parbattanews

আদিবাসী বা নৃতাত্ত্বিক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বিতর্ক

gen. ibrahim

মে. জে. (অব:) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক

 

একটি দেশে কত মানুষ বাস করে, তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কী, তাদের অভ্যাস কী, তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান কী ধরনের প্রভৃতি প্রশ্নের উত্তর সচরাচর সহজে পাওয়া যায় না। সব মানুষ জানতেও চায় না। এটি শুধুু বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়, অনেক দেশের জন্যই প্রযোজ্য। এ বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘এনথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)’ ১৯৮৫ সালের ২ অক্টোবর একটি প্রকল্প চালু করে। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল, ভারতে বসবাসরত সব ধরনের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক ও আর্থসামাজিক, সম্ভব হলে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বর্ণনা করা। এএসআই প্রাথমিক পর্যায়ে ছোট-বড় ছয় হাজার ৭৪৮টি জনগোষ্ঠী বা কমিউনিটির নাম তালিকাভুক্ত করলেও সঠিকভাবে চিহ্নিত ও পর্যবেণের বস্তু করতে পারে মাত্র চার হাজার ৬৩৫টি, যেগুলো ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ ও ইউনিয়ন টেরিটরিতে বিন্যস্ত ছিল। এ প্রকল্পের অন্যান্য বিশদ বিবরণ এখানে লিপিবদ্ধ করছি না। এ প্রকল্পের নাম ছিল ‘পিপল অব ইন্ডিয়া প্রজেক্ট’। এ প্রজেক্টের ফল জনগণের উপকারে উপস্থাপন করা হয়। উপস্থাপনের দু’টি মাধ্যম ছিল। প্রথমটি হলো ১০ খণ্ডের জাতীয় সিরিজ। দ্বিতীয়টি প্রদেশ বা ইউনিয়ন টেরিটরি-ভিত্তিক।
 
দ্বিতীয় মাধ্যমটির আওতায় অনেক খণ্ড বই প্রকাশ করা হয়েছে। আমি মাত্র কয়েকটির নাম উল্লেখ করছি যথাক্রমে খণ্ড ও এলাকার নাম নিয়ে। ভলিউম-১৪ : অরুণাচল প্রদেশ, ভলিউম-১৫ : আসাম, ভলিউম-৩১ : মনিপুর, ভলিউম-৩২ : মেঘালয়, ভলিউম-৩৩ : মিজোরাম, ভলিউম-৩৪ : নাগাল্যান্ড, ভলিউম-৩৯ : ত্রিপুরা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করলেও আমি মাত্র সাতটি খণ্ডের উল্লেখ করছি। এসব বই আমার নিজস্ব ব্যক্তিগত সংগ্রহেও আছে। নাম উল্লিখিত এ সাতটি অঞ্চল হচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্রের, সাতটি আলাদা প্রদেশ বা রাজ্য। এসব প্রদেশ বা রাজ্য বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত। ভারত নামের বৃহৎ রাষ্ট্রে দুই ডজনের বেশি রাজ্য বা প্রদেশ আছে। এর মধ্যে যে সাতটি উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত সেগুলোকে সম্মিলিতভাবে অনানুষ্ঠানিক পরিচয়ে ‘সাত বোন’ বা ‘সেভেন সিস্টারস’ বলা হয়। আমি কেন শুধু এ সেভেন সিস্টারসের উদাহরণই দিলাম, সেটি প্রণিধানযোগ্য। এ সাতটি রাজ্যে যে ধরনের মানুষ বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে, তাদের সাথে কিছু না কিছু মিল আছে এমন কিছু মানুষ বা নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশেও বসবাস করে। বাংলাদেশের দণি-পূর্বাংশের সেই এলাকার প্রচলিত নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলার পাহাড়ি বা পার্বত্য অংশকে আলাদা একটি জেলার মর্যাদা দেয়া হয়েছিল এবং নাম দেয়া হয়েছিল ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’। তখন যেমন এখনো তেমন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম হচ্ছে চট্টগ্রাম জেলার পূর্ব দিকে। ১৯৮৪ সালে যখন তৎকালীন বাংলাদেশের সব মহকুমাকে প্রশাসনিকভাবে জেলাপর্যায়ে উন্নীত করা হয়, তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটি মহকুমা, খাগড়াছড়ি মহকুমা ও বান্দরবান মহকুমা তিনটি স্বতন্ত্র জেলায় পরিণত হয়। এখন ওপরে বর্ণিত ভারতীয় পরিপ্রেেিতর আলোকে, বাংলাদেশের পরিপ্রেতিটি অতি সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। আমি সংশ্লিষ্ট বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে উদ্বৃত করছি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ‘বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষা’ নামে তিন বছর মেয়াদি একটি গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের সংস্কৃতির নানা দিক নিয়ে একটি জরিপভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করা এবং গবেষণাগুলো সিরিজ আকারে প্রকাশ করা। এমন মনে করার কারণ রয়েছে যে, অনেক পরিবর্তন ও সংযোজনের পরও বাঙালি সংস্কৃতির অনেক উপাদান এখনো পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। বর্তমান গবেষণার মাধ্যমে সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমানকে জরিপ করে একটি মাইলফলক নির্মাণ করা দরকার, যা হবে ভবিষ্যতের সংস্কৃতি গবেষণার দিকনির্দেশক। সংস্কৃতির যেসব ত্রে আমরা বর্তমান সমীামালায় অন্তর্ভুক্ত করেছি, সেগুলো হলো ১. প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য, ২. স্থাপত্য, ৩. রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি, ৪. সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ৫. আদিবাসী জনগোষ্ঠী…। আমরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিয়ে পরবর্তী অনুচ্ছেদে আলোচনা করছি। এশিয়াটিক সোসাইটির আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় ভলিউম-৫ প্রকাশিত হয়েছে, যার শিরোনাম ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী’। এ ভলিউমের সম্পাদক হচ্ছেন তিনজন বিদগ্ধ ব্যক্তি যথা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহিদুল ইসলাম এবং রাঙ্গামাটিতে অবস্থিত উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক সুগত চাকমা। এ বইটি অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ, যদিও বিভিন্ন স্থানে প্রদত্ত মতামত বা মূল্যায়নের সাথে পাঠক দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। আলোচ্য পঞ্চম ভলিউমটি আমার সংগ্রহে আছে। এ ভলিউম মতে, বাংলাদেশের তিনটি অঞ্চলে বাঙালি ছাড়া অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে। এ ভলিউম মতে (যদিও আমি দ্বিমত পোষণ করি) তারা আদিবাসী জনগোষ্ঠী। এর মতে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে ১২টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং ময়মনসিংহ-সিলেট অঞ্চলে বসবাস করে ১৮টি আদিবাসী জনগোষ্ঠী। আমি আদিবাসী শব্দটির সাথে একমত নই। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো সবচেয়ে বেশি ঘনীভূত পার্বত্য চট্টগ্রামে। কারো মতে ১২টি আবার কারো মতে ১৩টি ুদ্র জাতিসত্তা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে চাকমা জনগোষ্ঠী। আলোচনার সুবিধার্থে আমি এ কলামে বা পরবর্তী কলামগুলোয় চাকমা জনগোষ্ঠীকে উপজাতি বলে সম্বোধন করব। আদপে এরা উপজাতি না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী না ক্ষুদ্র জাতিসত্তা না আদিবাসী- এ বিতর্কে আমি এখানে যাবো না। প্রশ্ন থেকে যায়, যে পরিচয়েই হোক না কেন, এরা বাংলাদেশের নাগরিক তো বটেই। অতএব তাদের পরিচয় প্রয়োজন। তাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয় সব মিলিয়েই তাদের আমরা চিনব। আমার জানা মতে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি হলো ত্রিপুরা উপজাতি এবং তৃতীয় বৃহত্তম মারমা। অন্যান্য উপজাতির জনসংখ্যা আসলেই খুব কম। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলোর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগের অর্ধেক তথা ০.৫ শতাংশ। এ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত উপজাতীয় জনগোষ্ঠী এ ভূমিতে কবে এসেছে, তার সঠিক তারিখ এবং কার আগে কে এসেছে সেই ক্রম নিয়ে আমি এখানে আলোচনা করছি না। এ অনুচ্ছেদ শেষ করব এটুকু বলেই যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নেতা-সম্প্রদায়ের একটি অংশ দাবি করে যে তারাই সবচেয়ে পুরনো অধিবাসী বা আদিবাসী; অপরপক্ষে বাংলাদেশের পণ্ডিত সমাজের একটি বড় অংশ দাবি করে যে তারা কোনো অবস্থায়ই সবচেয়ে পুরনো অধিবাসী নয়, অতএব আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য নয়।
 
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া ইংরেজ সরকারের শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল তৎকালীন ভারত উপমহাদেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোকে করতলগত করা। যেটি বর্তমান ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ বা উত্তর-পশ্চিম অংশ, সেগুলো আজ থেকে ১০০ বা ১৫০ বছর আগে ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের প্রান্তিক অঞ্চল। আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত বর্তমানের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মিলিতভাবেই প্রান্তিক অঞ্চল ছিল। আজ ১৫৩ বছর আগের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের নামের প্রান্তিক অঞ্চলের ওপর নিজেদের শাসন পাকাপোক্ত করার জন্য ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার পার্বত্যাঞ্চলকে আলাদা করে একটি নতুন জেলার সৃষ্টি করা হয়েছিল। ১৮৬০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামে ছোটখাটো অনেক প্রশাসনিক সংস্কার হলেও সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক সংস্কার হয় ১৯০০ সালে।
 
ভারতবাসীর মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরাও ব্রিটিশ শাসনের অধীনে প্রজা ছিল। কিন্তু এরা নিজেদের উপজাতীয় পরিচয়েই উপস্থাপন করত। যেমন- চাকমারা চাকমা, মারমারা মারমা, তংচইঙ্গারা তংচইঙ্গা প্রভৃতি হিসেবেই পরিচিত ছিল। তখনকার দিনে পুরো ভারত উপমহাদেশে একটি জাতীয় পরিচয়ের চেতনামাত্র অঙ্কুরোদগম হয়েছিল। সর্বভারতীয় কোনো জাতীয় পরিচয় তখনো সুস্পষ্টভাবে দানা বাঁধেনি। বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বা প্রদেশ ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশ ও বাংলাদেশ- পুরোটাই একটি প্রদেশ ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদও তখন কঠোরভাবে প্রচারিত বা উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেনি। অতএব কোন প্রক্রিয়ার বা ইতিহাসের কোন পর্যায়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সুসংহত হলো এবং কী কারণে বর্তমান বাংলাদেশের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নটি নতুনভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, সেটি অবশ্যই আলোচনাযোগ্য। ওই আলোচনার ধারাবাহিকতায়ই যথাসম্ভব স্পষ্ট হবে আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের বক্তব্য এবং বর্তমান উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর বক্তব্যের পারস্পরিক সম্পৃক্ততা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের সৃষ্টি। এর আগে এক বা দুই বা তিন দশক রাজনৈতিক আন্দোলন চলে। সেই আন্দোলন পরিশীলিত হতে হতে ১৯৪০ সালে এসে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে ঘনীভূত হয়েছিল। সেই ১৯৪০ সালের দশকের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় নেতারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নামের ভূখণ্ড পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্ত না হয়। তাদের আন্দোলন বা চেষ্টা বিফল হয়। প্রতিবাদে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ তারিখে এরা তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক সদর রাঙ্গামাটি শহরে এবং অন্যান্য জায়গায় ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করে। এর পরিপ্রেক্ষিত পাকিস্তান নামের রাষ্ট্র তাদের প্রথম দিকে সুনজরে দেখেনি, কিন্তু পরে আস্তে আস্তে সুনজরে দেখা শুরু করে।
 
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশির ভাগ নেতা হয় প্রত্যভাবে পাকিস্তানের প নেন অথবা নীরব থেকে পাকিস্তানকে পরো সমর্থন দেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনজন সার্কেল-চিফ থাকেন বা আছেন, যথা- রাঙ্গামাটির চাকমা চিফ বা চাকমা রাজা, বান্দরবানের বোমাং চিফ বা বোমাং রাজা এবং খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলায় অবস্থিত মং চিফ বা মং রাজা।
উল্লেখ্য, এই স্থলে রাজার ইংরেজি অনুবাদ কিং হবে না, কারণ রাজা শব্দটি ব্রিটিশদের দেয়া টাইটেল। আজকের বাংলাদেশের চাকমা সার্কেল চিফ সম্মানিত ব্যারিস্টার দেবাশিস রায়ের সম্মানিত বাবা, তৎকালীন চাকমা চিফ বা রাজা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনারারি মেজর রাজা ত্রিদিব রায় এবং তৎকালীন বান্দরবানের বোমাং চিফ বা রাজা উভয়েই ঘোরতরভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন এবং সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। চিফ মহোদয়গণের নেতৃত্বে বহু উপজাতীয় ব্যক্তি অস্ত্রধারী বা অস্ত্রবিহীন রাজাকার অথবা পাকিস্তানপন্থী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে বিজয় অর্জনের পর বোমাং চিফ পরিস্থিতি বুঝে পরিস্থিতির সাথে খাপ খেয়ে ভালো-মন্দ সংশোধন করে বাংলাদেশে থেকে যান। কিন্তু চাকমা চিফ মহোদয় পাকিস্তানে চলে যান (অন্যান্য আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ পাকিস্তানপন্থী নেতার মতো)। তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন এবং আজীবন পাকিস্তানে থেকে কিছু দিন আগে সেখানে মারা যান এবং সেখানেই সমাহিত হন।
 
১৯৭২-৭৩-৭৪-এর বাংলাদেশ সরকার চাকমা উপজাতিকে কেন অতি আপন করে নিতে পারেনি তার দীর্ঘ প্রেক্ষাপট সংক্ষিপ্ত কয়েকটি বাক্যে বর্ণনা করলাম। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগণ প্রকাশ্যে যেমন দাবিদাওয়া উপস্থাপন করেন এবং তার জন্য আন্দোলন করেন, অপ্রকাশ্য তথা গোপনেও দাবিদাওয়া অর্জনের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
তরুণ পাঠকেরা খেয়াল করবেন, ওই সময় ছিল বাংলাদেশের প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের আমল এবং বঙ্গবন্ধুর আমল। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু নিহত হন। বিশ্লেষকদের মতে, তাদের উত্থাপিত দাবির প্রতি বঙ্গবন্ধুর সমর্থন না পেয়ে, ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর গোপন সংগঠন জনসংহতি সমিতি তথা তাদের সশস্ত্র শাখা ‘শান্তিবাহিনী’ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করে। যুদ্ধের কারণ বঙ্গবন্ধুর আমলে ও পাকিস্তান আমলে নিহিত। কিন্তু যুদ্ধ মোকাবেলা করার জন্য প্রথম দায়িত্ব পড়ে যায় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম ও তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ওপর। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভৃতি অনেক আঙ্গিকে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নপ্রক্রিয়া চালু করতে এবং বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে। তিনি আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর প্রতি, কিন্তু তারা আসেনি।
 
বিদ্রোহী গোষ্ঠী ছিল সরাসরি ভারত সমর্থিত ও সাহায্যকৃত। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ছিল কমিউনিস্ট মতাবলম্বী, যারা দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামে বিশ্বাস করত। উদ্দেশ্য ছিল, দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে নিয়ে একটি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে অভিজাততন্ত্র বা ইংরেজিতে ফিউডালিজম থাকবে না। যা হোক, অনেক দীর্ঘ ইতিহাস এ কলামে বলা সম্ভব নয়। আগ্রহী পাঠক বাজারে অনেক বই থেকে বেছে বেছে দুই একটি পড়তে পারেন। একটি প্রামাণ্য বই আমি নিজেই লিখেছি যেটির নাম ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিপ্রক্রিয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতির মূল্যায়ন’। যেকোনো আগ্রহী সচেতন গবেষক অথবা জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তির জন্য বইটি পড়া উপকারী বলে আমি বিশ্বাস করি। আমি যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্তাক্ত সঙ্ঘাতময় ও সঙ্কটকালীন একটি সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি এবং জীবন বাজি রেখে, সহকর্মীদের সহযোগিতা নিয়ে শান্তিপ্রক্রিয়ায় বীজ বপন করেছি নিজ হাতে, তাই আমি ওই বইয়ে নিরেট নিরস ইতিহাস বলার সুযোগ পেয়েছি।
 
রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও তার সরকার শান্তিপ্রক্রিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ও স্বীকৃত পৃষ্ঠপোষক। বিদ্রোহী উপজাতীয় সংগঠন তাদের লক্ষ্যবস্তু অর্জনে ব্যর্থ হয় অনেক কারণে। একটি কারণ হলো, বাংলাদেশ সরকারের সামরিক চাপ। আরেকটি কারণ হলো, বাংলাদেশ সরকারের সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক পুঁজি বিনিয়োগ। ১৯৭৮-৭৯-৮০ সালে তৎকালীন সরকার অনুমতি দিয়েছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটিতে, অন্যান্য জেলা থেকে আসা দুস্থ, ভূমিহীন অসহায় বাঙালিদের বসতি স্থাপনের অনুমতি দিতে। বাঙালিরা বসতি স্থাপন করেন। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে শ্রম দেন এবং অসহযোগী উপজাতীয় মানুষের বিপরীতে সরকারকে ও সরকারের কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করেন। হাজার হাজার বাঙালি শান্তিবাহিনীর আক্রমণে নিহত হন। বাঙালিদের সাথে সাধারণ উপজাতীয়দের বিবাদে বা দাঙ্গায় বাঙালি ও উপজাতি উভয় ধরনের মানুষ প্রচুর হতাহত হন। চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী সমঝোতা ও শান্তির পথ ধরতে বাধ্য হয়। ১৯৮৮-৮৯ সালে এক ধরনের সমঝোতা চুক্তি সম্পাদিত ও আইন পাস হয়। এটিকে ভিত্তি ধরে ১৯৯৭ সালে বর্ধিত ও সম্প্রসারিতভাবে চুক্তি ও আইন পাস হয়।
 
আজ ১৩ বছরের অধিক বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতারা নির্বাচনবিহীনভাবে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের ওপরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ষড়যন্ত্রের শেষ হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার আবর্তে নিমজ্জিত। গত সাত মাসে দু’বার খাগড়াছড়ি ও একবার রাঙ্গামাটি সফর করার সুযোগ হয়েছে। ঢাকা বা চট্টগ্রাম মহানগরে বসে যতটুকু অনুভব করি, তার সাথে যুক্ত হয়েছে সরেজমিন সফরের আলোকে অর্জিত অভিজ্ঞতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের এ মুহূর্তের যেই দু’টি বড় সমস্যাকে ঘিরে তর্কবিতর্ক হচ্ছে তথা টেলিভিশন টকশো, পত্রিকার কলাম লেখা, গোলটেবিল বৈঠক প্রভৃতি হচ্ছে এবং আন্দোলন, অবরোধ, হরতাল প্রভৃতি হচ্ছে সেই দু’টি সমস্যা হচ্ছে ১. ভূমিসংক্রান্ত তথা ভূমির মালিকানাসংক্রান্ত। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানায় স্থানীয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর অবস্থান কী, স্থানীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর অবস্থান কী এবং বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কী, ২. পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছুসংখ্যক উপজাতীয় নেতার দাবি হচ্ছে ‘তাদেরকে আদিবাসী ঘোষণা করা হোক’।
 
আদিবাসী ঘোষণার যে প্রেক্ষাপট দীর্ঘ তা এ কলামে আজ বর্ণনা করতে পারছি না। আদিবাসী ঘোষণা হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর যেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য, সেসব আঙ্গিক দেশপ্রেমিক জনগণের সামনে পর্যাপ্তভাবে উপস্থাপিত হয় না। ৩. ওপরের ভূমি ও আদিবাসীসংক্রান্ত সমস্যার সাথে অবিচ্ছেদ্য উপাত্ত হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগণ থাকবে কি থাকবে না অথবা অন্য ভাষায় থাকতে পারবে কি থাকতে পারবে না। এ অনুচ্ছেদে আমার শব্দবিন্যাস কঠোর হলে আমি দুঃখিত, কিন্তু এসব আঙ্গিক যেকোনো নিয়মেই সচেতন নাগরিকের সামনে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। আগামী ৮ বা ৯ আগস্ট হচ্ছে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। কিন্তু সেই সময় বাংলাদেশে ঈদের ছুটি থাকবে। তাই যারা আদিবাসী ঘোষণার পক্ষে তারাও আগেভাগেই আলোচনা শুরু করবেন বা সেরে ফেলবেন। আর যারা আদিবাসী ঘোষণার বিপক্ষে তারা কম সুসংগঠিত বিধায় কখন আলাপ-আলোচনা করবেন বা না করবেন তা বুঝতে পারছি না। আজ এ কলামে সূচনা বক্তব্য রাখলাম। আজ থেকে ৬ বা ৭ দিন পর এই পত্রিকায়ই আমার নিয়মিত কলামে ভূমি সমস্যা ও আদিবাসী সমস্যার পক্ষে বিপক্ষের আঙ্গিকগুলো তুলে ধরার আশা রাখি।
 
আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্যই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আঙ্গিকে ভূমি সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার স্বার্থে, পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয় বা ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে ঘোষণার বিপক্ষে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রস্ফুটিত হওয়ার স্বার্থে, ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা অধিকতর লালিত ও পালিত হওয়ার স্বার্থে এবং জনগণের জানার অধিকারকে সম্মান জানানোর স্বার্থে, এই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিকে ব্যাপক আলোচনা জাতীয় ভিত্তিতেই প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নয়া দিগন্ত পত্রিকা তার ভূমিকাটি রাখছে। অন্যরাও কম বা বেশি রাখছে। প্রত্যেককে যথোপযুক্ত অভিনন্দন ও ধন্যবাদ। সম্মানিত পাঠকদের অগ্রিম ঈদের শুভেচ্ছা।
লেখক: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি,
www.generalibrahim.com
 
Exit mobile version