আদিবাসী স্বীকৃতি দাবির অতি সম্ভাব্য ও ধারাবাহিক ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া

fec-image

স্বাধীনতার অল্পকাল পর থেকেই সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র সংগঠনগুলোর বৃহৎ অংশ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিজেএসএস) এর সাথে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। সুদীর্ঘ আলোচনার পর পিজেএসএস ‘উপজাতি’ পরিচয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তিতে পিজেএসএসের জন্য মূলতঃ শর্ত ছিলো ১টি, অস্ত্র পরিত্যাগ করে শান্তির পথে ফিরে আসা। ওরা কথা রাখেনি! ২০১১ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির সাথে সাক্ষাৎকারে সন্তু লারমা স্বীকার করেছেন, সশস্ত্র কার্যক্রম (তাঁর মতে সীমিত আকারে) পুনরায় চালু করার কথা। পিজেএসএসের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের উপাখ্যান এখানেই শেষ নয়! জাতিসংঘের United Nations Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (UNDRIP/ইউএনড্রিপ) এর পরিকল্পনা ও খসড়া প্রণয়নের বিষয়ে পূর্ব থেকে অবগত হয়েই সন্তু লারমা তথা পিজেএসএসের উদ্যোগে গঠিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’! পরবর্তীতে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক অসংখ্য মানবতার বাণী সম্বলিত চরম বিতর্কিত আদিবাসী সনদ ঘোষিত হয়; তবে আশ্চর্যজনকভাবে ‘আদিবাসী’ কারা এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা ব্যতিত! ইউএনড্রিপ ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই সন্তু লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি এলিট সমাজ ‘আদিবাসী’ ভিন্ন অন্য কোনো বিশেষণে নিজেদের সমষ্টিগত পরিচয় দিতে একেবারেই নারাজ!

এ বিষয়ে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে সুন্দর ব্যাখ্যা রয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ডক্টর আনন্দ বিকাশ চাকমা কর্তৃক লিখিত ‘কার্পাস মহল থেকে শান্তি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রীয় নীতির ইতিহাস’ বইয়ের ভূমিকায়। তিনি বিস্তারিত আলোচনা করে ভূমিকার শেষাংশে লিখেছেন, ‘গবেষণাধীন সময়কাল ১৮৬০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত। ওই সময়ে ট্রাইব এবং উপজাতি শব্দের প্রচলন অধিকমাত্রায় ছিল। তাই ট্রাইব অথবা উপজাতি শব্দ নিয়ে ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠীবিশেষের পছন্দ অপছন্দ থাকলেও ইতিহাস থেকে সেসকল মুছে ফেলা যায় না। কারণ, শব্দ একটি কালকে প্রতিনিধিত্ব করে। ইতিহাস কে ধারণ করে। তাছাড়া বই পুস্তক এবং দলিল দস্তাবেজের ছাপার অক্ষরে সে নাম-শব্দ রয়ে যাবে অন্তকাল।’ দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে স্থিতিশীল দেশের নাম লিখতে হলে সর্বাগ্রে আসবে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ ভুটানের নাম, এই ক্ষুদ্র দেশ ভুটানও ইউএনড্রিপ-কে নিজেদের সার্বভৌমত্বের জন্য সমস্যা মনে করে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ দেশ ভারত বৈশ্বিক কূটনীতিতে নিজেদের অবস্থান সুসংহত রাখার জন্য ইউএনড্রিপ অনুস্বাক্ষর করলেও নিজ দেশের অভ্যন্তরে প্রযোজ্য নয় বলে মনে করে! তাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নাম Ministry of Tribal Affairs। সম্বোধনে সম্মান অসম্মানের বিতর্ক এড়ানোর জন্য ভারত সরকার দেশের সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে একত্রে তালিকাভুক্ত করে Scheduled Tribe বলে আখ্যায়িত করে। বর্তমানে চরম হিন্দুত্ববাদ উত্থানের ভারতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের সুযোগ-সুবিধা মারাত্মক আপেক্ষিক! হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে গোষ্ঠীসমূহের সম্পর্কের উপর নির্ভর করে সুযোগ-সুবিধার গতি প্রকৃতি! তবে এমনিতেই ফেডারেল রাষ্ট্র ভারতে প্রাদেশিক সায়ত্তশাসন সাংবিধানিক, কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ রাজ্যসমূহকে ওরা ইউনিয়ন টেরিটোরি করে রাষ্ট্রপতির শাসন চালু রেখেছে। এর মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জুম্ম এবং কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিক কার্যক্রম সম্পন্ন এলাকা। কয়েক বছর আগে জুম্ম ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা এবং রাজ্য মর্যাদা কেড়ে নিয়ে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে, অপর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউনিয়ন টেরিটোরি লাক্ষাদ্বীপে চলছে জোর কদমে ভাস্কর্য ও সামরিক স্থাপনা নির্মাণ, খ্রিষ্টান অধ্যুষিত সেভেন সিস্টার্স আবারও জ্বলে উঠেছে। মনিপুরের চলমান গৃহযুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের তালিকাভুক্ত উপজাতি ত্রিপুরাদের সাথে চুক্তি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। মায়ানমারের অবস্থা আরও খারাপ! বহুলভাবে প্রচারিত আছে ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও মায়ানমারের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত এলাকাসমূহ এবং বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বৃহৎ খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গোপন কার্যক্রম চালাচ্ছে খ্রিষ্টান মিশনারিগুলো। পার্বত্য চট্টগ্রামে মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরিত করার হার ও গীর্জার সংখ্যার প্রসার এবং এসব বিষয়ে পাহাড়ি এলিট সমাজের সম্পূর্ণ নিরবতা এই সন্দেহকে আরো বেশি ঘনীভূত করে। এক কথায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের চেয়ে স্থিতিশীল অথবা অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে এগিয়ে থাকা দেশগুলোরও ইউএনড্রিপ ধারণা বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই। কারণ, ৪৬টি অনুচ্ছেদের ইউএনড্রিপ-এ ৪৬ নং অনুচ্ছেদে গিয়ে রাষ্ট্রসমূহের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার বিষয়ে সুরক্ষার বাণী দেওয়া হলেও ৩, ৪, ৫, ৬, ১৮, ১৯, ২৩, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩২, ৩৬, ৩৯ এবং ৪০ এর মতো অনুচ্ছেদগুলো যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় ঐক্যের জন্য মারাত্মক হুমকি, সবচেয়ে বড় কথা চরম ধর্মীয় ও জাতিগত মেরুকরণ বিদ্যমান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলবে।

এরূপ আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, ভৌগোলিক, কূটনৈতিক, কৌশলগত এবং সামরিক বাস্তবতার বিপরীতে বাংলাদেশ যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়সমূহকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি প্রদানের দিকে এগিয়ে যায়, তা ধীরে ধীরে ইউএনড্রিপ এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে, যেহেতু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংগঠনসমূহ ও তাদের দোসর বাম সংগঠনগুলো লিখিতভাবে বলছে না যে, ‘তারা শুধু মৌখিক সম্বোধনে আরো বাড়তি সম্মান চান!’ তারা ঠিকই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ইউএনড্রিপ এর পক্ষে সাফাই দিচ্ছেন অর্থাৎ তাদের মূল লক্ষ্য হলো ইউএনড্রিপ ঘোষণা বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা। আন্তর্জাতিক স্বার্থান্বেষী মহলগুলো এদের এই কর্মকাণ্ডে সমর্থন ও প্রত্যক্ষ সাহায্য করবে সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থে। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকেই ভারত শান্তিবাহিনীকে অস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিয়েছে ও চাচ্ছে কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রামকে প্রথমে একটি পূর্ণ সায়ত্তশাসিত অঞ্চলে পরিণত করতে, এর পরবর্তী ধাপে গণভোট কিংবা সামরিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ভারতে যুক্ত করে তাদের সেভেন সিস্টার্স এর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য চট্টগ্রাম নিজেদের আয়ত্তে নিতে। সেটারও পরবর্তী ধাপে কর্ণফুলী নদীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখলে থাকার শক্তি কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে অবাধ প্রবেশাধিকার প্রদানেও বাংলাদেশকে বাধ্য করাই তাদের মূল লক্ষ্য। হালের ভারতীয় সাংবাদিক ময়ূখের মতো উগ্রবাদীদের মিডিয়ায় খোলামেলা হুমকিতে এসব আশংকা, উদ্দেশ্যের যৌক্তিকতা ও অস্তিত্ব বারংবার শতভাগ প্রমাণ করছে।

আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়সমূহকে অহেতুক ইস্যু বানিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত মুখ্যমন্ত্রীগণও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কিংবা ভারতীয় সেনা প্রেরণের হুমকিদানে পিছিয়ে নেই! পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাঙ্গালিরা এ ধরনের ষড়যন্ত্রগুলো আজ অবদি নিজেদের হাজার হাজার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে ঠেকিয়ে রেখেছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং চীনসহ উন্নত দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলসমূহে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ তথা সার্বভৌমত্ব হ্রাস করে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত আছে। এখন তাদের এই প্রতিযোগিতায় সাফল্যলাভের অন্যতম একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এই ইউএনড্রিপ, সবচেয়ে নিকটবর্তী উদাহরণ হতে পারে ‘সাউথ সুদান’। যুক্তরাষ্ট্র নিজে ইউএনড্রিপ অনুস্বাক্ষরের ধারে কাছে না থাকলেও বিশ্বব্যাপী এখন ইউএনড্রিপ এর সবচেয়ে বড় সমর্থক! ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর এখনো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ওভারসিস টেরিটোরি! বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আছে গোপন ও প্রকাশ্যে মিলিয়ে প্রায় ৭০০ এর অধিক সামরিক ঘাঁটি। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কিছু কিছু ওভারসিস টেরিটোরি মূল ভূখণ্ড থেকে ১০ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্বে অবস্থিতি! প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠন ও আধিপত্য বিস্তারে উন্মাদ এসব বিশ্ব শক্তি কি কখনো ইউএনড্রিপ মোতাবেক সামরিক কার্যক্রম করেছে না করবে? তাই আমাদের গভীরে ভেবে দেখা উচিত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতির সম্ভাব্য কী কী ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া বয়ে আনবে। সেগুলোর মধ্যে কিছু এখানে সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

১) ধীরে ধীরে রাষ্ট্রকে ইউএনড্রিপ মেনে নিতে বাধ্য করবে।

২) পার্বত্য চট্টগ্রামে এযাবৎ অর্জিত স্থিতাবস্থা নিমিষেই নস্যাৎ করবে।

৩) ক্রমিক ১ ও ২ এর ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণ সায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বরাবরের মতো ভারত এতে প্রকাশ্য ও গোপনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেবে। কারণ, ওদের জন্য রাস্তা পরিষ্কার, ওরা আন্তর্জাতিকভাবে ইউএনড্রিপ অনুস্বাক্ষর করে নিজেদের দেশে সেটা অপ্রযোজ্য রাখার মতো দ্বৈত নীতি বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। ইউএনড্রিপ নিয়ে এরকম কিছু করার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, কৌশলগত, সামরিক এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তি বাংলাদেশের নেই।

৪) এরই ধারাবাহিকতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষামূলক ও আগাম সতর্কমূলক কার্যক্রম পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।

৫) রাষ্ট্র ব্রিটিশ শাসনামল থেকে ঘোষিত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারাবে।

৬) ভবিষ্যৎ খনিজ অনুসন্ধান ও উত্তোলন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে রাষ্ট্র চরম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হবে। সমাধানকারী হিসেবে বিদেশি শক্তিগুলো মূল নিয়ন্ত্রক হিসেবে আবির্ভূত হবে প্রতিটি ক্ষেত্রে।

৭) ইউএনড্রিপ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাসমূহের চরম আত্মনিয়ন্ত্রণের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত বিধায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান জাতিগত হানাহানিকে আরো প্রসারিত করবে। শান্তি চুক্তির পর মসনদের দখল ও হালুয়া রুটির ভাগ নিয়ে গত ২৭ বছর ধরে চলমান হানাহানি থেকে এটা একেবারে স্পষ্ট! কুকিরা চাকমাদের আধিপত্য প্রত্যাখ্যান করে সশস্ত্র হয়েছে, চাকমাদের মধ্যে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন হয়েছে। এখন একতা দেখালেও ইতিহাস বলছে মগ তথা মারমাদের সাথে চাকমাদের দা-কুমড়া সম্পর্ক, ইতিমধ্যেই রাঙ্গামাটির রাজস্থলী ও বান্দরবান মিলিয়ে মগদের একটি অংশ সশস্ত্র মগ লিবারেশন আর্মি/এমএলএ/মগ পার্টি গঠন করেছে।

৮) রাষ্ট্রের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও হানাহানি এবং নৃগোষ্ঠীসমূহের চরম বাঙ্গালি বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ব্যাপকহারে বাঙ্গালি বিতাড়িত হবে।

৯) খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও সহায়তায় টাঙ্গাইল, বৃহত্তর ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট, পটুয়াখালী, কক্সবাজার, বৃহত্তর কুমিল্লা এবং বৃহত্তর উত্তর বঙ্গ অঞ্চলে সৃষ্টি হবে অনেকগুলো সায়ত্তশাসিত/বিশেষ অঞ্চল। এরপর হয়তো এসব বিশেষ অঞ্চলের অভ্যন্তরে এবং আশেপাশে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত লাউড স্পিকারে আযান দেওয়ার মতো অসুবিধাজনক কর্মের জন্যেও সাম্প্রদায়িক সমস্যা দেখা দেবে মাঝে মধ্যে।

১০) রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ হারাবে পুরো দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকাসমূহের উপর।

১১) যদি ক্রমান্বয়ে একত্রে ভাবা হয়, তাহলে ‘আদিবাসী’ স্বীকৃতি ইউএনড্রিপ নিয়ে আসবে, ইউএনড্রিপ নিয়ে আসবে গণভোটের অধিকার/সরাসরি বাইরের হস্তক্ষেপ কামনার অধিকার! এভাবে সর্বাগ্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে যেতে পারে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন স্বাধীন কোন রাষ্ট্র কিংবা ভারতের অংশ। দেশের অন্যান্য প্রায় সীমান্তবর্তী এলাকায়ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অবশিষ্ট থাকবে অতি সামান্য।

১২) সর্বোপরি কালক্রমে বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্যমান ‘স্যাটেলার/ভূমিপুত্র (আদিবাসী)’ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে পুরো বাংলাদেশে!

ইউএনড্রিপ এবং শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরেরও পূর্বে ১৯৯৭ সালে প্রথা বিরোধী লেখক প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ তাঁর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম সবুজ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হিংসার ঝরনাধারা’ বইয়ের মুখবন্ধ ‘অসুস্থ আহত সুন্দর’ অংশে লিখেছেন, ‘পাহাড়িরা চান স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসন, আঞ্চলিক পরিষদ এবং আরো অনেক কিছু; তাঁদের চাওয়ার মাত্রা একটু বেশিই; তাঁরা যা চান, তাতে বাঙলাদেশ অখন্ড থাকে না।’ একই বইয়ের ১৯নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘তবে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দাবিগুলো স্বাধিকারের দাবি হ’লেও ওগুলো আধুনিক মানুষের দাবি নয়; কেননা ১৯০০ সালের ম্যানুয়েলে চলতে পারে না বিশশতকের শেষের মানুষের, ওটি সাধারণ উপজাতীয়দের জন্যে চিরদাসত্বের বিধিমালা- সাধারণ উপজাতীয়রা তা জানেনও না; আর বর্তমান কালে রাজাটাজাও চলতে পারে না। তিনি বামপন্থী হয়েও কী ক’রে রাজা চাইলেন, আর সাধারণ মানুষদের করে রাখতে চাইলেন সরকারি কর্মকর্তা, রাজা, দেওয়ান, হেডম্যান, আর কারবারিদের দাস? উপজাতীয়দের রাজাটাজা, দেওয়ান, হেডম্যান, আর কারবারি বাদ দিয়ে হয়ে উঠতে হবে ব্যক্তিঅধিকারসম্পন্ন আধুনিক গণতান্ত্রিক মানুষ।’

হুমায়ুন আজাদ পরিষ্কারভাবে আশংকা প্রকাশ করলেও বাংলাদেশ সরকার ঠিকই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭’ এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সায়ত্তশাসন, আঞ্চলিক পরিষদ, সংস্কৃতি-রীতিনীতি-ঐতিহ্য সংরক্ষণের সুরক্ষাসহ সব দাবিই মেনে নিয়েছে। তবে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থাকবে শাসন ও প্রশাসনে। বৃহত্তর ভালোর জন্য চুক্তি করতে গিয়ে সরকার জলাঞ্জলি দিয়েছে পার্বত্য বাঙ্গালির সাংবিধানিক সমঅধিকার! এতো কিছুর পরেও এখন আদিবাসী স্বীকৃতি দাবিকে দেশীয় ও বৈশ্বিক স্বার্থান্বেষী শক্তিসমূহের আঁতাতে গভীর ষড়যন্ত্র ব্যতিত আর কি বলে আখ্যায়িত করা যেতে পারে? চুক্তির প্রায় ৬৫টি ধারা বাস্তবায়িত, বিপরীতে বর্তমানে বিদ্যমান ৬টি সশস্ত্র সংগঠন মিলিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে চুক্তির আগের চেয়ে বহুগুণ বেশি অস্ত্র রয়েছে। গত ২৭ বছরের লাশের মিছিল সেটার সাক্ষ্য দিচ্ছে, এখন সরকার বিরুদ্ধে অভিযোগকারীগণ কি বলতে পারবেন চুক্তি শতভাগ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই অস্ত্রগুলোর বিষয়ে করণীয় কী কী?

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ইউএনড্রিপ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার দাবিগুলোর চেয়েও শতগুণ জঘন্য এবং সার্বভৌমত্বের জন্য আরো অনেক বড় হুমকি। সেটা থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়, দেশের অধিকাংশ বামপন্থী রাজনৈতিক ও সংগঠনগুলো প্রকৃত বাস্তবতা থেকে কতোটা দূরে বা নীতিভ্রষ্ট! নৃতাত্ত্বিক সত্য, ঐতিহাসিক ও দালিলিক সত্য এবং শান্তি চুক্তির বিপরীতে সুকৌশলে ইউএনড্রিপ টেনে আনার চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই অনেকগুলো প্রশ্ন ও আশংকার জন্ম দেয়! সেগুলো মোটেই কারো সরলতার মুখোশে কিতাবি বক্তব্যে উড়িয়ে দেওয়া যায় না! ১৯৪৭ সনের দেশভাগ থেকে অদ্যাবধি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলিট সমাজের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা ও ইতিহাস দিয়ে বিবেচনা করলে এই প্রশ্ন এবং আশংকাগুলো মোটেই ভিত্তিহীন নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন দিয়ে বিচার করতে গেলে হয়তো প্রতিটি প্রশ্ন ও আশংকা আরো বেশি সত্য এবং ভবিষ্যৎ বাস্তবতা বলে প্রমাণিত হবে! ইউএনড্রিপ গ্রহণযোগ্য নয় বলে কি দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়সমূহের কল্যাণ সাধন করতে হবে না? হ্যাঁ, অবশ্যই করতে হবে! তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকে চরম হুমকিতে ফেলে সেটা করা হোক, তা কখনোই কাম্য হতে পারে না।

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক গবেষক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন