আতঙ্কিত নানিয়ারচর জনপদে বইছে শান্তির সুবাতাস

এক সময়ের আতঙ্কিত জনপদ রাঙামাটির নানিয়ারচরে এখন যেন বইতে শুরু করেছে শান্তির সুবাতাস। অস্ত্রের ঝনঝনানি, অপহরণ, খুন, গুম, আলোচিত ৩ বিদেশি অপহরণ ও মুক্তিপণ দাবি, উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা হত্যা মামলা, তপন জ্যোতি চাকমা হত্যা মামলা, ইউপি সদস্যা হত্যা সহ চাঁদাবাজিতে কদিন আগেও আতঙ্কিত থেকেছে পাহাড়ি এই জনপদ।
আতঙ্কিত এই জনপদে এখন নেই অপহরণের সেই ভয়। কাটতে শুরু করেছে ভয়ের সেই চিরচেনা রেশ। সরকারি বেসরকারি ও এনজিও সংস্থার উন্নয়নমূখী কাজ এখন দৃশ্যমান। পাহাড়ের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সমূহের সুতিকাগার খ্যাত উপজেলা নানিয়ারচর থানায় গত ৭ মাসে মামলা হয়েছে মাত্র ১২টি। দুর্গম পাহাড়ের অনেক ভুক্তভোগী পরিবার এখন সেবা নিতে আসেন থানায়।
স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকায় আগের মত গুম খুন না হলেও কমেনি চাঁদাবাজদের দৌরাত্ব। আনারস, আম, কাঠাল, কলা, কমলা, ড্রাগন, গরু ও ছাগল, সেগুন-গামার কাঠসহ পাহাড়ি পণ্য ক্রয় বিক্রয়ে কয়েকটি সংগঠনকেই দিতে হয় চাঁদা।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, নানিয়ারচরে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফের সমাধীস্থল, পার্বতাঞ্চলের সর্ববৃহ সেতু চুণিলাল দেওয়ান সেতু, সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিট পুলিশিং, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কৃষিখাতে আনারস, আম, ড্রাগন, কমলা ও রাম্বুটান সহ দেশি বিদেশি জাতের বিভিন্ন চাষ নানিয়ারচরকে করছে বেশ সমৃদ্ধ।
নানিয়ারচর থানার তথ্য মতে, গত ৭ মাসে নানিয়ারচরে রজু হওয়া ১২ টি মামলার মধ্যে যৌতুক সংক্রান্ত ১টি মামলা, বেপরোয়া গতিতে ট্রাক চালিয়ে মোটর সাইকেলে ধাক্কা দিয়ে ন্যান্সি চাকমা নামে এক কলেজ ছাত্রীর মৃত্যুতে ১টি মামলা, চোরাই সম্পত্তি বেচাকেনার উদ্যেশ্যে নিজ হেফাযতে রাখার অপরাধে একটি মামলা, অপহরণ, মারধর ও হত্যার হুমকি সংক্রান্ত ৪ টি মামলা, হত্যা চেষ্টা সংক্রান্ত ১টি মামলা, অবৈধভাবে পথ রোধ করে চাঁদাবাজি মোবাইল ও মালামাল ছিনিয়ে নেয়ায় ১ টি মামলা, চোলাই মদ সংক্রান্ত ২ টি মামলা এবং পরীক্ষা কেন্দ্রে পরিক্ষার্থীকে অবৈধভাবে বহুনির্বাচনী প্রশ্নের উত্তর সরবরাহের চেষ্টায় এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।
সূত্রটি আরও জানায়, এই ১২টি মামলায় ৬৪ জনকে এজহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। যার মধ্যে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে মোট ১১জন আসামি। বাকিদের মামলা চলমান ও গ্রেফতার প্রক্রিয়দধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় ১টি ট্রাক, ২টি শ্যেলো মেশিন, ১টি মাহিন্দ্রা ও ১৫লিটার চোলাই মদ জব্দ করা হয়।
এদিকে নানিয়ারচর বাজারে লেবু বিক্রি করতে আসা যমুনা চাকমা জানান, পণ্য ক্রয় বিক্রয় করতে নানিয়ারচর বাজারে আসতে এখন আর আগের মত ভয় হয় না। নির্বিঘ্নে সে লেবু বিক্রি করতে পারছে। ২৫০ টাকার লেবু বিক্রি করেতে সে শুধু বাজার হাসিলা ১০ টাকা এবং বাজার পরিষ্কার কর্মীকে ৫ টাকা চাঁদা দিয়েছে।
উত্তপ্ত পাহাড় ও শান্ত পরিবেশ নিয়ে কথা হয় নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাবেক ঘিলাছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান প্রগতি চাকমার সাথে।
তিনি জানান, পাহাড়ের প্রথাগত আইনে হেডম্যান, কার্বারী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরাই এখানে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকে। এই অঞ্চলে বাস করা বাঙালিদের মধ্যে ও আগের মত মামলা হয় না। মানুষ এখন বুঝতে শিখেছে। আইনি জটিলতায় না গিয়ে তারা এখন স্থানীয়ভাবে সমাধান চায়।
তিনি আরও বলেন, প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। আন্তরিকভাবে জনসেবামূলক পাবলিক সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। সেক্ষেত্রে দাপ্তরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জনসেবায় আন্তরিক হতে হবে।
পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের তুলনায় পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অনেক কমেছে। এই জনপদে শান্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। তবে আজও পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের সদস্য সংখ্যা কমেনি।
পাহাড়ের উন্নয়ন বিষয়ে এই জনপ্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি-বাঙালি ভেদাভেদের যে রেশটা ছিল তা কেটে গেছে। দিন দিন এই এলাকার মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। ফলে আন্তরিকতা বাড়ছে। পাহাড়ি-বাঙালি যতদূর আন্তরিকতার সহিত চলতে পারবে ততই আমাদের উন্নয়ন হবে। পাহাড়ে উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো পাহাড়ি-বাঙালি আন্তরিকতা ও ঐক্যতা।
গত শুক্রবার (২৮ জুলাই) এ বিষয়ে জানতে নানিয়ারচর থানায় গেলে কথা হয় রাঙামাটি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. জাহেদুল ইসলামের সাথে।
এ সময় তিনি জানান, শুধু নানিয়ারচর নয়, সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির প্রতিটা থানায় বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভাল। এটা সম্ভব হচ্ছে আমাদের পুলিশ সুপার মহোদয়ের কারিশম্যাটিক লিডারশীপের মাধ্যমে। এর আগে রাঙামাটিতে অনেক রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু গোয়েন্দা সংস্থ্যা সহ সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে রাঙামাটি পুলিশ সৌন্দর্যের লীলাভূমি এই জেলা কে পর্যটক বান্ধব জেলা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করছে।
এ বিষয়ে নানিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ সুজন হালদার জানান, পূর্ব থেকেই এই জনপদ একটি আতঙ্কিত জনপদ। ২০০১ সালে ৩ বিদেশি অপহরণের মধ্য দিয়ে ইউপিডিএফ নামে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি আত্মপ্রকাশ করে। গুম, খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজি ছিল এই এলাকার নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপার। সাম্প্রতিক সময়ে এই এলাকাই শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। আমাদের পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ (বিপিএম বার) ও সদর সার্কেল জাহেদুল ইসলাম স্যারের দুরদর্শয়িতা, বিচক্ষণ নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনার ফলে আমরা জনগনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
তিনি আরও বলেন, এই এলাকার জনগন আগে থানামুখি হতো না। তাদের মধ্যে কেউ যখন কোন অপরাধ সংঘঠিত করত তখন ঐ ঘটনা প্রতিহত করার জন্য নিজেরাই আরেকটি ঘটনার জন্ম দিত। সব মিলে এই এলাকায় কাজ করা ছিল অনেকটা চ্যালেঞ্জের। একটা সময় ছিল এই এলাকার অনেক জায়গায় পুলিশ যেতে পারত না। যোগাযোগের উন্নয়নের ফলে আমরা জনগণের দৌড় গোড়ায় পৌছাতে পারছি। আমরা যখন প্রত্যন্ত এসব অঞ্চলে গিয়েছি তখন সেখানকার জনগণ আমাদেরকে কাছে টেনে নিয়েছে। আইনি সেবা সম্পর্কে আমরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। তারা এখন থানামূখি হয়েছে। আইনি সেবা নেওয়ার জন্য তারা এখন উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
বর্তমান সরকারের বিভিন্ন কৌশল ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের ফলে তারা পূর্বেকার প্রতিশোধ প্রবনতা থেকে ফিরে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা বেড়ে গেছে। আর এই কারনেই আজকে এই এলাকায় শান্তির সুবাতাস বইছে। তবে এই কৃতিত্ব পুলিশের নয়, এই কৃতিত্ব নানিয়ারচর এলাকাবাসীর। আসলেই নানিয়ারচরবাসী শান্তিপ্রিয়। তবে কিছু গোষ্ঠি আছে যারা চায় এই এলাকাকে অশান্ত রাখতে।
জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, নানিয়ারচরের পুলিশ অন্য এলাকা থেকে একটু ভিন্ন। এখানে কাজ করার অনেক গুলো প্রতিবন্ধকতা আছে। ফলে আমাদের সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও অন্যান্য যে প্রতিষ্ঠান গুলো আছে আমরা সকলের সাথে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করেছি। এভাবে সমন্বয় করে কাজ করার ফলে অসান্ত এই জনপদকে শান্তির জনপদে রুপান্তর করা সম্ভব হয়েছে।
এছাড়াও এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, অপরাধ দমনের চেয়ে অপরাধ যেন না ঘটে সেই উদ্দ্যেশ্য নিয়েই আমরা কাজ করছি। নানিয়ারচরবাসীকে আমি আহ্বান করব তারা যেন অপরাধ প্রবনতা থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশি সেবা গ্রহণ করে এবং যে কোন ধরণের আইনি সেবা পেতে তারা যেন থানামুখী হয়।