অপারেশন সিন্দুর: একটি পর্যালোচনা

fec-image

বাংলা প্রবাদ “ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায় -এই কথার পুনরাবৃত্তি হলো ৬/৭ মে রাত ভারতের চালানো পাকিস্তানের উপর ব্যর্থ আক্রমণের উপর ভারতীয় সামরিক বিশ্লেষক প্রভীন শানের আশংকা।

তার The Force Magazine ‘ এর ১১ মিনিটের ভিডিও ক্লিপটি মোদী সরকার ইউটিউব থেকে সরিয়ে দেয়। খুব তিক্ত ছিলো তার পর্যবেক্ষণ। আরো বছর তিনেক আগে তার এক এপিসোডে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন

” Why Pakistan is an Over Match for India”. ভারতের যে ক’জন সামরিক বিশ্লেষক কে মোদী সরকার সহ্য করতে পারে না তাদের মধ্যে অন্যতম প্রভীন শানে এবং করন থাপা (The Wire এর এডিটর)।

প্রভীন শানের মতে যুদ্ধের তিনটি স্তর: উচ্চতর কৌশল বা স্ট্র্যাটেজিক- অপারেশনাল – ট্যাকটিকাল। দুই দেশই পারমাণবিক শক্তিধর বিধায় স্ট্যাটেজিক পর্যায়ে ভারসাম্য আছে। যুদ্ধের ফলাফল যে স্তরে নির্ধারিত হয় তা হলো অপারেশন লেভেল।

এখানেই সামরিক কমান্ডারদের যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়। তৃতীয় স্তর হলো ট্যাকটিকাল এখানেই সংখ্যা শক্তি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। কে কতটা কামান, ট্যাংক অন্যান্য সাঁজোয়া যান নিয়ে কতজনকে ঘায়েল করতে পারে বা ভূমি দখল করতে পারে তা দেখে যুদ্ধের জয় পরাজয় আমাদের কাছে পরিস্কার হয়।

আধুনিক সময়ে যুদ্ধ এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে যে ট্যাক্টিকাল লেভেলে আসার পূর্বে অপারেশন লেভেলেই যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। এখানেই মর্ডান ওয়ারফেয়ারের নিয়ামক বিমান বাহিনী ভূমিকা পালন করে।

সম্পূর্ণ অথবা সুবিধাজনক ( favourable) বিমান সহায়তায় স্হল বাহিনী দ্রুত সীমান্ত অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। বিমান শক্তি যেহেতু একটা প্রাইম এসেট এটাকে যেন তেন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য ব্যবহার করা সামরিক দৃষ্টিতে অজ্ঞতার পরিচায়ক।

অপারেশন সিন্দুরে ভারতীয় জেনারেলরা সে কাজটিই করলেন: মশা মারতে কামান দাগা। এই সংঘাতের অন্যতম ভারতীয় লক্ষ্য ছিলো পাকিস্তানকে একটা জবাব দেওয়া বা পাকিস্তানের জন্য একটা ডেটারেন্স ( Deterrence) বা নিবারক তৈরি করা। সেটাতো তারা তৈরি করতে পারলেনই না উল্টো ক্রমাগত ভাবে ভারত তার প্রতিরক্ষার মুকুট আধুনিক যুদ্ধ বিমানগুলোর পুনঃপৌনিক ব্যবহারের মাধ্যমে তার কার্যকারীতাকে ভোতা করে দিয়েছে।

বলিউডের স্ট্যান্টবাজ মোদী নিজের একটা ম্যাচো বা পেশবহুল বা সিক্স প্যাক ইমেজ তৈরি করার জন্য বার বার অসামরিক লক্ষ্য বস্তু বা ছুঁচো সন্ত্রাসী মারার জন্য তার অত্যাধূনিক বিমান শক্তি ব্যবহার করে পাকিস্তানকে ভারতীয় যুদ্ধ বিমান এবং এর রনকৌশল পর্যালোচনার সুযোগ করে দিয়েছেন।

২০১৯ সালে অপারেশন বান্দুর নামের অভিযানে, যা পুলায়মা ঘটনার পর চালানো হয় যেখানে পাকিস্তানের পাল্টা -‘অপারেশন সুইফট রিটর্ট’ এর মাধ্যমে তাৎক্ষণিক জবাব দেয়। কই পাকিস্তানের উপর কোন ডেটারেন্স তৈরি করতে পারেনি তখনও এখনও নয়।
কেন?
ডেটারেন্স বা নিবারক বা ভীতি এই কারনে সৃষ্টি করতে হয় যখন শত্রু আপনার কার্যক্রম নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবতে থাকবে কখন কোন দিক দিয়ে না আক্রমণ করে বসে এমন ভাবনা শত্রুর মনে সর্বক্ষণ বজায় রাখা। এবং আপনার শক্তি সামর্থ্য শত্রুর চেয়ে বেশি তা হিসেব করে দেখানো। রাফায়েল এর মত একটা অত্যন্ত দামী বিমানকে ননমিলিটারী লক্ষ্য বস্তু ‘মাসুদ আজহারের ডেরা ধ্বংস করতে ব্যবহার করা হয়েছে। যা রাফায়েল তো বটেই যে কোন যুদ্ধ বিমানের জন্য ‘ইজ্জত কি সাওয়াল’।

যুদ্ধ বিমানের কোর কম্পিটেন্সী বা মূল বৈশিষ্ট্য তার স্পীড, ম্যানুভারবিলিটি,স্ট্যান্ড অফ ডিস্টেন্স ( বহু দূর থেকে আঘাত হানা) সারপ্রাইজ, লিথালিটি বা নিশ্চিত মৃত্যুর আশংকাযুক্ত মিসাইল ব্যবহার, ডগ ফাইট করে আকাশকে শত্রুমুক্ত রাখা এসব কোন বৈশিষ্ট্য কে কাজে লাগানো হয়নি।

খুব নীচু পর্যায়ের কমান্ডারও তার আর্টিলারি গানকে ডিরেক্ট রোল বা অনেকটা বন্দুকের মত ব্যবহার করেন না।কারন এটা তো ইনডিরেক্ট ওয়েপন বা হাই ট্র্যাজেক্টরী, এটা দূরে গোলা নিক্ষেপের জন্য।

অপারেশন সিন্দূরের মাধ্যমে এবং তার আগের অপারেশন গুলোতে ভারতীয় যুদ্ধ বিমানের ব্যবহার পাকিস্তান এবং তার মুরুব্বি চীনকে ভারতের দূর্বলতা গুলো পর্যবেক্ষনের সুযোগ করে দিয়ে উল্টো ভারতের উপর ‘ডেটারেন্স ‘ তৈরি করেছে।

দুই দিনের সংঘাতে রাফায়েল পতনে চাইনিজ যুদ্ধাস্ত্রের একটা মারাত্মক কম্বিনেশন পাওয়া গেছে: তা হলো জে-১০ এবং পিএল ১৫ মিসাইলের যুগলবন্দী। অনেক কমদামী জে-১০ এর লম্বা নাকের কারনে তার রাডারের পর্যবেক্ষণ লিমিট ৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। সিংগেল পাইলটবাহী এই বিমানকে রাফায়েল কে চিনতে তাকে ডিটেক্ট করতে চালককে সাহায্য করে। এই লং ডিস্টেন্স স্ট্যাডঅফ রেন্জ পিএল -১৫ মিসাইল কে লক্ষ্য বস্তুতে নিতে অব্যর্থ।

যুদ্ধ বিমানের আরেকটি অপব্যবহারের নমুনা হলো টেরোরিস্ট ক্যাম্প নামক আবাসনে আঘাত করা। বিমানকে আপনি শত্রুর আকাশ সীমানা নিয়ে স্পর্ধা দেখাতে হবে। Escalation বা বর্ধিত মাএায় শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। না হলে এতো দামী অস্ত্র রেখে কি লাভ।

৫ বছরের শিশুর সম্মুখে মেশিন গান ধরে ভয় দেখানোর মত হয়েছে ভারতের আচরণ।
ভারতীয় জেনারেলগন চরম অপেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তারা মোদীর স্ট্যান্ডবাজ ইমেজের সামনে কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ নায়ক শ্যাম মানেকশ’র এর উওরাধিকার এরা নয়। এরা সব ইয়েসম্যান।

“A yes man is a horrible man, he is despised by his juniors, a curse for the nation. Professional knowledge and honesty make a competent leader.
Without a competent leader the nation has to suffer.”- ভারতীয় সেনা একাডেমির ক্যাডেটদের উদ্দেশ্য জেনারেল মানেকশর এই বক্তৃতার প্রমান পাওয়া গেল অপারেশন সিন্দুরে। এই সংঘাত ভারতের সামরিক আত্মমর্যাদার কপালে এক প্রশ্নবোধক চিন্হ হয়ে থাকলো।

ভারতের পক্ষে যে টু ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সম্ভব নয় তা অপারেশন সিন্দুর চোখে আগুল দিয়ে আবার দেখাল।
এই যুদ্ধে মোটা দাগে লাভ হলো চীনের। চীনের যুদ্ধ বিমানগুলোর কার্যক্ষমতার দারুন এক প্রদর্শনী হয়ে গেল। আগেই বলা ছিলো ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে চীনের এক অদৃশ্য হাত থাকবে।চীনের Graze on Activity বা যুদ্ধে শত্রুর সকল কার্যক্রমের সিসিটিভি নজরদারী পাকিস্তান কে নিখুঁত ভাবে আক্রমণ শানাতে সাহায্য করেছে। চীনের পশ্চিম কমান্ডে পাকিস্তানের উর্ধতন কর্মকর্তারা যুক্ত আছে অনেক দিন থেকে।

পাকিস্তানের সাফল্য আমাদের জন্য কি বার্তা বহন করে?
লাউড এন্ড ক্লিয়ার : চীনের সাথে সুদৃঢ় সামরিক সহযোগিতা এখনই বাড়াতে হবে। লালমনিরহাটের বিমানবন্দর অতিদ্রুত আধুনিকিকরন করতে হবে। ড্রাগনকে স্বাগত জানাতে হবে। ভারতের বিরুদ্ধে এটাই আমাদের ডেটারেন্স। কোমর সোজা করে দাঁড়ানোর এইতো সুযোগ। রাজনৈতিক সরকার গুলো সবই দালাল ওরা আসলে ভারতকে নাখোশ করবে না। বটতলায় বসে রবীন্দ্র সংগীত গাইবে। (১১ মে ২০২৫)

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপারেশন সিন্দুর, মেজর নাসিম (অবঃ)
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন