সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলোর বেপরোয়া সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি

চাঁদার অর্থ দিয়ে পাহাড়ে মজুদ হচ্ছে ভারী অস্ত্র

খাগড়াছড়ি সংবাদদাতা:
 অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে পাহাড়ের অনিবন্ধিত আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর আবির্ভাব হলেও বর্তমানে তারা পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরকারের প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যাচ্ছে  আঞ্চলিক দলগুলোর বেপরোয়া সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি। অধিকার নয়, আধিপত্যই এখন তাদের মূল টার্গেট হয়ে দাঁড়িয়েছে। একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চাঁদা আদায়কে প্রধান পুঁজি করে জেএসএস ও ইউপিডিএফ পার্বত্যাঞ্চলের গহীন অরণ্যে গড়ে তুলছে তাদের স্ব স্ব সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক, ট্রেনিং সেন্টার ও ভারী অস্ত্রের মজুদ। টার্গেট সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে প্রতিমাসে কোটি টাকার চাঁদাবাজি। জুম্ম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন অনেকটা গৌণ।

জানা যায়, প্রতিটি দলের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আদায় হয়ে থাকে কোটি কোটি টাকার চাঁদা। এজন্য দলগুলির মোটা দাগের বেতনধারী সশস্ত্র স্কোয়াডের সদস্যদের মধ্যে প্রায়শ চলে নতুন নতুন এলাকা দখলের লড়াই। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ঘটে বন্দুক যুদ্ধ ও হতাহতের ঘটনা। গত একমাসে আধিপত্যের লড়াইয়ে খুন হয়েছে দলগুলির ৯ সদস্য। আধিপত্যের লড়াইয়ে টিকে থাকতে দলগুলো মোটা বেতনে ভারী অস্ত্রে প্রশিক্ষিত সদস্য সংগ্রহ করছে প্রতিবেশী দেশ থেকে। এরা সকলেই প্রতিবেশী দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সদস্য বলে জানা গেছে।

দীর্ঘ দুই দশকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির সীমাহীন চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারেনি সামরিক বে-সামরিক প্রশাসন।  চাঁদার দাবীতে চলছে প্রতিনিয়ত ঘটছে হত্যা, গুম, অপহরনের মত জঘন্য ঘটনা। গত ৮ জুলাই বিকালে সরকারী মোবাইল অপারেটর কোম্পানী টেলিটকের টাওয়ার নির্মাণকারী পাঁচ শ্রমিককে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়েছে চাঁদার দাবীতে। ১৭ দিন পরে সেনাবাহিনী ও র‌্যাবের যৌথ অভিযান শেষে তাদের অক্ষত অবস্থায় উদ্বার করে। বন্ধ রয়েছে সারা জেলা জুড়ে ওষুধ সরবরাহ। দিঘীনালা উপজেলায় কাঁচামাল ক্রয় বয়কট করেছে  পাইকাররা। এর আগে সশস্ত্র দলগুলির চাঁদাবাজি বন্ধের দাবীতে খাগড়াছড়ি পরিবহন মালিক সমিতিসহ বেশকটি বাঙ্গালী সংগঠন তিন দিনের পরিবহণ ধর্মঘট পালন করে খাগড়াছড়ি জেলায়।

গত ৩ জুলাই পরিবহণ মালিকদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে চাঁদাবাজি বন্ধের বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো: মাসুদ করিম বলেন, যারা চাঁদা প্রদান করছেন তারা চাঁদা না দিলেইতো চলে, তবে আঞ্চলিক দলগুলির সশস্ত্র তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে যান তিনি। আবার আঞ্চলিক দলগুলির নেতারা চাঁদা আদায়ের কথা বরাবরের মতোই অস্বীকার করে এবং একদল অন্য দলকে দোষারোপ করে  থাকে।

এদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে  আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব না থাকলেও দল দুটি অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে চাঁদা দিতে বাধ্য করছে। পাহাড়ের সাধারণ মানুষ এখন মনে করছে আসলে অধিকার নয় এখন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক দলগুলো

জনসংহতি সমিতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ আর সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে  খুব কম সময়ে পাহাড়ের বেশীরভাগ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করেছে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠন ইউপিডিএফ। জেলার আইন শৃংখলা বাহিনীর দপ্তরে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত নৃশংস ঘটনার সাথে ইউপিডিএফের সশস্ত্র সদস্যদের জড়িত থাকার প্রমান থাকলেও রহস্যজনক কারনে প্রশাসন কোন আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে বেড়েই চলেছে তাদের দোর্দন্ড প্রতাপ। এক সময় জনসংহতি সমিতির প্রভাব থাকলেও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে খাগড়াছড়িতে গঠিত হয় জনসংহতির এম এন লারমা গ্রুপ। সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে ইউপিডিএফের সাথে অনেকটা মিলেমিশে চলছে এরা। মাঝে মধ্যেই জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের ঘটনা ঘটছে চাঁদা মহালের দখল নিয়ে।

অপরদিকে গোপন সুত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বিভিন্নভাবে বেকায়দায় পড়ে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইউপিডিএফ’র সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছে। এছাড়া দীর্ঘদিন বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বেতনভাতা বন্ধ থাকায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে খুব কম মুল্যে তাদের  অস্ত্র বিক্রি করছে ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের কাছে। ভারী অস্ত্রের মজুদ নিয়ে সশস্ত্র সদস্যদের সংখ্যা বাড়িয়ে অধিকাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রন নিয়েছে ইউপিডিএফ। আর প্রতিমাসে বিভিন্ন সেক্টর থেকে আদায় করছে কোটি টাকার চাঁদা। চাঁদা আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে ইউপিডিএফ নেতারা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বরাবর একই কথা বলেন। তারা বলেন জুম্ম জাতির আত্ম নিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তহবিলে এই সহযোগিতা নেয়া হয়। (চাঁদার টোকেনের শিরোনাম- জনতার মুক্তি সংগ্রামে এগিয়ে আসুন।)

বসতভিটা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার সকল মাধ্যমে তাদের ইচ্ছেমতো বসানো হয়েছে চাঁদার হার। হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের কোটি কোটি টাকা। এছাড়া বিশাল অংকের এই চাঁদার অর্থ থেকে কখনো কোন বিপদগ্রস্ত পাহাড়ী মানুষ সহযোগিতা পায়নি। ভুক্তভুগীরা বলছে, ওরা এখন পাহাড়ের বিকল্প সরকার। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন জেনে শুনেও নীরব, কারণ তাদের কাছে অভিযোগকারী নেই। এদিকে নিরস্ত্র মানুষ অভিযোগ করে জীবন দিতে রাজি নয়। চাঁদা না দেয়ায় এযাবৎ অনেক নিরাপরাধ মানুষকেই প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের হাতে। বছরের পর বছর চলছে তাদের বোবা কান্না। মাঠ প্রশাসন থেকে সরকারের কেন্দ্রিয় পর্যায়ে বিষয়টি ওয়াকিবহাল হলেও চাঁদাবাজি বন্ধে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। চাঁদাবাজির এই সীমাহীন দৌরাত্মের কারনে প্রশ্ন উঠেছে পাহাড়ে আদৌ সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব আছে কীনা?

চাঁদার নামে শোষনের শিকার বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ বলছেন, এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করেই পাহাড়ে আবারো ভয়াবহ সংঘাত হতে পারে। এই সংঘাত হবে অতীতের চেয়ে অনেক ভয়ংকর পরিনতির। কারণ এই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে সকল শ্রেনী পেশার মানুষের মাঝে। এক সময় কিছু  নির্ধারিত ব্যবসা বাণিজ্যের উপর চাঁদা আদায় হলেও এখন সর্বক্ষেত্রে এই চাঁদা বাধ্যতামুলক। অন্যথায় ধার্য্য ব্যাক্তির জানমালের উপর নিশ্চিত বিপদ।
 
আগে অধিকার আদায়ের নামে একটি দলকে চাঁদা দিতে হতো। এখন দিতে হয় তিনটি দলকে। তিনটি দল হলো জনসংহতি সমিতি, ইউপিডিএফ ও জনসংহতি সংস্কার। উন্নয়নকাজ, পাহাড়ের আবাদী জমি, ফলজ ও বনজ বাগান, ব্যবসায়ী, সরকারী চাকুরে, কৃষক থেকে দিন মজুর পর্যন্ত কেউই রেহাই পাচ্ছেনা এই চাঁদার কবল থেকে। জেলার বিভিন্ন বাজারে সপ্তাহের হাটের দিন প্রতিটি পণ্যের উপর নির্ধারিত হারের চাঁদা দিতে হয় বাধ্যতামুলকভাবে। এভাবেই পার্বত্য এলাকাজুড়ে চলছে ইউপিডিএফ-জেএসএস“র কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের কার্যক্রম। নিরস্ত্র সাধারণ পাহাড়ী- বাঙ্গালী তাদের মনে প্রাণে ঘৃনা করলেও সশস্ত্র তৎপরতার ভয়ে মুখ খুলতে একেবারেই রাজী নয়। উপরন্তু তাদের ডাকে সভা সমাবেশে যেতে হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনের নামে। কিন্তু ভারী অস্ত্রের তৎপরতার মুখে আসল সত্যি বোবা হয়ে আছে পার্বত্য চট্টগ্রামে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন