parbattanews

অগ্নিগর্ভ মনিপুর আমাদের কি বার্তা দেয়?

লেখক: মেজর নাসিম হোসেন (অব.)

গত ৩ মে, ২০২৩ থেকে উওর-পূর্ব ভারতের অন্যতম সুন্দর পাহাড়ি রাজ্য মনিপুর ভয়ঙ্কর এক জাতিগত হামলায় পুড়ছে। মনিপুরকে বলা হয় ভারতের সুইজারল্যান্ড। ২৮ লাখ পাহাড়ি মানুষের আবাসস্থল মনিপুর আসলে পাহাড়ি ও উপত্যকা এলাকা নিয়ে গঠিত। এই জনপদে বাস পাহাড়ি কুকি, নাগা ও সমতলের মেইতী জনজাতি নামে পরিচিত মনিপুরের সবচেয়ে অগ্রসর গোষ্ঠীর।

ঘনবসতি পূর্ণ ইমফলের পুরো এলাকা জুড়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেইতী জাতির বাস। তাদের সাথে আরো আছে ৮% মনিপুরী মুসলিম। ইম্ফলের সমতলভূমি, যা মনিপুর রাজ্যের মোট আয়তনের মাত্র ১০ শতাংশ, আর এখানেই বাস করে পুরো মনিপুর রাজ্যের ৫৩% মানুষ। রাজ্যের অর্থনৈতিক শক্তি, বিধানসভার এক-তৃতীয়াংশ আসনের অধিকারী, বিজেপির ৭ জন এমপি সম্বৃদ্ধ এই রাজ্যটি এখন বিজেপির শাসনে পরিচালিত হচ্ছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রে বিজেপি থাকায় মেইতী জনজাতির এখন খুবই বাড়বাড়ন্ত। পুরো মনিপুরের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, শিল্পায়ন এই ইম্ফলকেন্দ্রিক এবং মেইতীরা বেশ ভালোই আছেন এখানে।

অন্যদিকে পাহাড়ি এলকার দশটি জেলাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করে নাগা ও কুকিরা। তারা মনিপুরের বাকি ৯০% জায়গায় থাকে। যোগাযোগ ও অন্যান্য প্রতিকূলতার জন্য তারা ‘সিডিউল কাস্ট’ নামে রাষ্ট্রের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।

বাইরের লোকের কাছে সুইজারল্যান্ড মনে হলেও দীর্ঘ দিন থেকে মনিপুরে জাতিগত বিভাজনের ফাটল বাড়ছিলো। নাগা-কুকিরা খ্রিস্টান হওয়ায় ধর্মীয় ‌’ফল্ট লাইন বা চিড় রেখা’ বিজেপি ক্ষমতায় আসায় মেইতী তুষ্টনের পালে হাওয়া পায়। মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বিরেন সেন হিন্দু এবং মেইতী সম্প্রদায়ভুক্ত হওয়ায় সেই সন্দেহ আরো তীব্র হতে থাকে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট এক সমনে মেইতীদের রাজ্যের সিডিউল কাস্টে অন্তর্ভুক্ত করতে চার সপ্তাহের সময় বেঁধে দেয়। এতেই ফুঁসে উঠে কুকি-নাগা ছাত্রদের সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন অফ মনিপুর’। তারা মেইতীদের ‘সিডিউল কাস্ট’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা দানের বিরোধী, তারা মেইতীদের ট্রাইবাল মনে করে না। তারা মনে করে এর মাধ্যমে তাদেরকে পাহাড়ি এলাকায় রিজার্ভ ফরেস্ট, প্রটেক্টিভ ফরেস্ট ও ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংকচুয়ারি তৈরি করতে তাদের পাহাড়ি ভূমি থেকে উৎখাত করা হবে। তারা চাকরি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে সুবিধা পাচ্ছিলো তাতে ভাগ বসাবে মেইতীরা।

বিস্ফোরণের স্পার্ক ছিলো গত ৩ মে পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনের একটি মিছিল। মিছিল থেকে একটি জিমে আক্রমণ হলে দাবানলের মতো হিংসার আগুনে পুড়তে থাকে সব সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘর, গাড়ি-দোকানপাট। প্রাণ হারায় ৫৪ জন মানুষ।

মেইতীদের দাবি হলো পাহাড়ি কুকি-নাগারা সমতলে জমি কিনতে পারে, বসবাস করতে পারে কিন্তু যখনই মেইতীরা পাহাড়ে জমি কিনতে চায় তখনই বাঁধা।

এখানেই মনিপুরের সঙ্কটের সাথে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের একটা মিল পাওয়া যায়। চাকমারা বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন জমির মালিকানা মানে না। চাকমারা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে জমি কিনতে পারবে, কিন্তু বাঙালির কোন জমির মালিকানা পাবার অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামে নাই। চাকমারা নিজেদের পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘আদিবাসী’ দাবি করে।

কুকিরা মনিপুর রাজ্যের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে তাদের তুলে দেওয়ার তীব্র বিরোধী। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো কুকিরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ দাবি করে। অপরদিকে মেইতীরা কুকিদের প্রাক্তন বার্মা থেকে বিতাড়িত এবং ইম্ফলে গেড়ে বসা বহিরাগতই মনে করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ্যাংলো-কুকি যুদ্ধের (১৮১৭-১৮১৯) শত বার্ষিকীর স্মৃতি ফলক স্হাপনে মেইতীরা আপত্তি করে।

জাতিগত পরিচয়, ধর্মীয় বিভাজন, সাংস্কৃতিক বিভাজন, রাজনৈতিক শক্তির তারতম্য সর্বোপরি আর্থিক টানাপোড়েন, বেকারত্ব সব কিছু মিলিয়ে মনিপুরকে এক বারুদের স্তুপে পরিণত করে। সে আগুন জ্বলে উঠে যখন কুকিদের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে অপসারণের পদক্ষেপ নিতে যায় বিজেপি সমর্থন পুষ্ট রাজ্য সরকার। সেই আগুন শুধু মনিপুরেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। সারা ভারতে ‘নাইস এন্ড ফ্রেন্ডলি’ বলে পরিচিত মনিপুরের কুকি-মেইতী তরুণরা দিল্লির রাস্তায়ও জড়িয়ে পরে তীব্র সংঘর্ষে।

কুকিরা শুধু মেইতীদের সাথে নয় তাদের ঐতিহাসিক বিরোধ আছে নাগাদের সাথেও। ১৯৯৩ সালে নাগারাও কুকিদের উপর চালিয়েছিলো গণহত্যা। প্রায় হাজার খানেক কুকি তাতে প্রাণ হারায়।

আজ পার্বত্য চট্টগ্রামেও চলছে নানামুখী বিরোধ: চাকমা বনাম বাঙালি, কুকি বনাম মারমা, কুকি বনাম চাকমা। কুকিরা মানে না চাকমা নেতৃত্ব, কুকিদের অমতে সরকারের সাথে চুক্তি, জুম্ম জাতি বলে কুকিদের পরিচয় করানো নিয়ে বিরোধ আছে তাদের মধ্যে। কুকিরা চায় পার্বত্য চট্টগ্রামে আলাদা কুকিল্যান্ড সৃষ্টি করতে, যেখানে চাকমা মারমা ত্রিপুরারা হবে বহিরাগত। জেএসএস চায় অন্যান্য সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব, চায় মনিপুরের মতো পাহাড় থেকে সকল বাঙালির বিতাড়ন।

তাই অগ্নিগর্ভ মনিপুরের লাল আগুন দেখে আশঙ্কা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও কেউ না আবার কোন ডিক্রির বলে বলিয়ান হয়ে অপর জাতিকে বিতাড়িত করতে কোনো হটকারিতায় মেতে উঠে। সে ক্ষেত্রে পাহাড়ের আগুন কি পাহাড়েই সীমাবদ্ধ থাকবে?

লেখক: অবসর প্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা

Exit mobile version