আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাঁচতে চান সাগর বিধবারা
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে মাছ শিকারে গিয়ে বৈরী আবহাওয়ায় ট্রলার ডুবিতে সাগরের অতলে হারিয়ে গেছেন সেবু আক্তারের স্বামী মোহাম্মদ আলমঙ্গীর (৪৭)। মৃতদেহের খোঁজ না মেলায় স্বামীকে দিতে পারেননি শেষ বিদায়।
৩ বছর আগে স্বামী হারানো ৩৩ বছর বয়সী সেবুর চার সদস্যের সংসারে তাঁর স্বামীই ছিলেন একমাত্র উপার্যনক্ষম ব্যক্তি। তাকে হারিয়ে সেবুর জীবনে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তা। বেঁচে থাকার তাগিদে নামতে হয়েছে সংগ্রামে। সেবু কখনো সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুড়াতে নামেন। আবার কখনো বনে যান শুঁটকি মহালের শ্রমিক। অর্থ অভাবে বন্ধ হয়ে যায় ছেলে-মেয়ের লেখা পড়া। জীবিকার তাগিদে ছেলে-মেয়েরাও যুক্ত হয় মায়ের সাথে শ্রমে। স্বল্প আয় আর ঝুঁপড়িতে টেনেটুনে চলছে সংসার। স্বামীহীন এপথ পাড়ি দিতে প্রতিনিয়ত কুদৃষ্টি থেকে শুরু নানা প্রতীক‚ লতায় পড়তে হয়েছে তাকে। এর পরেও আত্মসম্মান ধরে রাখা সেবু আক্তার কারো করুণার পাত্র না হয়ে সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বাচঁতে চান। কক্সবাজার নাজিরারটেক (১ নং ওয়ার্ড) শুঁটকি পল্লিতে এসব কথা হয় সাগর বিধবা সেবু আক্তারের সাথে।
শুধু সেবু আক্তারই নন সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে ৪৫ দিন আগে স্বামী আক্তার হোসেনকে হারান খালেদা বেগম। সাগর বিধবা খালেদা জানান, তার সেই সুখের সংসার এখন আর নেই। স্বামী হারার সুখ কাটতে না কাটতেই টান পড়েছে জীবন-জীবিকার। একদিকে স্বামী হারানোর কষ্ট অন্যদিয়ে দুই সন্তানের খাবার যোগানোর চিন্তা। তাই বাধ্য হয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছে খালেদা বেগমকেও। তিনি এখন শুঁটকি মহালের নিয়মিত শ্রমিক।
একইভাবে গত ১৫ বছর আগে স্বামী হারানো কষ্টের কথা জানান আরেক সাগর বিধবা হাজেরা বেগম। তিনি বলেন, তাদের অনেক সুখের সংসার ছিল। স্বামী লিয়াকত মিয়া ছিলেন বোটের মাঝি। সেবার সাগর থেকে এসে স্বর্ণের চেইন কিনে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বামী আর ফিরেনি। ১৩ মাঝি-মাল্লার সাথে লিয়াকত মিয়াও হারিয়ে গেছে সাগর তলে। এখনো স্বামীর স্মৃতি ভুলতে পারেন না হাজেরা বেগম। সুযোগ থাকার পরেও কারো সাথে বিয়ে বসেননি। স্বামী হারিয়ে গেলেও ভেঙ্গে পড়িনি হাজেরা বেগম। ৩ সন্তান নিয়ে এখনো লেগে আছেন জীবন যুদ্ধে। তার দিন এখন ভাল গেলেও স্বামী লিয়াকত মিয়ার শূন্যতা রয়েই গেছে।
এই প্রসঙ্গে কক্সবাজার নাজিরাটেক শ্রমিক-মাঝি-মাল্লা সমবায় সমিতি লিমিটেড এর সভাপতি নুরুল বশর মাঝি জানান, নাজিরারটেকে গত ৫০ বছরে সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে ফিরে আসেনি অন্তত ৪ শতাধিক মাঝি-মাল্লা। স্বামী হারা এই বিধবাদের কাটছে মানবেতর দিন। তাদের অনেকে জীবনযুদ্ধে টিকতে না পেরে হারিয়ে গেছে। তাদের সন্তানদের ছিন্নমূল হতেও দেখা গেছে। এই মানুষদের কল্যাণে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন।
স্থানীয় কাউন্সিলর (১নং ওয়ার্ড) আক্তার কামাল জানান, এই উপকূলে সাগর বিধবা এবং এতিম শিশুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদের জন্য সরকার যে সহযোগিতা প্রদান করছে তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া এসব সহযোগিতা সঠিকভাবে বণ্টন হয় না। অপ্রিয় হলেও সত্য এই ধরনের অনেক সাগর বিধবাদের ভিক্ষাবৃত্তিতেও দেখা যায়। তাদের কল্যাণে আরো উন্নত চিন্তা প্রয়োজন। ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল হতে প্রশিক্ষণ বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দরকার।
কক্সবাজার সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তারাপদ চৌহান বলেন, কোন মৎস্যজীবী যদি সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে মারা যায় তাহলে মৃত জেলে পরিবারের জন্য ৫০ হাজার টাকা এককালীন দেওয়া হয়। এই সহযোগিতা আরো বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে স্বামী হারা বিধবাদের জন্য বিধবা ভাতা দেওয়া হচ্ছে সরকারিভাবে।