্যম মানেই ফেসবুক, এবং বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য সেখানে বর্তমান”।

অন্যদিকে, মিয়ানমার মানবাধিকার পরিস্থিতির একজন দূত বলেন, “আমরা জানি জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধদের নিজস্ব ফেসবুক একাউন্ট রয়েছে এবং তারা রোহিঙ্গা বা অন্যান্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অনেক সহিংসতা এবং ঘৃণা ছড়াচ্ছে”।(আল জাজিরা, ১৪ মার্চ, ২০১৮)

ইতোমধ্যেই এটা সবারই জানা হয়ে গেছে যে, খবরের নামে গুজব ছড়ানোর মধ্য দিয়ে মায়ানমারে মুসলিম ও রোহিঙ্গাবিদ্বেষী মনোভাবে উসকানি ও প্রণোদনা জোগানোর কাজে ফেসবুককে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই, মিয়ানমার সেনা ও উগ্রবৌদ্ধদের বর্বরতার খবর মুছে দিয়ে এবং রোহিঙ্গাদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের সত্য খবরও আড়াল করেছে ফেসবুক। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাবিদ্বেষী প্রচারণায় প্রচণ্ড বর্ণবাদী রাজনৈতিক কার্টুন, মিথ্যা ছবি এবং বানোয়াট সংবাদ সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। পরবর্তীতে, এগুলো প্রায়ই ভাইরাল করে ছড়িয়ে দেয়া হয় সাধারন মানুষের মাঝে।

ফলে, মায়ানমারের বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হয়েছে রোহিঙ্গা বিদ্বেষ এবং অনেকেই আরাকান রাজ্যের এই সংখ্যালঘু মুসলিম মানুষদের দেখতে শুরু করেছে ঘৃণার চোখে। অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হিসেবে, মায়ানমারের অনলাইন জগতে রোহিঙ্গাবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ, উসকানি, সহিংসতা এবং ঘৃণা প্রচারণা অনেকটা উৎসবে পরিণত হয়।

চূড়ান্ত পরিণতিতে, অত্যন্ত সুপরিকল্পিত জাতিগত নিধনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে, ১২ এপ্রিল ২০১৮ পর্যন্ত শুধুমাত্র বাংলাদেশেই আশ্রয়প্রার্থী নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১,০২,৬৩২ জন; জাতিগত নিধন, হত্যা, ধর্ষণ, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা শিকার হওয়া দুর্ভাগাদের প্রকৃত সংখ্যা হয়ত কোনদিনও জানা যাবে না।

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলেও প্রায় অনুরূপ ক্ষেত্র সৃস্টির অপচেষ্টার আশংকা দেখা দিয়েছে, কিছু কিছু পাহাড়ির ফেসবুক পোস্ট দেখে। যেখানে, প্রতিনিয়তই বাঙ্গালী বিদ্বেষী অপপ্রচার চালিয়ে ঘৃণা, অবিশ্বাস আর সন্দেহের বীজ বপনের কাজে ফেসবুক ক্রমেই প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে, বেছে বেছে শুধুমাত্র বাঙ্গালীদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে, তাই নয়। বরং, অনেক ক্ষেত্রেই সাম্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাশাপাশি এসব পোস্টে স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন এমনকি সরকার এবং রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী উপাদানও থাকে।

পাহাড়ে সংঘটিত হলেতো কথাই নেই, এমনকি সমতলে সংঘটিত ঘটনাকে পুঁজি করেও এমন অপপ্রচেষ্টা অহরহ দেখা যায়। এক্ষেত্রে, বেশীরভাগ সময়ই যে কোন বাস্তব ঘটনাকে ব্যবহার করা হয়; তবে প্রকৃত ঘটনা গোপন করে, কিছুটা মিথ্যে মিশ্রণ করে বা আংশিক সত্য প্রকাশ করে এবং ছবি এডিট করে প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও অতীতে ঘটে যাওয়া ভিন্ন কোন ঘটনার ছবি ব্যবহার করে, সাম্প্রতিক বা আলোচ্য ঘটনার ছবি হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায়। এ ধরণের প্রচেষ্টার নিয়মিত শিকার হলো পাহাড়ে বসবাসরত বাঙ্গালীরা। ইচ্ছে করেই পজিটিভ সংবাদগুলো আড়াল করে শুধুমাত্র নেগেটিভ সংবাদগুলোই সামনে এনে এবং অবশ্যই কিছুটা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করা হয়; বাঙ্গালীর প্রতি ঘৃণা আর পাহাড়ীর প্রতি সহানুভূতি অর্জনের উদ্দেশ্যে।

