অপহৃত বন্দর কর্মকর্তা বর্ণনা দিলেন পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অমানবিক নির্যাতনের চিত্র
বন্দর কর্মকর্তার বর্ণনায় উঠে এলো পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অমানবিক নির্যাতনের চিত্র। তিনি বলেন, ‘মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে অপহরণের পর সন্ত্রাসীরা আমাকে গহীন পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে নেয়ার পর তারা আমার পায়ে লোহার ভারি শিকল পরিয়ে দেয়। এরপর একটি গাছের সাথে মাত্র দুই ফুট জায়গার মধ্যে তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস ও ঘন কুয়াশায় রাতে-দিনে টানা ১১০ ঘন্টা আমাকে বেঁধে রাখে তারা। পালাতে চাইলে শক্ত লাঠি দিয়ে শরীরে সজোরে আঘাত করতে থাকে কয়েকজন মিলে। আমার সারা শরীরে এখন অসংখ্য ক্ষত। ব্যাথায় নড়াচড়া করতে পারছি না, ঘুমাতে পারছি না। টানা ৫ দিন ধরে সন্ত্রাসীদের হাতে বন্দি থাকার সময়গুলো মনে পড়তেই গা শিউরে ওঠছে। কখনো ফিরে আসব ভাবতে পারিনি। মুক্তি পাওয়ার পর মনে হচ্ছে নতুন করে পৃথিবীতে আবারও জন্মেছি, পেয়েছি নতুন এক জীবন।’খবর একুশে পত্রিকার।
বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) রাতে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপচারিতায় এভাবেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণ ও ১১০ ঘন্টার জিম্মিদশায় নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের উচ্চমান বহি. সহকারী জালাল উদ্দিন (৪৪)। এসময় তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় কথা বলেন।
জালাল উদ্দিন বলেন, ‘গত ৯ ডিসেম্বর বিকেল তিনটায় আত্মীয়ের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেল যোগে ফেরার পথে চন্দনাইশের ধোপাছড়ি থেকে খান হাট সড়কের (নতুন রাস্তা) ফুলদানিমারছড়া এলাকায় ৭-৮ সদস্যের অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দল আমার গতিরোধ করে। এরপর মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে আমাকে অপহরণ করে ধোপাছড়ির পাহাড়ের দিকে নিয়ে যায়। আমি তখন অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি। সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ভয়ে আমি হাঁটতে পারছিলাম না। দুর্গম পাহাড়ে হাঁটতে গিয়ে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা হাঁটার পর আমি চরমভাবে হাঁফিয়ে ওঠি। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় কাঁতরাচ্ছিলাম। তবুও ভয়ে তাদের কাছে পানি চাইতে পারিনি।’
‘সন্ত্রাসীরা আমাকে ধোপাছড়ির সাঙ্গু নদীর পশ্চিম তীরের গহীন পাহাড়ি ঘন জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়েই তারা আমার দুই পায়ে লোহার ভারী শিকল পরিয়ে দেয়। এরপর একটি গাছের সাথে সেই লোহার শিকল বেঁধে দিয়ে মাত্র দুই ফুট জায়গার মধ্যে টানা ১১০ ঘন্টা আটকে রাখে আমাকে। শিকলের ভারে আমার পায়ে কালো দাগ পড়ে গেছে। তাদের এ নির্যাতন কিছুতেই সইতে পারছিলাম না। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়া, খাওয়া-দাওয়াসহ সবকিছু এক জায়গাতেই করতে হয়েছে টানা ১১০ ঘন্টা। যেন বিভীষিকাময় কয়েকদিন দিন ও রাত পার করেছি। জীবনে এমন পরিস্থিতির সম্মুখিন হইনি। একবার পালাতে চেষ্টা করেছিলাম। বুঝতে পেরে কয়েকজন সন্ত্রাসী মিলে শক্ত লাঠি দিয়ে আমার পুরো শরীরে আঘাত করে। তাদের উপর্যুপুরি লাঠির আঘাতে শরীর জর্জরিত হয়ে গেছে। আমি তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ি।’
জালাল উদ্দিন আরও বলেন, ‘পাহাড়ি ঘন জঙ্গল হওয়ায় সেখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়ছিল। সেই সাথে হিমশীতল বাতাস ও ঘন কুয়াশা। ঠান্ডায় মরার মতো অবস্থা হয়েছিল। শরীরে কাঁপুনি ধরে গেলে অনেক অনুরোধের পর তারা আমাকে একটি পাতলা কাঁথা এনে দেয়। যা সেসময়ের তীব্র ঠান্ডার কাছে একেবারেই অপ্রতুল। সন্ত্রাসীরা প্রতিদিন সকালে আমাকে একটি দশ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট ও একটি কলা খেতে দিত। সামান্য পরিমাণ পানি দিত। এরপর সারাদিন আর কিছু খেতে দেয়া হতো না। ক্ষুধার জ্বালায় খুব কষ্ট পেয়েছি। রাতে সবজি, ডাল দিয়ে ভাত খেতে দেয়া হতো আমাকে। সন্ত্রাসী দলে ছিলো মোট ১২ জন সদস্য। তাদের সবার হাতে ছিল একে-৪৭ রাইফেল। তারা সবাই মুখোশধারী ছিল। কাউকেই আমি চিনতে পারিনি।’
‘তবে তাদের মধ্যে একজন বাঙালি ছিল বলে আঁচ করতে পেরেছি। বাকিরা ছিল উপজাতি (চাকমা)। যাদের প্রত্যেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পোশাকের আদলে বিশেষ পোশাক পরিধান করা ছিল। গায়ে লতাপাতা জড়িয়ে রাখে তারা। পায়ে বুট, কোমরে বেল্ট ও হাতে একে-৪৭ নিয়ে সার্বক্ষণিক তারা ডিউটি করতো। আমাকে পাহারা দিত। আমি এক ধরণের আতঙ্কে থাকতাম সারাক্ষণ। প্রতি মুহূর্তে প্রাণ হারানোর ভয় থাকত। তবে শুধু একে-৪৭ নয়, কাটা রাইফেল ও পিস্তলসহ আরও বিভিন্ন ধরণের দেশি ও বিদেশি অস্ত্রে সজ্জিত ছিল তাদের বাহিনী। আমার ১১০ ঘন্টার জিম্মিদশায় তারা একে অপরকে নাম ধরে ডাকতে শুনিনি। কেবল ইশারায় শিস দিয়ে তারা একজন আরেকজনের ডাকে সাড়া দিত। প্রত্যেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করতো। তারা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারেও অভ্যস্ত।’ বলেন বন্দর কর্মকর্তা জালাল।
এদিকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের একের পর এক অপহরণের ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চন্দনাইশের ধোপাছড়ি ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে গত ২ মাসে ৩টি অপহরণের ঘটনা ঘটিয়েছে পাহাড়ি সন্ত্রাসী দল। এতে ওই এলাকায় যেমন আতঙ্ক বিরাজ করছে, তেমনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মানুষজন। জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দ্রুত সময়ে চন্দনাইশের ধোপাছড়ি এলাকায় সেনাবাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
প্রসঙ্গত, গত ৯ ডিসেম্বর চন্দনাইশের ধোপাছড়ি টু খান হাট সড়ক (নতুন রাস্তা) ফুলদানিমারছড়া এলাকায় মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তা জালাল উদ্দিনকে অপহরণ করে পাহাড়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। ৫ দিন শিকল দিয়ে বেঁধে বন্দি রাখার পর ১৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় শেষে গত ১৩ ডিসেম্বর রাত সাড়ে দশটায় জালাল উদ্দিনকে ছেড়ে দেয় সন্ত্রাসীরা।