parbattanews

‘আদিবাসীদের অস্তিত্ব হরণ প্রক্রিয়া চলছে’

‘আজন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ আয়োজিত সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’র সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা বলেন, ‘আদিবাসীদের অস্তিত্ব হরণ প্রক্রিয়া চলছে।’ মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি বলেন, ‘আজ ২৫ বছর অতিবাহিত হতে যাচ্ছে আপনার সরকার। পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসীদের অস্তিত্ব রক্ষা ও তাদের অধিকার আদায়ে কতটুকু সম্মান দিয়েছে, গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করেছে? গত দুই বছর করোনার কারণে আমরা আদিবাসী দিবস পালন করতে পারিনি। এবছর আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূর্বের মতো অনেক আবেগ, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এ দিবসটি পালন করছি। আপনাদের কাছে আজকে আমি জানাতে চাই এদেশের সরকার ১৯৭২ সালে সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে মাধ্যমে আদিবাসীদের পরিচয় হরণ করেছে। এদেশে সরকার শাসকগোষ্ঠী আদিবাসীদের অস্তিত্ব হরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তারপরে আমরা দেখি আদিবাসীদের বিলুপ্ত করার জন্য একটির পর আরেকটি চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

সন্তু লারমা বলেন, ‘সরকার শাসকগোষ্ঠীর কাছে প্রশ্ন, যারা আপনারা বিগত ৫০ বছর আদিবাসীদের যে পরিচয় ধ্বংস, অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার চেষ্টা যে সম্পাদন করে চলেছেন তা কি এখনো অপূর্ণ রয়ে গেছে? এই প্রশ্ন বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কাছে । আপনার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য অঞ্চলের আদিবাসী ও জুম্ম জাতির অস্তিত্ব সরংক্ষণ ও অধিকার রক্ষার জন্য চুক্তি সাক্ষর করেছিলেন।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আজকে পার্বত্য অঞ্চলে বাংলাদেশে জন্মলগ্ন থেকে সামরিক শাসন নানা দিকে নানাভাবে অব্যাহত রয়েছে। আজ অপারেশন উত্তরণের নামে বাংলাদেশে যে সামরিক শাসন তথা পার্বত্য অঞ্চলে আদিবাসী ও জুম্ম জাতি অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার ষড়যন্ত্র আজকে অব্যাহত রয়েছে। সমতলে যে আদিবাসীরা আছে তাদের সমস্যা সমাধানে সরকার কোনভাবে আন্তরিক নয়।’

তিনি বলেন, ‘এই সরকারের কাছে আমি প্রশ্ন রেখে যেতে চাই । আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫১ বছর হতে চলেছে। বিগত সময়ে আদিবাসীদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন, দমন অব্যাহত রয়েছে । ভূমি হারানোর যন্ত্রণা যিনি ভূমি হারিয়েছেন তিনিই বুঝবেন। যার পরিবারে আপনজন নানাভাবে আঘাত পেয়েছে, জীবন হারিয়েছে তারা বুঝবে স্বজন হারার যন্ত্রণা। আজকে বাংলাদেশের এমন কোন আদিবাসী পরিবার নাই যে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি, নির্যাতিত হননি । শোষণ সামগ্রিক পারিবারিক জীবন নির্যাতিত হয়নি। আজকে সরকার উন্নয়নের কথা বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কথা বলেন। কিন্তু সে উন্নয়ন কাদের জন্য সেটা গভীরে গিয়ে ভাবলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।’

পার্বত্য অঞ্চলে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কে সন্তু লারমা বলেন, ‘আজকে পার্বত্য অঞ্চলে যে উন্নয়নের কথা বলা হয়, সেখানে করা হচ্ছে রাস্তাঘাট, রাস্তাগুলো করা হচ্ছে সামরিক স্বার্থ পরিপূর্ণের জন্য। উন্নয়নমূলক কার্যক্রম আদিবাসীদের ভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তির জন্য উন্নয়ন।’

এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, সমাজ সংরক্ষণ ও সভ্যতার বিকাশে নারীর যে অবদান, নারীর যে ভূমিকা তাদের প্রাধান্য দিয়ে সে জাতিসংঘের প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আমরা আদিবাসী দিবস পালন শুরু করেছি।

জাতিসংঘের আদিবাসী দিবস পালন করার সূত্র ধরে তিনি বলেন, ‘ আমি বলতে চাই আজকে বাংলাদেশে আদিবাসী নারী সমাজ শাসকগোষ্ঠী অপশাসনে অগণতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক , দুর্নীতিগ্রস্ত কার্যক্রমের কারণে আজকে নারীসমাজ বঞ্চিত হচ্ছে। সেই বিষয়টি আমি মনে করি গভীরভাবে ভাবা দরকার ।’

‘বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে এটাই বলতে চাই বাংলাদেশের যে ৩০ লাখ আদিবাসীকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা আদিবাসী সমাজের মানুষের সাথে এদেশের শাসকগোষ্ঠী যে প্রতারণা করে চলেছে। আদিবাসীদের অস্তিত্ব বিলুপ্তির ষড়যন্ত্র চলছে। আজকে বাংলাদেশে বসবাসরত আদিবাসীদের দেখলেই তা বোঝা যায়। তাই আজকে এই ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য আমরা অনেক লড়াই সংগ্রাম করে আসছি। কিন্তু আজকে এই পর্যন্ত আমরা যা প্রত্যক্ষ করেছি সরকার আদিবাসীদের শুধু অস্তিত্ব বিলুপ্ত করা নয় তাদের সমস্ত কিছু হরণ করে এবং সর্বশান্ত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে আদিবাসীদের অপসারণ করতে চায় ।’

এসময় তিনি বলেন, ‘আজকে এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পক্ষ থেকে আহ্বান জানাই, আসুন আমরা আবার নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আদিবাসীদের অধিকার স্বাধীকার লড়াইকে উজ্জীবিত করে নারীর যে অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বিশ্বের দরবারে সমুন্নত করে তুলি। আজকে অপেক্ষমান তরুণদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আমরা বয়সে প্রবীণ হয়ে গিয়েছি। আমি মনে করি বিগত ৫০ বছর ধরে আদিবাসী সমাজ লড়াই সংগ্রাম করছে, কিন্তু বাস্তবে এই আদিবাসী সমাজ কোন অধিকার তারা পায়নি। দিনে দিনে আদিবাসীদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই আজকে প্রবীনেরা যে কাজটি অসমাপ্ত রেখে বিদায় নিচ্ছে অথবা অসম্পূর্ণ কাজটি আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সংগ্রামের দায়িত্ব তাদের কাঁধে তুলে নিতে হবে।’

আজ সকাল ১১টায় বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে সমাবেশের উদ্বোধন করেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলেন, ‘দিন যায়, রাত যায়, বছর যায়, ফিরে আসে ৯ আগস্ট আজর্ন্তজাতিক আদিবাসী দিবস । সেই কবে শান্তি চুক্তি সম্পাদন হয়েছে পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলে শান্তি চুক্তির যে একটা পরিণাম দেখতে চেয়েছিলাম সেটা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। পার্বত্য চট্রগ্রাম থেকে শুরু করে সমতলের আদিবাসী বন্ধুদের যে হত্যা করা হয়েছে তার সমাধান, বিচার কেউ পায়নি। ১৯৭০ সালে যখন আমরা ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা যেতে পারিনি তখন অস্ত্র তুলে নিয়েছি তখন একটা সমাধানের পথ পেয়েছি। এই মধুপুরে কত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। আল ফ্রেড সরেনের তো কোন বিচার হয়নি। তাহলে কি শুধু সাহিত্যে আন্দোলনে আমাদের আদিবাসীর থাকবে। নাকি তারা সমাজ থেকে সুবিচার পাবেন। রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবে। বছর যাচ্ছে প্রতি বছর এই আগস্ট মাসে আমরা একত্রিত হচ্ছি । আর ফিরে যাচ্ছি । এটা অনেকটা একুশে ফেব্রুয়ারির মতো। যে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলা ভাষার প্রতি দরদ আমাদের মাথায় চেপে বসে ২১ ফেব্রুয়ারি খুব ব্যস্ত থাকি । একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে আমরা ঘুম দিই আর পরের বছর ২০ ফেব্রুয়ারি আমরা জাগি। আমাদের শহিদ মিনারে আদিবাসীরা উপস্থিত হয়েছেন একটা আশায় বুক বেঁধে যে, ৩৬৫ দিন পরে আমাদের স্বপ্নগুলো কিছুটা বাস্তবায়ন হবে।’

‘পাওয়াতো দূরের কথা আদিবাসী দিবসে দুইদিন আগে আদিবাসী বলা যাবেনা বলে ফরমান জারি হলো। এই ফরমানগুলো জারি করে কারা সেটা আমরা সবাই জানি। আমি বলি এটা লুণ্ঠন প্রক্রিয়া । আজকে যে মেজবাহ কামাল বললেন সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে, হিন্দু, আদিবাসীদরে সংখ্যা কমছে, কমছে না তারা লুণ্ঠিত হয়েছে। তারা এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। পার্বত্য চট্রগ্রামে জিয়াউর রহমান যেভা্বে পুস করে দিয়েছিলো সেটা একই ব্যাপার।’

‘সংঙ্ঘবদ্ধ লুণ্ঠনের কাজটা তোমরা করো। সেই লাইসেন্স দিয়ে তাদেরকে পার্বত্য চট্রগ্রামে যেন চিরতরে একটা অশান্তি সৃষ্টি হয় সেই ব্যবস্থা তিনি করে দিয়েছেন। এবারের যে প্রতিপাদ্য বিষয় আদিবাসী নারীদের যে ঐতিহ্যগতভাবে মূল্যবোধকে রক্ষা করা। আদিবাসীদের কাছ থেকে আমরা শিক্ষককে শ্রদ্ধা করতে শিখতাম, গুরু জনকে শ্রদ্ধা করতে শিখতাম, আদিবাসীদরে কাছ থেকে শিখতে পারতাম প্রকৃতিকে কীভাবে লালন পালন করা যায়।কীভাবে একটা গাছ মানুষের মতো হয়ে পড়ে। আদিবাসী মায়ের কাছ থেকে আমরা সন্তান লালন-পালন করা শিখেছি। আমরা আদিবাসীদের কাছ থেকে শিখতে পারতাম সারল্য কাকে বলে। সারল্য মানুষে কীভাবে মহৎ করে।’

সন্তু লারমা আছেন, বহু বছর পরে তাকে দেখছি তার সারল্যের কোন তারতম্য হয়নি। সাধারণ মানুষের সাথে তার ব্যবহারের তারতম্য হয়নি। এগুলো কিন্তু আমরা শিখতে পারতাম । আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জীবন যে পালন করে আসছে তাদের কাছে আমরা শিখতে পারতাম। সেই শিক্ষা থেকে আমরা আমাদের জাতিকে বঞ্চিত করেছি। আদিবাসীদের কাছে থেকে আমরা সংগ্রাম শিখতে পারতাম, আদিবাসীরা লড়াই করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে আমরা একটা দেশে পেয়েছিলাম। সেই দেশটাকে আমরা কীভাবে দুঃশাসন করে আমরা আজকে বালুচরে এসে ঠেকেছি। আমরা এই সবই শিখতে পারতাম আদিবাসীদের কাছ থেকে। আমরা যে শিখিনি তার মূল্য দিতে হবে যত দিন বেঁচে থাকবে ততোদিন।

‘জাতীয় আদিবাসী নারী পরিষদে’র সভাপতি বাসন্তী মুর্মু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রতিনিধি হিসেবে জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ২ জন সংসদ সদস্য মনোনয়নের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন একজন সাঁওতাল নারী। আর বাংলাদেশে সংসদে বসে আমাদের নির্যাতনের কথা বলবে এমন কেউ নেই।’

তিনি বলেন, ‘আজকের নারীদের বিষয়ে অনেক বলা হয়েছে সেদিকেই আমি বলি, নারীরা আমরা সন্তান জন্ম দেই, দেশও চালাই। তবে আমি মনে করি আমরা নারীরা সম্মান পাইনা, আমাদেরকে নির্যাতন করা হয় পরিবারে এমনকি পরিবারের বাইরেও। নারীরা এখন সবরকমের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। শুধু সমাজ নয়, সংসার নয়, আমাদের অধিকার কী সেটা আমি বুঝি, একই সাথে সারা বিশ্বের সকল নারীরা তাদের অধিকার বুঝে, আমরা নারীরা অধিকার থেকে বঞ্চিত। আমরা সেগুলো নিয়ে কাজ করছি। আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। তখন আমরা সেসকল সমস্যা থেকে সুরক্ষা কীভাবে পাব তার জন্য আছে নারীদের বিভিন্ন সংগঠন, আমাদের অসুবিধা সেসকল সংগঠনকে জানাব।’

তিনি বলেন, ‘আজ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস, আজ আমি আমাদের কথা বলছি। আজ আমাদের নারীদের অধিকার নেই। কেবল গারোদের ছাড়া ভূমিতে কারো অধিকার নেই, তাই আজ আামি জোর গলায় বলতে চাই আমাদের নারীদের যেন ভূমিতে অধিকার দেয়া হয়। আমাদের সমতলে ২টি আসন দাবি করছি। কারণ পাশের দেশে সাঁওতাল বাসীকে রাষ্ট্রপতি করা হয়েছে। আর আমাদের সংসদে নারীদের নানান কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে আমাদের নিয়ে বলার কেউ নাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে নারীরা অনেক সুশিক্ষিত হয়েছে, তাদেরকে সংরক্ষিত আসন দেয়া হোক। সারাদেশে ভূমি যে আমরা হারাচ্ছি তার বিচার পাচ্ছি না। আমরা যেখানে ছিলাম সেটা আদিবাসী। আজ আমরা একত্রিত হয়েছি বলে দাবি উত্থাপন করতে পারছি, অন্য সময় পারি না। নারীসমাজ ছাড়া সংসার ও পরিবার চলতে পারে না। নারী হয়ে এতটুকুই বলতে চাই। শেষে তিনি সাঁওতাল ভাষায় তার ২ লাইন গান গেয়ে শুনান।’

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, ‘সারাদেশ থেকে আদিবাসীরা স্বত:স্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করলেও এবারের আয়োজনে বিশেষ কিছু সংযোজন করা হয় নি। আদিবাসীরা তাদের অস্তিত্বের জন্য কীভাবে উন্মুখ হয়ে আছেন এটা তারই প্রমাণ। তারপরেও যদি কেউ বলতে চান, এদেশে আদিবাসী নাই তাহলে তারা বাস্তবতা থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছেন। যখন বাস্তবতার সাথে সরকারের বা সরকারের নীতিনির্ধারকদের যখন দূরত্ব বাড়ে তখন প্রমাণিত হয় যে, তারা জনগণের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। সেটা সরকার ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়।’
‘আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম এখানে একটা পতাকা বহন করে এনেছে তার প্রতি। যে পতাকাটা হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পতাকা। এটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। উপনিবেশবিরোধী যে সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও লড়াই, সেই ফলশ্রুতি হচ্ছে আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা। সেই স্বাধীনতার প্রথম সারিতে ছিলেন আদিবাসীরা। ইতিহাসের ন্যূনতম জ্ঞান যদি থেকে থাকে তাহলে তিনি সেটা জানবেন।’

সাঁওতাল বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলনে আদিবাসীদের অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমার মনে পড়ছে ১৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে রাজশাহী থেকে বিজয়ী সাদারাম মাঝির কথা । যিনি আদিবাসীদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। একাত্তরের যুদ্ধে গোটা উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদেরকে মুক্তিযুদ্ধে সমাবেশিতের কাজে লিপ্ত ছিলেন। এদেশের স্বাধীনতা বাঙালি ও আদিবাসীদের মাধ্যমে অর্জিত। আমাদের যে রক্তলাল পতাকা, সেই রক্তলাল পতাকায় কেবল বাঙালির রক্ত নয়, সেখানে আদিবাসীদের রক্ত মিশে আছে । এই রক্তের স্বীকৃতি দিতে হবে! না হলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার যে অস্তিত্ব, তার যে অস্তিত্বের সংগ্রাম, তার যে ঐতিহাসিক অনিবার্য সত্য তাকে অস্বীকার করবে।’

লোকগণনার একটা রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়ায় তিনি পরিকল্পনামন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এবারের সেন্সাসে আদিবাসী জাতিসমূহের আদিবাসী নামে না হলেও আলাদা জাতিসত্ত্বা হিসেবে বাংলাদেশ সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে।

শেষে তিনি জনশুমারির সমালোচনা করে বলেন, ‘আদিবাসীর যে সংখ্যাটা আসছে তা কিন্তু আগের চেয়ে কমে গেছে বলে মনে হচ্ছে। মানে সামগ্রিকভাবে কয়েক হাজার বাড়লেও তা বাস্তবসত্যের অনুকূলে নয়। ভারতে কোটির মত সাঁওতাল হলে আমাদের অন্তত ১০ লাখ হবে। ১৯৯১ সালে আড়াই লাখ দেখানো হয়েছিল কিন্তু বর্তমানে তা ১ লাখ ১৫ হাজার দেখানো হলো, তা কেমন সেন্সাস? তিনি একটা বিশেষ সেন্সাসেরও দাবি জানান। একই সাথে তিনি শান্তিচুক্তিকামীদের বন্ধু উল্লেখ করে বলেন, বন্ধু চিনতে শিখুন, বন্ধুকে শত্রু মনে করবেন না। অনেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে যুদ্ধের দামামা বাজানোর চেষ্টা করছে। সেগুলো রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করুন। জমি ও ভূমি কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন করুন।’

সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, মানবাধিকারকর্মী খুশি কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবায়দা নাসরিন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) শরীফ জামিল প্রমুখ।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যময় দেশ—এটা বলতে আমরা খুব পছন্দ করি, সব জায়গায় প্রচার করি। কিন্তু সেই বৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য আমরা কী করি তা চিন্তা করা দরকার। আদিবাসীরা বলছেন, প্রত্যেকটি জায়গায় তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তাদের অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এটা কী আমাদের শোভা পায়? আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম একটি বৈষম্যবিহীন রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ে তুলতে। অথচ, আজ দেশে প্রতিটি স্তরে বৈষম্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা দেখতে পেয়েছি জঘন্যতম হামলা হয়েছে আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপরে এবং এটা ধারাবাহিকভাবে চলছে। একটি স্বাধীন দেশে এটা কেন হবে? আমাদের সংবিধান পরিষ্কার বলে দিয়েছে, সকলের অধিকার সমান এবং রাষ্ট্রের দায়িত্ব সকলের নিরাপত্তা রক্ষা করা। সমতল ও পাহাড়ে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘন হচ্ছে।’

‘রাষ্ট্রের অবশ্যই দায়িত্ব আছে। সেইসঙ্গে আমরা যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আছি তারাও কেন তাদের পাশে দাঁড়াই না, তাদের সঙ্গে কথা বলি না। আমরা সবাই একসঙ্গে সবার অধিকার রক্ষা করব। নারীদের নিরাপত্তা দিতে হবে ঘরে এবং বাইরে। আজকের যে প্রতিপাদ্য বিষয় তা দীর্ঘদিন পরে হলেও সামনে এসেছে। আমাদের নারী, যারা গৃহস্থালির কাজ করেন তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। আমরা অনেক দিন ধরে এর জন্য দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ, তারাই সমাজকে ধরে রাখে, গ্রামীণ অর্থনীতিও তাদের ওপর নির্ভর করে,’ যোগ করেন তিনি।

Exit mobile version