শান্তিচুক্তির ক্ষীর খাচ্ছেন সন্তুু বাবুরা: পার্বত্য বাঙালিদের অস্তিত্ব ঠেকেছে তলানীতে

মনিরুজ্জামান মনির ॥

অনেক আশা আকাঙ্ক্ষার ফসল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বা তথাকথিত শান্তিচুক্তি। কিন্তু বাস্তবে এই শান্তিচুক্তি নামকরণ মোটেও কার্যকরী হয় নাই। বরং এই চুক্তির বলে সন্তুবাবুরা বিগত ২১টি বছর শান্তিচুক্তির ক্ষীর, মাখন একতরফাভাবে খেয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের নিরীহ নির্যাতিত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব আজ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীন ও স্বার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ আজ হুমকির মুখে। কেননা, তিন পার্বত্য জেলার ২৫টি উপজেলায় পাহাড়, জঙ্গল, অরণ্য, বন বনানীতে বাঙালিদের কোন বাক স্বাধীনতা নেই।

দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা অবাধে চাঁদাবাজী, খুন, গুম, মুক্তিপণ আদায়, বন্দুকযুদ্ধ, এলাকায় বিচার-আচারসহ যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী নানারূপ কারণে দুর্গম এলাকায় অপারেশন পরিচালনা করতে পারে না। কারণ তাদের সেই প্রশিক্ষণও নেই এবং মন মানুষিকতা আছে কি না সেই প্রশ্ন দুর্গম এলাকাবাসী উপজাতি ও বাঙালি ভূক্তভোগী জনগণ পদে পদে অনুধাবন করছেন। নিজের ভাগ্যকে শান্তনা দিচ্ছেন এই বলে: কেন আজ এই পাহাড়ে এসে সন্তান সন্ততি নিয়ে বসতি গড়লাম?। কি অপরাধ করেছি আমরা এই পাহাড়ে এসে। কেন আজ আমাদের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, সুখ ও সমৃদ্ধি হুমকির মুখে? দেশের হতদরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষের কাছে সরকার এই প্রশ্নের কি জবাব দিবেন?

পরিচয় সংকটে পাহাড়ের উপজাতি জনগোষ্ঠি
পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিকে সরকারিভাবে উপজাতি কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি হিসেবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। কিন্তু এই পরিচিতি উপজাতীয় নেতাদের বড় একটি অংশ মেনে না নিয়ে নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে জাহির করে চলেছেন। নিরীহ সরলপ্রাণ উপজাতিরা চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, পাংখু, তংচঙ্গা, লুসাই ইত্যাদি পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। কিন্তু সন্তু বাবুরা তাদের শত বছরের ঐতিহ্য কেড়ে নিয়ে নিজেদের পরিচিতি দিচ্ছেন জুম্ম জাতি বলে।

বিগত তিন যুগে তারা গেরিলা যুদ্ধের নামে ত্রিশ হাজার বাঙালি হত্যা করেছেন, পাহাড়ে লিফলেট বিতরণ করে বলেছেন- ঘরে ঘরে দুর্গ গড়, জুম্মল্যান্ড কায়েম কর। তারা খুনী শান্তি বাহিনীর নাম দিয়েছিলেন জুম্ম লিবারেশন আর্মি। তথাকথিত জুম্ম জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন এম.এন লারমাকে। অথচ তাদেরই বিদ্রোহী গোষ্ঠির হাতে ভারতের আগরতলায় জীবন হারাতে হয়েছে লারমাকে।

এছাড়া অনেক উপজাতি নেতা আদিবাসী কিংবা জুম্ম জাতি এর কোনটিই সমর্থন করছেন না। তারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ কিংবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে বাংলাদেশের একজন সম্মানীত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু এসব উপজাতি নেতাদেরকেও সন্তু বাবুদের আদর্শের প্রতি আনুগত্য না থাকায় নির্বিচারে গোপনীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে।

উরিমহন ত্রিপুরা, চাবাই মগ, সুবিনয় চাকমা, শান্তিময় দেওয়ান, চুনিলাল চাকমা, মেজর পিউর, অঞ্জনা চাকমা, এলথাংগা পাঙ্খু, বংকিম দেওয়ানসহ শত শত উপজাতীয় নেতাকে সন্তুলারমা বাহিনী হত্যা করেছে। অথচ তাদের কি অপরাধ ছিল? পাহাড়ের নতুন প্রজন্মের উপজাতীয় যুব সমাজের কাছে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। এজন্যই অহরহ জেএসএস বনাম ইউপিডিএফ চলে বন্দুক যুদ্ধ।

নেতৃত্বের সংকট চলছে উপজাতিদের মধ্যে
উপজাতীয় সমাজে হেডম্যান, কারবারি, সার্কেল চীফ ইত্যাদি দীর্ঘকাল থেকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এ ধরণের নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারছেন না। তাছাড়া সন্তু বাবু ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের কাছে বন্দি হয়ে পরে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রতি সমর্থনের মুচলেকা দিয়ে মুক্তি আদায় করেছিলেন। কিন্তু তিনি পরে আর সেই ওয়াদা রক্ষা করেন নাই। সন্তু বাবুকেও পাহাড়ের উপজাতি জনগোষ্ঠী নেতা হিসেবে মেনে নেয় নাই।

বর্তমানে সন্তু বাবুর নেতৃত্বে জনসংহতি সমিতি ছাড়াও বিদ্রোহী ইউপিডিএফ, জনসংহতি সমিতি (এম.এন লারমা), ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ, হিল ওমেন ফেডারেশন, বোরকা পার্টি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধ চাঁদাবাজি, খুন, গুম আধিপত্য বিস্তারসহ নানাভাবে জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে চটকদার দাবীদাওয়া তুলে বিগত ২ দশক যাবত প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় সন্তুবাবু আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ক্ষমতার হালুয়ারুটি ভোগ করে চলছেন। প্রতি বছর ২ ডিসেম্বর এলেই তিনি নানারূপ দাবী দাওয়া ঘোষণা দিয়ে ঢাকার বড় বড় হোটেলে সভা-সমিতির মাধ্যমে মিডিয়াকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন। তার প্রতি পাহাড়ের জনগণের নেতৃত্ব আছে কি না সেটিও আজ প্রশ্নের মুখে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা নিয়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দের অভিমত
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীম বীর প্রতীক বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিরা দেশের অন্য বাঙালিদের অধিকারের দিক দিয়ে বঞ্চিত জনগোষ্ঠি। দেশের বড় একটি বুদ্ধিজীবী গ্রুপ তাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে। বুদ্ধিজীবী গ্রুপকে দেশের স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম রক্ষায় সম্পৃক্ত করানোর জন্য উপজাতি বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। কারো হাতিয়ার হওয়া যাবে না। আওয়ামীলীগের শান্তিচুক্তির সমালোচনা করে তিনি বলেন- আওয়ামী লীগ আজ দেশকে ডিজিটাল করার জন্য বলছে, কিন্তু ৭৫ এর আগে কী করছে তা তারা বলে না। তাদের সময় থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি শুরু হয়। সেই অশান্তি আজো বিরাজ করছে। তাই এই সরকারের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি আশা করা যায় না (সূত্র: দৈনিক নয়া দিগন্ত)।

কলামিস্ট এরশাদ মজুমদার বলেন- পার্বত্য চট্টগ্রামে ভারত, পাকিস্তান আমলে সমস্যার সৃষ্টি করে। এই ধারাবাহিকতায় ভারত আজও সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে চলছে। এ জন্য দেশের জনগণকে সচেতন হতে হবে।

নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার বলেন, আমাদের দেশে যা বলা হয় তার উল্টো বর্ণনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ব্যাপারেও বহির্বিশ্বে বিপরীত বর্ণনা করা হয়। তাই সব ভুল ভাঙিয়ে দেশ রক্ষার জন্য কাজ করতে হবে।

কবি ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার বলেন- এই সরকার নিজেদের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন, দেশকে অস্থিতিশীল ও ভারতের মনোরঞ্জন করার কাজে ব্যস্ত। তাদের কাছ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের শান্তি আশা করাটা বড় ভুল। এ জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালিদের প্রধান কাজ হবে দেশের জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন সময়ে জাতীয় নেতৃবৃন্দ অনেক পরামর্শ ও সুপারিশ করেছেন যা আজো বাস্তবায়িত হয় নাই। বিচারপতি আব্দুর রউফ, বিচারপতি আব্দুর রহমান চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ড. এরশাদুল বাড়ি, প্রফেসার এমাজ উদ্দিন আহমেদ, সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী, আতাউস সামাদ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পার্বত্যবাসী জনগণের মধ্যে ঐক্য শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য সরকারের কাছে যে সব পরামর্শ দিয়েছিলেন সেগুলোকে আদৌ বাস্তবায়িত করা হয় নাই।

বরং ঐ সকল জাতীয় নেতৃবৃন্দের পরামর্শকে পাশ কাটিয়ে ২রা ডিসেম্বর ১৯৯৭ইং চমক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কিংবা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আশায় অনেক জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্চলী দিয়ে বৈসম্যমূলক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যার ৯৯ভাগ বাস্তবায়ন হওয়া সত্ত্বেও সন্তু বাবুদের পাওয়ার খুধা আজো মিটে নাই। কোন দিন মিটবে কি না সে প্রশ্ন জাতির বিবেকের কাছে। কেননা এখন শুধুমাত্র জুম্মল্যান্ড নামে পৃথক পতাকা উড়ানো ছাড়া সন্তু বাবুদের আর কোন কাজ বাকি আছে বলে মনে হয় না।

দেশের এক ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেলিপ্ত মুক্তিবাহিনীকে দমন করতে না পেরে নিরিহ ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধ করেছিল। একই কায়দায় বাংলাদেশের হৃদপিন্ড পার্বত্য চট্টগ্রামকে ছিনিয়ে নিয়ে স্বাধীন জুমল্যান্ড বানাবার নামে বিগত ৩ যুগ যাবত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে না পেরে ৩০ হাজার নিরীহ পার্বত্যবাসী বাঙালীকে হত্যার মাধ্যমে আরেকটি যুদ্ধাপরাধ করেছেন সন্তুলারমা বাহিনী। যা আজৌ অব্যাহত আছে।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল ৫৫৫৯৮ বর্গ মাইলে বসবাসরত বাঙালী উপজাতি সকল নাগরিকের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিগত ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ইং স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির বিনিময়ে পার্বত্যবাসী বাঙালিরা সাংবিধানিক সমঅধিকার হারিয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্য, সুখ-সমৃদ্ধিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালীদেরকে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিনত করা হয়েছে। “ঘরে তাদের খুধার জ্বালা, বাহিরে প্রাণের ভয়”-মরহুম সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তানের এই পর্যবেক্ষনকে স্মরণ করে এবং সম্মান জানিয়ে ২ রা ডিসেম্বরকে বরন করে নেয়া ছাড়া পাহাড়ের জনগণের বিকল্প কোন পথ খোলা নেই। আসুন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে রক্ষা করি। জুমল্যান্ড প্রতিরোধ করি।

লেখক: মনিরুজ্জামান মনির, মহাসচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমঅধিকার আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: শান্তিচুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন