অস্তিত্ব রক্ষায় তরুণদের আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে: সন্তু লারমা
নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তরুণদের আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)।
আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে সন্তু লারমা এসব কথা বলেন। ৯ আগস্ট বুধবার দুপুরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আদিবাসী ফোরাম এ সমাবেশের আয়োজন করে।
এ সময় সন্তু লারমা বলেন, আমরা জাতিগত শোষণ-নীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছি। তাই ‘আদিবাসী’ তরুণদের আরো অধিকতর সংগঠিত হতে হবে। এই জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তরুণদের নীতিগত আদর্শ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এখনো বাংলাদেশের অনেক ‘আদিবাসী’ তরুণ তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন নয়। এই লড়াই-সংগ্রামে যে নির্দিষ্ট লক্ষ্য, তা আমরা নির্ধারণ করতে পারিনি। আমি মনে করি, তার পেছনে যে কারণ তা হলো, আমাদের যুবসমাজের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
যুবসমাজকে আরও বেশি সংগ্রামী হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, নেতৃত্বের মধ্যে ধারাবাহিকতা রেখে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে নিজের বিশ্বাস রেখেই লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয়। আমাদের যুবসমাজ সেই লড়াই-সংগ্রামে এখনো সেভাবে যুক্ত হতে পারেনি। বিলুপ্তপ্রায় ‘আদিবাসী’দের অধিকতর লড়াই-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এই দেশের বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিয়ে যুবসমাজকে আরও বেশি সংগ্রামী হতে হবে, সংঘবদ্ধ হতে হবে। নীতি-আদর্শকে সমুন্নত রেখে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাসেদ খান মেনন এমপি বলেন, তরুণদের বলবো, আমরা ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-লড়াই-সংগ্রাম করে বাংলাদেশ গড়েছি। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক শাসনের আমলে সংবিধানকে বিকৃত করা হয়েছে। সেখানে ‘আদিবাসী’দের অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে আত্মপরিচয় নিয়ে পাহাড়ে অশান্তি দেখা দেয়। এই সব সম্ভব হয়েছে সামরিক শাসক জিয়ার শাসন আমলে। জিয়ার আমলে বলা হলো দেশে কোনো ‘আদিবাসী’ নেই। সেই থেকে লড়াই-সংগ্রামে অনন্য অবদান এখনো রেখে যাচ্ছেন আমার বন্ধুসম সন্তু লারমা। আমাদের দুর্ভাগ্য শান্তিচুক্তি হ্ওয়ার পরও তা বাস্তবায়ন হয় নাই। আমরা যেভাবে ভাষা আন্দোলন করেছি, আত্মপরিচয়ের জন্য ঠিক একইভাবে তারাও আন্দোলন করছে। আমি তাদের তরুণদের বলব, আন্দোলন চালিয়ে যাও, আমি তোমাদের সাথে আছি ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেজবাহ কামাল বলেন, জাতিসংঘ ‘আদিবাসী’দের নিয়ে যে সংহতি ঘোষণা করেছে তা অত্যন্ত আনন্দের। এ ঘোষণার মাধ্যমে আমি ‘আদিবাসী’ তরুণদের ঐক্য গড়ার প্রতি মনোযোগ দিতে বলব। সংগঠন ছাড়া বড় লড়াই করে অধিকার আদায় সম্ভব নয়। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তরুণদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই দেশে সকল মতের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়তে হবে। পাশাপাশি সমতলেও ‘আদিবাসী’দের সংগঠন গড়ে কঠিন সংগ্রামে প্রত্যেককে সৈনিক হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। তাহলেই নতুন বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হবে ।
অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস আগে যেভাবে বিভিন্ন জেলায় পালন করা হত, এখন কিন্তু সেভাবে হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? কেউ কেউ হয়তো ভাবেন এখানে সরকারবিরোধী কথা হয়। কিন্তু সরকারকে সাথে নিয়েই তো দিবসটি আরও বড় পরিসরে পালন করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, প্রথমে লাল সালাম জানিয়ে স্মরণ করছি কল্পনা চাকমা, আলফ্রেডসহ অগনিত তরুণ যারা জীবন দিয়েছেন, হত্যা ও অপহরণের শিকার হয়েছেন কিংবা চিরতরে হারিয়ে গেছেন রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিপীড়ন, নির্যাতনের দ্বারা।এই রাষ্ট্র কোনো ভিন্ন মতকে মেনে না নিয়ে বরং আরো ভয়ংকর অসত্য সংবিধানে উল্লেখ করে। বাংলাদেশে নাকি ‘আদিবাসী’ নেই অথচ গবেষণায় ওঠে এসেছে শত বছরের পুরনো দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘আদিবাসী’ নামে স্কুল, কলেজ রয়েছে। রাখাইন জনগোষ্ঠি ৬০ থেকে ৭০ হাজারের জনবহুল এলাকায় এখন মাত্র ২ থেকে ৩ হাজারে এসেছে। এই সরকার সংখ্যালঘু থেকে সংখ্যাশূন্য করার জন্য কাজ করছে। রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামে ৯৮ ভাগ ‘আদিবাসী’ জনগোষ্ঠিকে এখন সংখ্যালঘুতে পরিণত করছে বহিরাগতদের প্রবেশ করিয়ে।
বাসদের কেন্দ্রিয় কমিটির সাধারন সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, রাষ্ট্র আদিবাসীদের অস্বীকার করে এক ধরণের বিকৃত চিন্তার পরিচয় দিচ্ছে । আদিবাসী না বলে বলছে ক্ষুদ্র- নৃগোষ্ঠি । এই সরকার শুধু আদিবাসীদের নয়, লাখ লাখ বাঙালি বেকার যুবকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে না । সুতরাং আদিবাসী,বাঙালি ও সংখ্যালঘুসহ সকল তরুণকে এই শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করা উচিত ।
সমাবেশের শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, আমাদের বহুল প্রতিক্ষিত শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন, সংখ্যালঘুদের অধিকার, মেহনতি মানুষের শ্রমের মূল্যসহ সকল অধিকার রাষ্ট্রকে মেনে নিতে হবে। বাংলাদেশ বৈচিত্র্যে ভরপুর, রাষ্ট্র এই বৈচিত্র্যেকে এক সময় উদযাপনের মাধ্যমে গ্রহণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। ভিন্নতা মেনে নিয়ে গণতান্ত্রিক এবং অসম্প্রদায়িক চেতনায় দেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দিকে লক্ষ রেখে বাঙালি ও ‘আদিবাসী’ মিলেমিশে থাকার সপ্ন দেখি। আওয়ামী লীগ সরকার ২০ বছর ক্ষমতায় থেকেও আমাদের দাবি মেনে নেয়নি। তাই হাতে-হাত ধরে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।
এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন,বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা, আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক মেন্টেন প্রমিলা, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম, বাংলাদেশ আদিবাসী পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক শরীফ জামিল, ঐক্য নবীন এর সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. আসাদুল্লাহ তারেক, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি নির্মল রোজারিও, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক জাকির হোসেন, হেক্স সিনিয়র এডভাইজার সায়মন নেসা,আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রিয় সদস্য অলিক নির প্রমুখ।
সমাবেশে আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে ১২টি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো:
১. আত্ম-নিয়ন্ত্রণের অধিকারসহ ‘আদিবাসী’দের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
২. ‘আদিবাসী’দের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. ‘আদিবাসী’ তরুণ সমাজের নেতৃত্ব বিকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৪. ‘আদিবাসী’ প্রশ্নে অন্যান্য দেশের মতো সরকার, জাতিসংঘ ও ‘আদিবাসী’ জনগণ এই ত্রিপক্ষীয় সংলাপের জন্য উৎসাহ ও প্রণোদনা দিতে হবে।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।
৬. সমতল অঞ্চলের ‘আদিবাসী’দের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমি কমিশন গঠন করতে হবে।
৭. ‘আদিবাসী’দের ভূমিতে তাদের স্বাধীন সম্মতি ছাড়া ইকোপার্ক, সামাজিক বনায়ন, ট্যুরিজম, ইপিজেড বা অন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা চলবে না।
৮. ‘আদিবাসী’দের ওপর সকল নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি বন্ধ করাসহ সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৯. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহীত ‘আদিবাসী’ বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নম্বর কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন ১০৭ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১০. জাতীয় সংসদে ‘আদিবাসী’দের জন্য বিশেষ কোটা সংরক্ষণ বা আসন বরাদ্দ রাখতে হবে।
১১. প্রথম শ্রেণির সরকারি চাকরিতে আগের মত ‘আদিবাসী’ কোটা সংরক্ষণ করতে হবে এবং অন্যান্য চাকরিসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি কোটা যথাযথ বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২. রাষ্ট্রীয়ভাবে আন্তর্জাতিক ‘আদিবাসী’ দিবস উদযাপন করতে হবে।