parbattanews

আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবসঃ ১৭ বছরেও বিচার না হওয়া এক গণহত্যার শোকগাঁথা

 sayedibnrahmat_1283883219_5-Pakuakhali-4

লংগদু প্রতিনিধি, পার্বত্য নিউজ:
আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর, পাকুয়াখালী ট্রাজেডি দিবস । পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক ভয়ংকর কালোদিন । ১৯৯৬ সালের এই দিনে রাংগামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার পাকুয়াখালীতে পাহাড়ে কাঠ কাটতে যাওয়া ৩৫ জন নিরীহ বাঙালী কাঠুরিয়াকে নির্মম নির্যাতন আর অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করেছিল সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন তথাকথিত শান্তিবাহিনীরা । পার্বত্যাঞ্চলে শান্তিবাহিনীরা এর আগেও অসংখ্য গনহত্যা করেছিল কিন্তু এই হত্যাকান্ড সকল বর্বরতা আর নৃসংশতাকে হার মানিয়েছিল । কারণ এতগুলো মানব সন্তানকে হত্যা করতে ঘাতকরা একটি বুলেটও খরচ করেনি, শুধুমাত্র দেশীয় অস্রের আঘাতে হিংস্র হায়েনার মতো ক্ষত বিকৃত করেছিল প্রতিটি লাশ । তাই উদ্ধার করার সময় অধিকাংশ লাশেরই পরিচয় সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি ।

ঐ ঘটনার নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসা ইউনুছ আলীর চোখে এখনো ভেসে ওঠে খুনীদের বিভত্‍স চেহেরা আর মৃত্যুপথ যাত্রি কাঠুরিয়াদের বিদায়ী মরণ আর্তনাদ । সেদিন পাকুয়াখালীর পাহাড়ি ছড়া দিয়ে পানির পরিবর্তে প্রবাহিত হয়েছিল বাঙালী ভাইদের রক্ত । রঙ্গিন হয়েছিল কাচালং আর মাইনীর খাল । লংগদুর আকাশ বাতাস ভারি হয়েছিল অসহায় বাঙালিদের করুণ কান্নার আহাযারিতে । খুব কাছ থেকেই অনুভব করেছিলাম সেদিনের মর্মস্পশী মূহুর্তগুলো । স্বচক্ষে দেখেছিলাম বাঙালী ভাইদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন , ক্ষত বিক্ষত নিষ্প্রাণ দেহগুলো । নিজের কানে শুনেছিলাম স্বামিহারা বোনের আর ছেলেহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ । সে কথা আজো মনে হলে ক্ষোভে আর ঘৃনায় মনটা বিষিয়ে ওঠে । স্হানিয় বাঙালীরা নিহতদের জন্য চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি সেদিন ।

এই নারকীয় গনহত্যার পর বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের তত্‍কালীন চারজন প্রভাবশালী মন্ত্রী লংগদু উপজেলা পরিষদ মাঠে বিক্ষুদ্ধ জনতার সামনে উপস্হিত হয়ে এই হত্যাকান্ডের বিচারের প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন । নিহতের পরিবারদের আর্থিক ক্ষতিপূরনের এবং শহিদদের ছেলে সন্তানদের সরকারীভাবে কর্ম সংস্হানের ব্যবস্হা করে দেওয়ার ঘোষনা দিয়েছিলেন । কিন্তু ঘটনার দেড় যুগ পার হলেও কোন কিছুই করা হয়নি শহিদ পরিবারদের জন্য । পরিবারের উপার্জনক্ষমকে হারিয়ে আজো নিহতদের অসহায় স্রী আর সন্তানেরা পথে পথে ঘুরছে দুমোঠো অন্নের জন্য । আজো তারা জানেনা কি ছিল তাদের অপরাধ ?

ঘটনার পর লংগদু থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও ১৭ বছর পার হলেও রহস্যজনক কারণে এখনো পর্যন্ত কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ । ঘটনা তদন্তের জন্য সরকারীভাবে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আজো তাদের তদন্ত করা শেষ হয়নি । এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে গেলে উপজেলার কালাপাকুজ্যা গ্রামের নিহত ওসমান আলীর মা কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তারা এখন পথের ভিখারি । অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তার অসহায় সন্তানদের । এখনো পথ চেয়ে বসে আছে রসুলপুর গ্রামের নিহত আলী হোসেনের পরিবার । হত্যাকান্ডের পর আলী হোসেনের লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি তাই ওদের বিশ্বাস তাদের ছেলে কোন একদিন ফিরে আসবেই । অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে শোকাহত হৃদয়ে জীবনের সাথে কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত আছেন অপর এক গ্রাম মোহাম্মদপুরের হেলাল উদ্দিনের স্রী নুরবানু ।

কিভাবে চলছে তার জীবন- জানতে চাইলে কেঁদে দুচোখ ভাসিয়ে তিনি জানালেন, কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুটি সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কেটেছে তার জীবন । “আমার স্বামীরে বিনা দোষে যারা খুন করছে তাদের বুকের উপর আল্লার গজব পড়ুক”- এভাবেই তিনি খুনীদের প্রতি অভিশাপ দেন । সরকারীভাবে কত টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি জানান, খুন হওয়ার কয়েকদিন পর শুধুমাত্র ৫০ হাজার টাকা ছাড়া আর তেমন কিছুই পায়নি তারা । তার স্বামীর খুনিদের বিচার দাবি করেছেন তিনি ।

নিহতদের পরিবার এবং স্হানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা যায় সরকারীভাবে যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তেমন কিছুই পায়নি নিহতদের পরিবার আর সন্তানেরা । মানবেতর জীবন করেছেন সকলেই । ফলে জীবিকার সন্ধানে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় সকলেই । এখনো বিচারের আওতায় আনা হয়নি হত্যাকারীদের- এজন্য চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্হানীয় জনগন । তারা পাকুয়াখালী গনহত্যার মূলনায়ক সন্তুলারমা সহ সকল খুনীদের যথাযথ বিচারের দাবি জানিয়েছেন । এদিকে নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে দিবসটি উদযাপনের জন্য আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর লংগদু উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ এবং সম অধিকার ছাত্র আন্দোলন ।

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
পাকুয়াখালীর হত্যাকান্ড ছিল সন্তুলারমা এবং তাদের দোসরদের একটি পরিকল্পিত ঘটনা । ঘটনার প্রায় পনের দিন আগেই লংগদু উপজেলার গুলশাখালী, কালাপাকুজ্যা, গাঁথাছড়া, জারুলবাগান, রাংগীপাড়া, সোনারগাঁও সহ প্রায় সবকটি এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার বড়মাহিল্যাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের সকল কাঠুরিয়া এবং ব্যবসায়ীদের কাছে শান্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয় । যাতে উল্লেখ ছিল যে, ‘ আগামী ৯ সেপ্টেম্বর শান্তিবাহিনীর বড় বাবু ( উর্ধতন কর্মকর্তা) সকল ব্যবসায়ী এবং কাঠুরিয়াদের সাথে মাসিক চাঁদার হার নির্ধারণের ব্যাপারে জরুরী বৈঠক করতে চান’ ।

উল্লেখ্য যে, সে সময় শান্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রপের মাত্রারিক্ত চাঁদার হার নির্ধারণ ও আদায় নিয়ে কাঠুরিয়াদের মনে ক্ষোভ বিরাজ করছিল । তাই গ্রহনযোগ্য চাঁদার হার নির্ধারণের আলোচনা সভার প্রস্তাবে বাঙালিরা স্বতস্ফুর্তভাবেই রাজি হয়ে যায । মিটিংয়ের জন্য স্হান নির্ধারণ করা হয়েছিল একেবারে গহিন পাহাডে, যেখানে প্রায় একমাস আগে থেকেই চতুর্দিকে কাঠ বাঁশ দিয়ে শক্ত করে বেড়া দেওয়া হচ্ছিল । প্রাথমিক সম্মতি দিয়েও নিরাপত্তার কথা চিন্তাকরে অবশেষে মাইনী বাজারের ব্যবসায়ীরা উক্ত মিটিংয়ে অংশগ্রহন না করার সিদ্ধান্ত নেয় ।
কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর সকালে লংগদুর প্রতিটি গ্রামে একটা উত্‍সব মুখর ভাব বিরাজ করছিল । সকল কাঠুরিয়ারা ভোর হতেই তৈরি হতে শুরু করলো কারণ বড়বাবুর মিটিংয়ে যথাসময়ে উপস্হিত হওয়া চাই । তাই সেদিন কাঠ কাটার কোন প্রকার যন্ত্র ছাড়াই খালি হাতেই পাহাড়ের ভেতর ঢুকতে শুরু করে বাঙালিরা । মিটিংয়ের স্হান থেকে কিছুদূর একটি চাকমা দোকানের কাছে পৌছাতেই কাঠুরিয়াদেরকে প্রতি পাঁচজন পাঁচজন করে একসাথে শক্তকরে হাত বেঁধে ফেলে সেনাবাহিনীর মতো পোশাক পরিহিত অস্রধারীরা । হাত বাঁধার কারণ জানতে চাইলে তারা জানায়, বড়বাবুর নির্দেশে তাদেরকে এই অভিনব কায়দায় সভাস্হলে নেওয়া হচ্ছে । তবে অভয় দেন অস্রধারীরা যে তাদেরকে হত্যা করা হবেনা । বাবুর সামনে নিয়েই তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু ততক্ষনে কাঠুরিয়াদের মনে সন্দেহ জেগে ওঠেছে তাই মৃত্যুভয়ে অনেকেই সামনে এগুতে চাইছে না । ফলে দু একজনকে গলা ধাক্কাও মারছে শান্তিবাহিনীরা ।

একেবারে কিলিং স্পট থেকে কৌশলে পালিয়ে আসা মোঃ ইউনুছ আলী জানান, কথিত মিটিংয়ের স্হলে নিয়ে তাদেরকে একটি ছোট্ট মাঠে গোল করে বসানো হয় । সেখান থেকে প্রতি পাঁচজনের একটি করে দল একটু দূরেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এবং তাদেরকে আর ফিরিয়ে আনছেনা । এসব দেখে উপস্হিত সকল কাঠুরিয়াই বুঝতে পারে যে, এটিই তাদের জীবনের শেষ মুহুর্ত । প্রচন্ড মৃত্যুভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠছিল । তারা একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে অসহায়ভাবে দৃষ্টিপাত করছিল । প্রথম তিনটি দলকে হত্যা করার পরই ইউনুছ আলীর মাথায় একটি বুদ্ধি চাপে । তিনি প্রস্রাব করার জন্য একটু দূরে যেতে চাইলে তাকে কাছেই একটি ছড়ার পাশে নিয়ে যাওয়া হয় ।

একটু পরেই নিশ্চিত মৃত্য তাই মরে যাবার আগে শেষ চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি । ফলে সাথে থাকা অস্রধারীকে কৌশলে ধাক্কা মেরে কয়েক হাজার ফুট নিচে গহিন ছড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি । সঙ্গে সঙ্গেই অদূরে থাকা বন্ধুকধারীরা তিনদিক থেকে গুলি করেন তাকে । কয়েকটি গুলিই তার গলা পিঠ ঘেষে গেলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি । তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি মৃত্যুকূপ থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন । এটি ছিল একটি কিলিং স্পটের ঘটনা । কিন্তু এটিকে কেন্দ্র করেই সেদিন বেঁচে গিয়েছির কয়েক হাজার বাঙালির প্রাণ।
কারন একইদিনে একইভাবে লংগদু এবং বাঘাইছড়ি উপজেলার বিভিন্নস্হানে আরোও বেশ কয়েকটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছিল শান্তিবাহিনী । সময় নির্ধারিত ছিল একটার পর একটার । কিন্তু পাহাড়ে হঠাত্‍ গুলির শব্দে আতঙ্কিত হয়ে যায় সকল কাঠুরিয়ারা ফলে যে যার মতো পালিয়ে এসেছিল । আর সেই গুলিটিই করা হয়েছিল ইউনুছ আলীর উপর । ধারনা করা হয়, সেদিন কমপক্ষে পাঁচ হাজার বাঙালি হত্যার মিশন নিয়ে মাঠে নেমেছিল ঘাতকরা ।

গনহত্যার দুদিন পর মাইনী সেনা জোনের একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি দল এবং স্হানীয় কয়েকশত মানুষ ইউনুছ আলীকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্হলে যায় । পাকুয়াখালী ছড়া দিয়ে কিলিং স্পটে যাওয়ার সময় কয়েক কিলোমিটার পূর্বে গিয়েই সকলে ভয়ে আৎকে ওঠেন । ছড়ার পানির সাথে রক্ত বইছে । এসময় সেনাসদস্যরা ভয়ে ইউনুছ আলীকে সামনে যেতে দিয়ে তারা পিছু পিছু ধীরগতিতে চলতে থাকে । প্রবাহমান রক্তকে লক্ষ্য করে ছড়ার শেষ পান্তে গিয়েই দেখতে পান ক্ষত বিক্ষত বিকৃত লাশের স্তুপ ।

মানুষের এমন বিভত্‍স করুণ মৃত্যু দেখে উপস্হিত সকলের চোখ বেয়ে পানি ঝড়েছিল সেদিন । নিখোঁজ ৩৫ কাঠুরিয়ার মধ্যে মাত্র ২৮ জনের লাশ পাওয়া গিয়েছিল সেখানে । বাকিদের লাশের খুঁজে পাওয়া যায়নি । পরে লংগদু উপজেলা পরিষদ মাঠে তাদেরকে দাফন করা হয়েছিল ।

Exit mobile version