উপরের ছবিটি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে কিশোরী বিউটি আক্তারের, যাকে হত্যা করা হয় গত মার্চের ১৬ তারিখে। ঘটনার পরপরই, বাঙ্গালী বিদ্বেষী পোস্ট চলে আসে ফেসবুকে। ২০১২ সালের সবিতা চাকমার ঘটনা উল্লেখ করে এক উস্কানিমূলক পোস্ট আপলোড করা হয়, যেখানে ব্যবহার করা হয় ২০১৮ সালের বিউটি আক্তারের মৃতদেহের ছবি। প্রকৃতপক্ষে, ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী সবিতা চাকমার লাশ নিজ বাড়ির পাশে পাওয়ার পর বিভিন্ন পাহাড়ী সংগঠনগুলো থেকে সবিতা চাকমা বাঙালী ট্রাক ড্রাইভার ও হেলপার কর্তৃক গণধর্ষিতা হয়ে মারা গেছে বালে দাবী করে ব্যাপক প্রচারণা, প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়। এমনকি শাহবাগেও সবিতা চাকমা ‘ধর্ষণ’ ও খুনের ঘটনায় মানবন্ধন হয়েছে। কিন্তু পরে ময়না তদন্তে প্রমাণ হয় যে, তাকে ধর্ষণ করা হয়নি।

‘পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ : বিচার কামনার চেয়েও বাঙালিকে ধর্ষক প্রমাণ করাটা যখন অধিক গুরুত্বপূর্ণ’ শিরোনামের নাজমুল আহসান এর ব্লগ থেকে জানতে পারি যে, “বাংলাদেশে মিডিয়া ক্যু’র সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে পার্বত্য বাঙালিরা।” তিনি আরো জানিয়েছেন, “অনেক অপরাধের বোঝা বইতে হয়েছে পার্বত্য বাঙালিদের, যেটার জন্য আদৌ তারা কোনোকালেই দায়ী ছিল না।” পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণ ও তার প্রতিবাদের শুধুমাত্র ২০১৪ সালের ৫টি ঘটনাকে কেস স্টাডি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন যে, “কেউ কেউ আসলে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিচার চায় না, কিন্তু বাঙালিই ধর্ষক সেটাই প্রমাণ করতে চায়। বিচার এখানে মূখ্য নয়, ধর্ষণকে কেন্দ্র করে আমি কতোটুকু রাজনীতি করতে পারলাম, সেটাই মূখ্য বিষয়।” (https://www.istishon.com/?q=node/19537)

দেবী ত্রিপুরা, বিশাখা চাকমা, উ প্রু মারমা, আয়না চাকমা, দিপা ত্রিপুরা, ফাতেমা বেগম, এবং সবিতা চাকমা এর মতো অনেক ঘটনা আছে যেখানে ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে বাঙ্গালী বিদ্বেষী প্রচারণা ও ঘৃণা সৃষ্টিতে।

অনেক পাহাড়ী মেয়ের জন্যে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক। বাঙ্গালী ছেলের সাথে মেলামেশা করলে বা এক সাথে ছবি তুললেই পাহাড়ী মেয়েরা পাহাড়ী আঞ্চলিক সংগঠনের সাথে জড়িত যুবকদের দ্বারা হেনস্তার শিকার হচ্ছে ফেসবুকের মাধ্যমে এবং সরাসরি।

অনেক ক্ষেত্রেই, মেয়ের বিস্তারিত পরিচয় উল্লেখ করে এসব ছবি ফেসবুকে চলে আসছে; বিভিন্ন ধরনের হুমকি, এমন কি নিলামে তোলা বা প্রাণনাশের হুমকিসহ। পাহাড়ী মেয়েদের ছবি, নাম, পিতার নামে এমনকি ঠিকানা পর্যন্ত ফেসবুকে পোস্ট করে, তাদেরকে সর্বত্র হেয় করার পাশাপাশি তাদের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হচ্ছে। বাঙ্গালী বিদ্বেষী মনোভাব এমনই প্রকট যে, এখানে ‘পতিতাবৃত্তি’ কেও গ্রহণযোগ্য বলা হচ্ছে, কিন্তু বাংগালী ছেলের সাথে পাহাড়ি মেয়ের ‘প্রেম, ভালোবাসা এবং বিয়ে’ গ্রহণযোগ্য নয়।

পার্বত্য অঞ্চলে বাঙ্গালিদের প্রতি ঘৃণার প্রকটতা এমনই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মৃতকে পর্যন্ত রেহাই দেয়া হয়নি। রাঙ্গামাটিতে পাহাড় ধ্বসের অব্যবহিত পরেই সেনাসদস্যরা জীবন বাজি রেখে উদ্ধার কাজে ঝাঁপিয়ে পরে। অথচ, এই উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনাসদস্যদের মৃত্যতে ও কিছু পাহাড়িকে উল্লাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তারচেয়েও বেদনাদায়ক হলো এই যে, তারা তাদের এই ঘৃণা ও উল্লাস প্রকাশে কোন রাখ ঢাকের ধার ধারেনি, বরং প্রকাশ্যেই জানান দিয়েছে ফেসবুকের মাধ্যমে। 

