সাজেক সড়কের দু’পাশে রিজার্ভ ফরেস্টের জায়গায় গড়ে ওঠা অবৈধ বসতি পর্যটকদের নিরাপত্তা সঙ্কট সৃষ্টি করেছে- ওয়াদুদ ভুঁইয়া

ওয়াদুদ

মো. জুয়েল, সাজেক প্রতিনিধি:

পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের পর বর্তমানে সাজেকের স্থানীয় জনগনের জীবনমানের অকল্পনীয় উন্নয়ন হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন সাবেক এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপি’র সভাপতি ওয়াদুদ ভুঁইয়া।

তিনি আরো বলেন, ২০০৬ সালে প্রথমবার যখন আমি সাজেক আসি তখন তেন রাস্তাও ছিল না।  বর্তমানে রাস্তা হয়েছে এবং এই রাস্তার দুইপাশ দিয়ে রিজার্ভ ফরেস্টের জায়গায় প্রচুর অবৈধ বসতি হয়েছে।  এসকল বসতি পর্যটকদের যাতাযাতের পথে নিরাপত্তার সঙ্কট সৃষ্টি করেছে বলে তিনি সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

দীর্ঘ একযুগ পর সাজেক ভ্রমণে পার্বত্যনিউজের এ প্রতিনিধির কাছে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণণা করতে গিয়ে উপরোক্ত কথা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনপ্রিয় এই নেতা। উল্লেখ্য, সংসদ সদস্য ও উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে ১২ মার্চ ২০০৬ সালের প্রথমবার সাজেক ভ্রমণে এসেছিলেন তিনি। এর একযুগ পর গত ১১ জানুয়ারী দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে দীর্ঘ ১ যুগ পর দুই দিনের জন্য সাজেক ভ্রমণে যান তিনি।  সাজেক ভ্রমণকালে তিনি স্থানীয় পর্যটন রিসোর্টে রাত্রি যাপন করেন।  প্রিয় নেতাকে কাছে পেয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের উল্লসিত হতে দেখা যায়।

ওয়াদুদ ১

 একযুগের ব্যবধানে সাজেক ভ্রমণে তার অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগে ১২ মার্চ ২০০৬ সালের প্রথমবার গিয়েছিলাম, তখন কিন্তু কোন রাস্তা ছিলোনা, দুর্গম, বন্ধুর সে যেন এক অরণ্যবাস। সেখানে যাওয়া আর যুদ্ধে যাওয়া যেন এক।  অনেকে সেদিন আমাকে বারণ করেছিল, আমি সেই বাধা শুনি নাই, আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছিলাম সাজেক আমাদেরই, সাজেক বাংলাদেশেরই।  সাজেক হতে পারে একটি পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটন স্থান।

যদিও সেই সময় সাজেকের মানুষ খাগড়াছড়ি শহরে আসতে সাতদিন লাগতো পায়ে হেঁটে।  তাই তারা বাংলাদেশের সাথে যোগাযোগ না রেখে রাখতো মিজোরামের সাথে, সেখানে সাজেকের ছেলে মেয়েরা সেখানকার ইংরেজি মিডিয়ামে খ্রিষ্টান মিশনারির স্কুল কলেজগুলোতে পড়ালেখা করতো, মানুষজন মিজোরামে  হাটবাজারসহ যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতো, বিয়েসাদী সম্পর্কও তাদের সাথে ছিল।

আমরা ২০০৬ সালে গেলে তারা আমাদেরকে অনেক আদর আপ্যায়নের সহিত তাদের বাসা বাড়িতে রাখে, যদিও আমরা প্রায় একশতজন থাকার ও খাওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম।  তারা আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানায় ইংরেজিতে গান গেয়ে ও পাংখোয়াদের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।  সেখানে মূলত লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরারা বসত করে।

আজকের সাজেক মাথায় রেখেই আমরা সেই সময় সজেকের কংলাক পাড়ায় একটি রেষ্টহাউজ নির্মাণ করি, বিদ্যুৎ এর বিকল্প হিসাবে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জেনারেটর, পানির অভাব পুরনের জন্য একটি পানির প্রকল্প হাতে নেই এবং সাময়িকভাবে গভীরতর স্থান থেকে ঝর্নার পানি তুলে আনার জন্য পাঁচটি গাধা প্রদান করি।  কমলার চাষসহ ইত্যাদি উপায়ে সাজেকবাসীর উন্নয়নের জন্য নানা আয়বর্ধনমূলক প্রকল্প হাতে নেই এবং আজকের সাজেকের রাস্তাটি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অনুরোধ করে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করি ২০০২ সালেই।  কিন্তু রাস্তাটি সমাপ্ত হয় ২০০৭ সালে।

ওয়াদুদ ২

ওয়াদুদ ভুঁইয়া বলেন, সাজেকে আমি যাওয়ার আগে রাষ্ট্রের একটি মানুষ ছাড়া সেখানে কোন ইউএনও ও ওসিও যাননি, অন্যদের কথাতো বাদই দিলাম।  স্বাধীনতার পর সাজেকে প্রথম জাতীয় নেতা হিসেবে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সাজেকের মাটিতে পদার্পন করেন। তার এই আগমণের ফলে এ দেশের মানুষ প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীন ভুখণ্ড হিসাবে সাজেকের সাথে পরিচিত হয়।

তিনি এসে সাজেকের জনগনের অবহেলিত ও করুণ অবস্থা দেখে  জীবনমান উন্নয়নের লক্ষে সাজেকবাসীর মালামাল বহনের জন্য ৩০০ গাধা ও সাজেককে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করতে রুইলুই পাড়া থেকে কংলাক পর্যন্ত বিদ্যুতের তার ও জেনেরেটর এর মাধ্যমে বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং প্রতি মাসে একবার হেলিকপ্টারে করে বাজার সদায় করার জন্য রুইলুই থেকে বাঘাইছড়ি উপজেলায় নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এবং এই সব কিছু একমাসের মধ্যে বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।

তিনি আরো বলেন, এই ঘোষণা দিয়ে যাওয়ার একমাস পর ঘাতকেরা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা অনুযায়ী সকল কিছু বাস্তবায়ন করা হলেও পরবর্তীতে সামরিক সরকার এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুতের তার ও জেনারেটর বিলাইছড়ি নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানা যায়। জিয়ার মৃত্যুর পর থেকে আর কোন নেতা সাজেকের দুঃখ দূর্দশা ও অবহেলিত জীবন দেখার জন্য আসেনি।

সাজেকের সৌন্দর্য কেমন লাগলো এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া কবিতা আবৃত্তি করে বলেন, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথায় এক পড়শি বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে”।    বাংলাদেশের সেই পড়শি হল সাজেক ভ্যালি- যা খাগড়াছড়ির অতি নিকটে এবং খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেক যেতে হয়।  আমরা সেই খাগড়াছড়িরই বাসিন্দা।  কিন্তু আমাদের অনেকেরই সেই আরশি নগর দেখা হয়নি।  অবশ্য আরেকটু নজর দিলেই সাজেক ভ্যালিকে পৃথিবী বিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা সম্ভব।  যদিও এখন সাজেক বিখ্যাত একটি পর্যটন কেন্দ্র, যেখানে প্রতিদিন শত শত পর্যটক আসে সাজেকের প্রকৃত রূপ, প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য ও মেঘ ছুঁতে।  যারা আজকের এই সাজেককে প্রস্তুত করেছে তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।

পর্যটকদের জন্য এখানে কোনো অসুবিধা আপনার চোখে পড়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেতা বলেন, আমি যখন ২০০৬ সালে সাজেক আসি তখন রাস্তার দুই পাশে কোন বসতি ছিল না।  কিন্তু এবার আসার সময় দেখলাম রাস্তার দু পাশে রিজার্ভ ফরেস্টের জায়গা দখল করে প্রচুর পরিমাণে নতুন অবৈধ স্থাপনা ও বসতি গড়ে উঠেছে। এইসব অবৈধ বসতি ও স্থাপনার কারণে পর্যটকদের আসা যাওয়ার পথে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। সম্প্রতি এরকম কিছু বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে গেছে। তাছাড়া এরা রিজার্ভ ফরেস্টের গাছপালা, জীববৈচিত্র ধ্বংস করছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখা দরকার। তবে এবারে রাস্তায় নিরাপত্তা বাহিনীর নিরাপত্তা প্রদান চোখে পরার মত ছিল।

সাজেকের এই পর্যটন কেন্দ্র আরো আকর্ষণীয় করতে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কিনা প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই এমপি বলেন, বর্তমানে সাজেকের যে উন্নয়নের জোয়ার সূচিত হয়েছে আমি সকল মহল, সকল সংগঠনকে অনুরোধ করব; কেউ যেন এই উন্নয়নের বাধা সৃষ্টি না করে। এখানে অনেক অবহেলিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জীবন জীবিকা, রুটি রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন, পরিবহন, রেস্টুরেন্ট ও অন্যান্য খাতেও পড়েছে। আর এখানে প্রকৃতির সাথে মানুষের বন্ধুত্ব হয়েছে এবং প্রকৃতি ও জীবন কি জিনিস এখানে আসলে বোঝা যায়। তাই এর যেন কোনো ক্ষতি না হয় সে ব্যাপারে যত্নবান হবার জন্য সকল মহলকে অনুরোধ করছি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ওয়াদুদ ভুঁইয়া, পর্যটন, সাজেক
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন