আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা না দেওয়ায় পাহাড়ে সংঘাত থামছে না
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিনের সংঘাত বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি। বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী জনসংহতি সমিতির মধ্যে স্বাক্ষরিত এ চুক্তির ফলে সেখানে ধীরে ধীরে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষ হ্রাস পায়। তবে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) শান্তিচুক্তির যেসব ধারা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছিলেন, সেই অঙ্গীকার তিনি রাখছেন না।
এছাড়া চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী একটি পরিবার। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা দেওয়ার কথা। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের দিন ছাড়া পরে আর কেউ আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র জমা না দেওয়ায় পাহাড়ে সংঘাত থামছেই না। একটি চুক্তিও তারা বাস্তবায়ন করেননি। অথচ সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে পাহাড়ে অভাবনীয় উন্নয়ন করেছে। এতে পাহাড়ের ৯৫ ভাগ মানুষ শান্তির পক্ষে রয়েছেন। উত্পাদিত কৃষি পণ্যের দ্বিগুণ দাম পাচ্ছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা। তবে জেএসএস (মূল), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (মূল) ও ইউপিডিএফ (সংস্কার)—এই চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পাহাড়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। পার্বত্য অঞ্চলে চারটি সশস্ত্র সংগঠনের প্রতিটি বছরে শতাধিক কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। সরকারি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ঠিকাদারদের মূল বাজেটের ১০ শতাংশ হারে চাঁদা দিতে হয় তাদের। এ অর্থ দিয়েই সংগঠনগুলো সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা, শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশে লবিং এবং অস্ত্র সংগ্রহ করে থাকে। শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য চাঁদাবাজির অর্থের একটি বড় অংশ কথিত সুশীল সমাজের পেছনে ব্যয় করছে। এর পেছনে রয়েছে কথিত কয়েকটি এনজিও, যারা পাহাড়ি-বাঙালিদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৪ বছর পূর্তি উত্সব। দিবসটি পালনে তিন পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। সবার অংশগ্রহণে দিবসটি পালন করা হবে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশ সরকার পর্যায়ক্রমে চুক্তির বেশ কিছু ধারা বাস্তবায়ন করেছে এবং অবশিষ্ট ধারাগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও অব্যাহত রেখেছে। গত ২৪ বছরে শান্তিচুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণরূপে এবং ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। ৯টি ধারা বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের সীমান্তে ১ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে চেঙ্গি নদীর ওপর নির্মিত ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করা হয়েছে।
এই সেতুটি নির্মাণের ফলে জনসাধারণের ভাগ্য খুলে গেছে। ভাগ্য খুলে গেছে জেলার নানিয়ারচর, লংগদু ও বাঘাইছড়িতে বসবাসকারীদের। এর সঙ্গে সুবিধা পাচ্ছেন খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি এলাকার জনগণসহ দুর্গম এলাকার মানুষ। রাঙ্গামাটি জেলার সঙ্গে বেশ কয়েকটি উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। ব্যবসায়িক যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে।
পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি-বাঙালি ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। আমরা অনেক ভালো আছি। আমাদের মধ্যে সমস্যা আগেও ছিল না, এখনো নেই। শুধু পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ পাহাড়ে সংঘাত সৃষ্টি করছে। তিন পার্বত্য জেলাকে ভাগ করে নিয়ে তারা চাঁদাবাজি করছে। তাদের মধ্যে চাঁদাবাজির ভাগাভাগি নিয়ে চলছে সংঘাত ও প্রাণহানির ঘটনা। শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে রয়েছে বহির্বিশ্বের কোন কোন দেশ এবং কিছু এনজিও। চার সন্ত্রাসী গ্রুপের অত্যাচারে পার্বত্যাঞ্চলে অতিষ্ঠ পাহাড়ি-বাঙালি। কিছু এনজিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শুধু একটি সম্প্রদায়কে সহযোগিতা করছে। বাঙালিদের তারা কোন সহযোগিতা করে না। কিছু মানুষের ধর্মান্তরিত করেছে একটি এনজিও। এসব এনজিওদের প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এছাড়া কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি পার্বত্যাঞ্চলে গিয়ে কি করেন তাও প্রশাসনকে জানানো হয় না। তাদের এদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য মায়াকান্না।
অথচ ঐসব দেশে যেসব ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে তারা চরম অবহেলিত। বিভিন্ন সময় স্থানীয় প্রতিনিধিরা ঐসব দেশের প্রতিনিধিদের কাছে জানতে চান, বাংলাদেশ নিয়ে তারা এত নাক গলান কেন? তোমাদের দেশে তো ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা চরম অবহেলিত। তার কোনো সদুত্তর তারা দিতেন পারেনি। এদিকে পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকেই স্বাধীনতাবিরোধী একটি পরিবার প্রথম থেকে ষড়যন্ত্র করে আসছে। ঐ পরিবারের প্রধান কথিত রাজা স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেয়। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে এদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। ঐ কর্মকর্তা পাকিস্তানে মারা গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এই পরিবারের সদস্যদের বিচার দাবি করেছেন পাহাড়ি-বাঙালিরা। ঐ পরিবারের বাকি সদস্যরাও এখনো নেপথ্যে থেকে বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন। পাহাড়ের নিরীহ মানুষকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছেন। পাহাড়ে ভূমি জরিপও তারা করতে দেয় না। ভূমি কমিশনে মেজরিটি আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা। বাঙালিরা বঞ্চিত। পার্বত্যাঞ্চলে নিয়োগেও প্রধান্য পায় একটি সম্প্রদায়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রায় ১২টি সম্প্রদায় থাকলেও এক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি সম্প্রদায়কে বেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।
শান্তির পক্ষে থাকা পাহাড়ি-বাঙালিরা পার্বত্যাঞ্চলে যেসব সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল, সেগুলো আবার চালু করার দাবি জানিয়ে বলেন, আমরা আর চাঁদা দিতে চাই না, সংঘাত চাই না। আমরা এলাকায় শান্তিতে থাকতে চাই। পার্বত্যাঞ্চলকে টুরিস্ট জোন এলাকা ঘোষণা করতে হবে। পাঁচ তারকা হোটেলও নির্মাণ করার জন্য তারা দাবি জানান। ভবিষ্যতে এখানকার আয় দিয়েই বাংলাদেশ চলতে পারবে, এমন দাবিও তাদের।
রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মিজানুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাবর্ত্যাঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। সীমান্তে ১ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে পাহাড়ে। রাঙ্গামাটির নানিয়ারচরে চেঙ্গি নদীর ওপর ৫০০ মিটার দীর্ঘ সেতু নির্মাণ করায় এ এলাকায় যোগাযোগের চিত্র সম্পূর্ণ পালটে গেছে। এখন কৃষিপণ্য দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যাচ্ছে। এতে পণ্যের ন্যায্যমূল পাচ্ছেন কৃষকরা। ইউনিক ল্যান্ডের দিকে যাচ্ছে পুরো পার্বত্যাঞ্চল। পাহাড়ে যে উন্নয়ন হচ্ছে তাতে মানুষের তোপের মুখে সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজরা টিকবে না। তিনি বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন। কিন্তু এটার অভাব রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতরা এদেশের নাগরিক। এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করছে।
রাঙ্গামাটি জেলার পুলিশ সুপার মীর মোদদাছছের হোসেন বলেন, পাহাড়ের ৯৫ ভাগ মানুষ শান্তি চায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাহাড়ে যে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল পাহাড়ি-বাঙালিরা। মাত্র পাঁচ ভাগ মানুষ সন্ত্রাসী শান্তির বিপক্ষে। পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন করা হয়েছে। কৃষকরা এখন কৃষি পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা বলেন, পার্বত্যাঞ্চলে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কোথাও মানুষ অবহেলিত হচ্ছে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন পাহাড়ের মানুষ উন্নয়নের পক্ষে। চারটি গ্রুপের আধিপত্য নিয়ে যত সমস্যা। তিনি বলেন, শান্তি চুক্তি সকলের জন্য, কোন গোষ্ঠীর জন্য নয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এদেশের নাগরিক।
রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অং সুই প্রু চৌধুরী বলেন, শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে যে জটিলতা আছে তা নিরসনে সকলের সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা সবসময় শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নের পক্ষে। কিন্তু শান্তিচুক্তির আগে পাহাড়িদের জীবন ছিল চরম দুর্বিষহ। খাবার পেত না, পানি পেত না। প্রধানমন্ত্রীর দুঃসাহসিক পদক্ষেপে শান্তিচুক্তির পর পাহাড়িদের জীবনমান উন্নয়ন অনেক হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সুশিক্ষিত হচ্ছে। সরকারি উচ্চ পর্যায়ে চাকরিও পাচ্ছে। কিন্তু পাহাড়ে চারটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ নিজের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ব্যস্ত। শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে তাদের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।
সূত্র: ইত্তেফাক