২০১৭ সালের জুন মাসে রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত হয় স্মরণ কালের অন্যতম ভয়াবহ পাহাড় ধস। তাৎক্ষণিক উদ্ধারকাজে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেনসহ ৫ জন সেনাসদস্য শাহাদাত বরণ করার পরেও ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়। তাদের মৃত্যুর ঘটনা পর্যন্ত মিথ্যামিশ্রিতভাবে উপস্থাপন করতে দেখা যায়।মৃত সেনাসদস্যদের ‘অত্যাচারি এবং নরপিশাচ’ বলে উপস্থাপন করা হয়। অথচ, উক্ত পাহাড় ধসের ঘটনা পরবর্তী দুর্যোগ মোকাবেলায় রাঙ্গামাটিতে সেনা সদস্যরা জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ৮ টি আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন, যেখানে দুই মাসের বেশি সময় ধরে সর্বমোট ৯৩,৩৮১ জনের খাবারের ব্যবস্থা করে এবং ২২৫৭ জনকে বিনামুল্যে চিকিৎসা সেবা প্রেদান করে। আর, বাঙ্গালিদের প্রতি ঘৃণা এমনই তীব্র যে, শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত সহানুভূতি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে !

২ জুন ২০১৭, সকালে রাঙ্গামাটির লংগদুতে পাহাড়িদের প্রায় শতাধিক বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অনুমান করা হচ্ছে, পাহড়ি দুই যুবকের হাতে নিহত বাঙ্গালী মটর সাইকেল চালক নয়নের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ মিছিল হতে কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল তরুণ এই অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী। ফলে, কয়েকশত নিরীহ পাহাড়ি পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে রাতারাতি সহায় সম্বলহীন হয়ে মানবেতর দিনযাপনে বাধ্য হয়েছে। পরবর্তীতে, স্থানীয় রাজনীতির জটিলতায়, নারী ও শিশুসহ এই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর অনেকেই সরকারী ত্রাণ এমনকি চিকিৎসা সহায়তা পর্যন্ত নিতে বাধার সম্মুখীন হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।

ফেসবুকের কল্যাণে ঘটনাটি অতি দ্রুত লংগদুর বাইরে ছড়িয়ে দেয়া হয়, দেশে এবং বিদেশে; তবে একটু ভিন্ন ভাবে। জ্ঞাতসারেই হোক আর অজ্ঞাতসারেই হোক, এই ভয়াবহ সংবাদটি কয়েকটি দেশি এবং বিদেশী পত্রিকাতেও খানিকটা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।

যে তিনটি ছবিকে লংগদুর অগিকান্ডের ছবি বলে চালানো হলো, দেশবাসি এবং বিশ্ববাসীর সমবেদনা প্রাপ্তি এবং বাঙ্গালীদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির লক্ষ্যে, সেগুলো আসলে এদেশেই ঘটে যাওয়া টঙ্গীতে বয়লার বিস্ফোরণ (১০/৯/১৬), গাইবান্ধায় সাঁওতাল পল্লি (৭/২/১৭) এবং বরিশালে বিস্কুটের গোডাউন (৪/২/১৭) এর আগুনের ছবি। অনলাইনে গিয়ে ‘লংগদুতে আদিবাসীদের উপর হামলা: কিছু ভুল ছবি’ (https://www.jaachai.com/posts/post-807) শিরোনামের এক পেজ থেকে জানা যায় যে, লংগদুতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা সত্য হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় যে সকল ছবি এসেছে তার সব ছবিই এই ঘটনা সংশ্লিষ্ট নয়।ভিন্ন ঘটনার ছবি ব্যবহার করে বাঙ্গালীদের দোষারোপ করা হয়েছে অত্যন্ত সুচারুভাবে।

একদিকে বাঙ্গালিদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি আর অন্যদিকে পাহাড়িদের প্রতি সমবেদনা আদায় করার এই পন্থা শুধুই পুরাতনই নয় বরং কিছু পাহাড়ির কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।

অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাংলাদেশ সংক্রান্ত যে কোন সংবাদের মধ্যে দেশ বিরোধী বা দেশের জন্যে অবমাননাকর উপাদান যোগ করে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। যে কোন কিছুর সাথে কিছুটা মিথ্যে যোগ করে বা কোন নেতিবাচক সংবাদ এর সাথে বাঙ্গালী বিদ্বেষী মতামত যোগ করে পোস্ট আপলোড করা নৈমিত্তিক ব্যাপার।

একটু খেয়াল করলেই এ ধরনের হাজার হাজার পোস্ট চোখে পড়বে যার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত পাহাড়ের সরল মনের মানুষদের বাঙ্গালী বিদ্বেষী মনোভাব গড়ে তোলার চেস্টা চলছে। সরকার যখন পাহাড়ে পাহাড়ি- বাঙ্গালীর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং শান্তি আর উন্নতির চেস্টায় আন্তরিকভাবে নিবেদিত, তখন এ ধরনের ফেসবুক পোস্ট সরকারের সমস্ত প্রচেস্টার বিরুদ্ধে অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের চোখের আড়ালে ঘটছে বলে, অনেকেই এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে হয়ত কিছুটা সময় নিতে পারে।

কিন্তু, চরম বাস্তবতা হলো, ফেসবুকের এই ঘৃণা ছড়ানো এবং বাঙ্গালী বিদ্বেষী প্রচারণা পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের পাশাপাশি অশান্তি এবং অসাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প পাহাড়ের বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। নিরীহ এবং সরল মানুষগুলো প্রকৃত সত্যের পরিবর্তে মিথ্যের জালে ক্রমাগত আষ্টপৃষ্টে বাঁধা পড়ছে; না বুঝেই পরস্পরের শত্রু হয়ে মুখোমুখি হয়ে পড়ছে একই সমাজের মানুষগুলো। ষড়যন্ত্রকারীদের কুটচালে ব্যহত হচ্ছে উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধি; অকার্যকর হয়ে পড়ছে রাষ্ট্রীয় আন্তরিকতা, দেশবাসীর উদারতা আর জাতির ধর্মীয় সহিষ্ণুতা। দেশের বাইরে ভুলন্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সম্মান ও মর্যাদা।

রামনবমী পালনকে কেন্দ্র করে, মার্চের শেষ সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গ আর বিহার রাজ্যে মোট দশটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটেছিল। বিবিসির হিন্দি বিভাগ তাদের সংবাদ দাতাদের প্রেরিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই মতামত ব্যক্ত করছে যে, “এ অশান্তি, হিংসা বা অগ্নিসংযোগ কোনও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই, অনিয়ন্ত্রিতভাবে, হঠাৎ ঘটে গেছে – ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করে এরকমটা মনে করা কঠিন।”

এ নিয়ে ১২ এপ্রিল ২০১৮ তারিখে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত, ‘ভারতে মুসলিম-বিরোধী দাঙ্গা ‘পরিকল্পিত’ মনে করার ৯টি কারণ’ সংবাদে বিস্তারিত আলোচনা করার সময়, ‘সামাজিক মাধ্যমে গুজব’ ছড়ানোকে একটি কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই, মায়ানমারের রোহিঙ্গা নিধনে ফেসবুকের অপব্যবহার আর ভারতে মুসলিম বিরোধি দাঙ্গায় সামাজিক মাধ্যমের গুজব ছড়ানোকে মাথায় রেখে পার্বত্য চট্ট্রগ্রামে ফেসবুকে ধর্মীয় উস্কানিমূলক ও বাঙ্গালী বিরোধী প্রচারণা ও ঘৃণা ছড়ানো বন্ধের পদক্ষেপ এক্ষুণি নিতে হবে। এ নিয়ে কালক্ষেপণের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। বরং এ বিষয়ে লাগাম টানতে যত দেরি হবে, তত বেশি জ্যামিতিক হারে এর ক্ষতির শিকার হতে পারে আমাদের সকলকে।

• লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক ও লেখক।

[email protected]


মাহের ইসলামের আরো লেখা পড়ুন

  1. পার্বত্য চট্টগ্রামে অপপ্রচার: মুদ্রার অন্য দিক
  2. মারমা দুই বোন, অপপ্রচার এবং ডিজিটাল যুগের দুর্বলতা
  3. পাহাড়িদের সরলতা কি গুটিকয়েকজনের ক্রীড়নক: প্রেক্ষিত বিলাইছড়ি ইস্যু
  4. পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীঃ নির্দোষ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত দোষী
  5. মিথুন চাকমার প্রতি সহানুভুতি কি অবিচার ?
  6. দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় চেতনা ও নাগরিক নিরাপত্তা নিয়ে অপপ্রচার বন্ধে কোনো ছাড় নয়
  7. ইমতিয়াজ মাহমুদ- মিথ্যা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখান(ভিডিও)
  8. অপহরণের প্রতিবাদ: মানবিক, বাণিজ্যিক, না রাজনৈতিক?

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপপ্রচার, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফেসবুক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন