লংগদু ইস্যুকে পুঁজি করছে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা

কাজী সোহাগ, লংগদু, রাঙ্গামাটি থেকে ফিরে | 
রাঙ্গামাটির লংগদুতে বাঙালিকে হত্যা ও পরে উপজাতিদের বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনাকে পুঁজি করছে অস্ত্রধারী পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা। রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির সীমান্তঘেঁষা মানিক্যাছড়ার কালাপাহাড়ে আশ্রয় নেয়া অন্তত ২০টি পরিবারের শতাধিক উপজাতি জিম্মি করে রেখেছে সন্ত্রাসীরা। সরকারের দেয়া সহযোগিতা নিতে দেয়া হচ্ছে না তাদের। একইসঙ্গে ফিরতে দেয়া হচ্ছে না পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়িতে।

ওদিকে সরকারি সাহায্য নিয়ে প্রশাসন বসে থাকলেও গত কয়েক দিনে তা অনেকেই গ্রহণ করেনি। ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতিরা জানিয়েছেন, আমরা তো নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা দরকার। কিন্তু বিশেষ বার্তা দিয়ে বলা হচ্ছে, আপাতত কোনো ধরনের সাহায্য নেয়া যাবে না।

কারা এ বার্তা দিচ্ছেন প্রশ্নে তারা জানান, আমরা তাদের চিনি না। তাদের কথামতো চলতে হচ্ছে। শনিবার সরজমিনে লংগদুর বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ঘুরে এ তথ্য জানা যায়। আগুন দেয়ার ঘটনার পরদিনই উপজাতিদের ৬২টি পরিবার জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ত্রাণ নেয়ার জন্য যোগাযোগ করে। নিজেরা একটি তালিকা তৈরি করে নিশ্চিত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ত্রাণ নিতে আসেননি। পরে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে উপজাতিরা জানান, তাদেরকে ত্রাণ নিতে আসতে বাধা দেয়া হচ্ছে।

চাঁদাবাজি, অপহরণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে সম্প্রতি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে উপজাতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাই অনেক দিন থেকেই পাহাড়কে উত্তপ্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এরই অংশ হিসেবে যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম নয়নকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা। পরে ওই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বাঙালিরা। তারা নয়নের বীভৎস লাশ দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পাহাড়িদের দায়ী করে তাদের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, এত সংখ্যক ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া নিয়ে। বাঙালিদের দাবি, ক্ষিপ্ত হয়ে অনেক বাঙালি উপজাতিদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে এটা ঠিক। কিন্তু তারা এত সংখ্যক বাড়িতে আগুন দেয়নি। কিছু বাড়িতে উপজাতি সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়েছে।

এদিকে আগুন দেয়ার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কুলিন বিহারী চাকমা শনিবার লংগদু বাজারে প্রতিবেদককে বলেন, বাড়ি পুড়ে যাওয়ার পর বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। এ পর্যন্ত সরকারের কোনো সাহায্য-সহযোগিতা নিতে পারিনি। তিনি বলেন, তিনটিলা বনবিহার কিয়াংয়ে আমাদের প্রতিনিধিরা আছেন। তারা জানিয়েছেন, না বলা পর্যন্ত কেউ যেন সাহায্য না নিই।

করনাছড়ির এক নং আথারকছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার রাঙ্গাউদা চাকমা বলেন, আমাদের ত্রাণ দরকার নেই। নিরাপত্তা দরকার। আর কি কারণে বাড়ি-ঘরে আগুন দেয়া হয়েছে তার উত্তর জানা প্রয়োজন। একইসঙ্গে এ ধরনের বর্বর ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। দুটি বাড়ি পুড়ে যাওয়া ধর্মাদ্বষী চাকমা বলেন, বাড়িতে আগুন দেয়ার আগেই আমরা পালিয়ে যাই। এ কারণে কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তা নাহলে এখানে অনেক প্রাণহানি হতো। বিশেষ করে আগুনে পুড়ে মারা যেত অনেকে।

তিনি বলেন, পুলিশ অস্থায়ী ক্যাম্প করেছে, সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে এজন্য নিরাপদ বোধ করছি। তবে স্থায়ী নিরাপত্তা চাই আমরা। এদিকে সরকারি সহযোগিতা নিতে বাধা দেয়া প্রসঙ্গে রাঙ্গামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শফিউল সারোয়ার লংগদু থানায় বসে মানবজমিনকে জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের সরকারি সহযোগিতা নিতে দেয়া হচ্ছে না বলে আমাদের জানানো হয়েছে। আর বাড়ি-ঘর না থাকার কারণে হয়তো তারা এখনো ফিরছেন না। সরকার বলেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের পুনর্বাসন করা হবে।

তিনি জানান, উদ্দেশ্যমূলকভাবে স্বার্থান্বেষি মহল আগুন দেয়ার ঘটনাটি ঘটিয়েছে। এতে বিশাল ক্ষতি হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। তিনি বলেন, জড়িতদের কাউকে রেহাই দেয়া হবে না। আগুন দেয়ার ঘটনায় এরই মধ্যে ২১জন বাঙালিকে আটক করা হয়েছে। তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে আটক করা হচ্ছে।

আগেই সতর্ক করা হয়েছিলো উপজাতীয়দের
সরজমিনে লংগদুর বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উপজাতি ও বাঙালিদের সঙ্গে আগুন দেয়া নিয়ে কথা বললে পরস্পর বিরোধী তথ্য জানা যায়। কয়েকজন বাঙালি দাবি করেন, এতগুলো বাড়িতে আগুন দেয়া হলো। কিন্তু কোনো উপজাতি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাদের কেবল সম্পদ নষ্ট হয়েছে।

কারণ হিসেবে তারা বলেন, নয়নের লাশ উদ্ধারের পরপরই তাদেরকে কে বা কারা সতর্ক করে দিয়েছিল। পরদিন সকালে নয়নের লাশ লংগদু পৌঁছায়। এর আগেই উপজাতীয়রা তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। প্রশ্ন করে তারা জানান, উপজাতীয়রা একযোগে আগে থেকে কেন অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলো। কারা তাদেরকে সতর্ক করেছিল। আগুন দিতে গেলে বাধা দেযার মতো কোনো উপজাতি উপস্থিত ছিল না।

বাইট্রাপাড়ার কয়েক বাসিন্দা জানান, উত্তেজিত হয়ে অনেক বাঙালি তাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে। এটা ঠিক। কিন্তু এরপরে কারা আগুন লাগিয়েছে। এলাকাবাসী জানান, আগুন দেয়ার ঘটনায় তিনটিলা খিয়ানঘরে বর্তমানে ২০টি পরিবার, মানকিজোড় ছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪০টি পরিবার ও ডানে লংগদু নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (মহাজনপাড়া) ৮০ থেকে একশটি পরিবার আশ্রয় নিয়ে আছে।

এদিকে আগুন দেয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত উপজাতীয়রা জানান, নয়নের লাশ এলাকায় আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিই। পালিয়ে যাই। পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে আমাদের মনে হয়েছিল-আক্রমণ করা হবে। প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তা জানান, বাঙালিরা কিছু বাড়িতে আগুন দিয়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু এলাকায় বাঙালিরা যায়নি। সেখানেও ঘরবাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে। ওইসব বাড়িতে আগুনের ধরনে ভিন্নতা পাওয়া গেছে। আমরা তদন্ত করছি ওইসব ঘরবাড়িতে কারা আগুন দিয়েছে।

লংগদুসহ কয়েকটি স্থানে ২১২টির মতো বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। যদিও এ সংখ্যা নিয়েও রয়েছে মতভেদ। কেউ বলছেন ১৮৪টি আবার কেউ কেউ বলছেন একশর ওপরে হবে না।

সম্প্রতি নষ্ট করার চক্রান্ত
পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কোণঠাসা হয়ে পড়ে উপজাতি সন্ত্রাসীরা। নয়নের আগে মহালছড়ির ছাদিকুল মাটিরাঙ্গার আজিজুল শান্ত, পানছড়ির হোসেন আলী, ভূয়াছড়ির শহীদুল, দীঘিনালার মুহাম্মদ আলীসহ গত ১০ বছরে ১২ জন বাঙালি মোটরসাইকেল চালককে হত্যা, ৫ জন মোটরসাইকেল চালককে গুম এবং অব্যাহত চাঁদাবাজির কারণে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা নিজেদের জনগোষ্ঠীর কাছেও প্রশ্রয় পাচ্ছিল না।

এ অবস্থায় তাদের পরিকল্পনা ছিল, বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নানিয়ারচর, বরকল বা মহালছড়িতে এমন কিছু ঘটানো যাতে পাহাড়ি বাঙালির মধ্যে সম্প্রীতি নষ্ট হয় এবং নিজেদের জনগোষ্ঠীর সমর্থন, সহানুভূতি ফিরে পাওয়া যায়। তাদের এই পরিকল্পনার মধ্যেই ঘটে যায় লংগদুর ঘটনা।

এদিকে সরজমিনে নিহত নয়নের বাড়িতে গেলে নয়নের স্ত্রী ও বড় ছেলে ১৬ বছরের জাহিদের অভিযোগ, স্থানীয় ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী দিপালু চাকমা ও জেএসএস-এর কালেক্টর (চাঁদা আদায়কারী) ইমন চাকমার পরিকল্পনাতেই নিষ্ঠুরভাবে খুন করা হয়েছে নয়নকে। ইমন চাকমা কিছুদিন আগে নয়নের বাসায় এসে আশ্রয় চায়। কিন্তু নয়ন তাতে রাজি হয়নি।

আর দিপালু চাকমার সঙ্গে কিছুদিন আগে ঝগড়া হয় নয়নের। ওরা হুমকি দিলে নয়ন হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলেছিল, পারলে তোরা আমার ইয়ে ছিড়বি। মৃত্যুর আগে নয়নের সেই আঙুলের নখ উপড়ে নেয়া হয়েছিল। আর যেদিন নয়ন নিখোঁজ হয় সেদিন সকালে দুই চাকমা যুবক তার কাছে আসে মোটরসাইকেল ভাড়া নিতে।

সূত্র: মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন