আদিবাসী স্বীকৃতি নিয়ে প্রকৃত জাতীয় মুক্তি অর্জিত হতে পারে না

fec-image

সরকার আভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে বা আন্দোলনের কারণে যখনই অধিকার দিতে বাধ্য হবে, একমাত্র তখনই জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুমোদন করবে। বিপরীতভাবে অর্থাৎ আগে ওই ঘোষণাপত্র অনুমোদন করবে, তারপর আমাদের অধিকার দেবে -তা হয় না। এ ধরণের নজীর পৃথিবীর কোন দেশে আজ পর্যন্ত দেখা যায় নি।

ইদানিং প্রায়ই দেখা যায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৯ আগষ্ট এলেই বিশ্ব আদিবাসী দিবস হিসেবে আমরা সবাই এই দিবস পালনের জন্য একটা জোর টান অনুভব করি, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে বছরের এই একটি মাত্র দিন আমরা নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে সরকারের কাছে আধিবাসী হওয়ার দাবি উত্থাপন করি। যদিও কেউ সজ্ঞানে আর কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত আমরা এই দাবীর সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসী ধারণা সম্পর্কে বুকলেট থেকে কিছু কথা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

“আদিবাসী ” শব্দটি মূলত একটি মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারণা। চাকমা রাজা দেবাশীষ রায় নিজেই বলেছেন, ‘ Indigenous’ is a human rights construct. (Constitutional reform and adivasis শিরোনামে বুধবার ২০ জুলাই ২০১১ New age 8th Anniversary special সংখ্যায়)। অর্থাৎ আদিবাসী বা ইন্ডিজিনাস শব্দটি একটি মানবাধিকার টার্ম বা শব্দ। এটি রাজনৈতিক অভিধান নয়।

একটি জাতির মুক্তি আন্দোলন বা অধিকার আদায়ের আন্দোলন হলো একটি রাজনৈতিক আন্দোলন। স্বয়ংসম্পূর্ণ ও ব্যাপক একটি রাজনৈতিক আন্দোলন ছাড়া এই অধিকার অর্জিত হতে পারে না। অথচ এনজিওগুলো আদিবাসী নাম দিয়ে যা করছে সেটা রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, সেটা হলো মানবাধিকার আন্দোলন। তারা এই মানবাধিকার আন্দোলনের মধ্যেই আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনকে, স্বাধীকার আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়। এভাবে এনজিও-করণের মাধ্যমে আন্দোলনকে তারা সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে কানাগলিতে নিয়ে যাচ্ছে। এতে আন্দোলন হচ্ছে গণবিচ্ছিন্ন, প্রাণহীন, বিভক্ত, সংকীর্ণ ও চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এভাবে কখনো জাতীয় মুক্তি অর্জিত হতে পারে না।

মানবাধিকার আন্দোলন বৃহত্তর একটি রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ মাত্র। এর অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনকে বাদ দিয়ে কেবল মাত্র মানবাধিকার আন্দোলন দিয়ে জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তাই মানবাধিকার আন্দোলনকে অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলনের অধীন হতে হবে।

আজ আমরা দেখতে পাই আদিবাসী শব্দটিকে “জাতির” প্রতিশব্দ বা বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, আর আদিবাসী দিবস পালনের নামে বরাবরই লোকজনকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক ঘোষণা ও আধিবাসী বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম গঠিত হওয়ার পর বর্তমানে “আদিবাসীর ” নামে শুরু হয়েছে রমরমা ব্যবসা। দেখা যায়, অনেক ‘আদিবাসী ‘ সংগঠনের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন বিদেশী সংস্থা ও সরকারের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করে নামমাত্র কর্মসূচী পালন করে বাকি টাকা পকেটস্থ করা। এ ধরণের কাজ খুবই নিন্দনীয় এবং আমরা এর ঘোর বিরোধীতা করি। এর মাধ্যমে জনগণের উপকার হওয়ার কোন আশা নেই বরং এক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনাটাই বেশী।

বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম দিকে “আদিবাসী” “আদিবাসী” বলে চিৎকার করলেও এখন তার সুর পাল্টিয়েছে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের মতো এই সরকারও এখন বলছে দেশে কোন আদিবাসী নেই। এতে জনগণ আরো বেশী বিভ্রান্ত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রশ্নে বিএনপি, জাতীয় পার্টি জামাতের সাথে আওয়ামী লীগের কোন পার্থক্য নেই-এটা তারই প্রমাণ। সংখ্যালঘু জাতির জনগণকে অধিকার না দেয়ার প্রশ্নে তারা এককাট্টা। জাতিসংঘ যদি “আদিবাসী” বিষয়ক ঘোষণা গ্রহণ না করে, “সংখ্যালঘু জাতি” বা “উপজাতি” বিষয়ক ঘোষণা গ্রহণ করতো তাহলে সরকার তখন বলতো দেশে আদিবাসী আছে, “সংখ্যালঘু জাতি” বা “উপজাতি” নেই। অর্থাৎ আমাদেরকে অধিকার না দেয়ার জন্য তারা যেভাবেই হোক মিথ্যা অজুহাত সৃষ্টি করবেই।

অনেকে ধারণা করে যে, বাংলাদেশ সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে এবং আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে আমরা তৎক্ষণাত অধিকার পেয়ে যাবো। এটা আমাদের একটা সাংঘাতিক ভুল ধারণা। আদিবাসী শব্দটি মেনে নিলেও এবং উক্ত ঘোষণা পত্রের প্রতি সমর্থন জানালেও যে সরকার জাতীয় ক্ষেত্রে আমাদের অধিকার মেনে নেবে সেটা আশা করা যায় না। জাপান, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া “আদিবাসীদের” অধিকার স্বীকৃতি দিয়েছে কারণ তাদের সমাজ বহু উন্নত ও তারা অনেক বেশী গণতান্ত্রিক। নেপালও সংখ্যালঘু জাতিসত্তাসমূহের অধিকার মেনে নিয়েছে, কারণ নেপালে মাওবাদীরা তাদের সেই অধিকার সমর্থন করে। ইউরোপের অনেক দেশে সংখ্যালঘু জাতিকে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়েছে। তাদের এলাকাকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। আর আমাদের বাংলাদেশে পার্বত্য চুক্তি করার পরও সরকার সেটা বাস্তবায়ন করছে না। তারপরও এটা নিঃসন্দেহে অনস্বীকার্য যে, জাতিসংঘে গৃহীত আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ সরকার এই ঘোষণাপত্রের সমর্থনে ভোট দেয় নি।

প্রসঙ্গক্রমে, “আদিবাসীর” কোন সর্বজন গ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্রেও এর কোন সংজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করা হয়নি। তবে আদিবাসী বলতে বুঝায় আমাদের মতো সংখ্যালঘু জাতিগুলোকে। আমরা উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতি, জনজাতি, পাহাড়ি জাতি, সংখ্যালঘু জাতি যে নামেই পরিচিত হতে চাই না কেন, আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে আমরা সবাই আদিবাসী। আন্তর্জাতিক আইন আমাদেরকে আদিবাসী হিসেবেই দেখে ও বিচার করে। কাজেই আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে যেসব অধিকার বর্ণিত আছে, সে অধিকার পাবার জন্য নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচয় দেবার ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা যদি সংখ্যালঘু জাতি বলে নিজেদের পরিচয় দিই তাহলেও আমরা সে সকল অধিকার ভোগ করতে পারবো। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শব্দগত পার্থক্য, পররিচিতির পার্থক্য অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে কোন বাধা নয়।

আমাদের মতো আন্দোলনকারী জাতিসত্তাগুলোর অধিকার আদায়ের জন্য বর্তমানে দুটি ধারা লক্ষণীয়: প্রথম ধারাটি হলো আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি লাভের চেষ্টা।

দ্বিতীয়টি হলো জনগণের নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করে গণআন্দোলন। প্রথম পথটি অর্থাৎ আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির পথ ধরে অধিকার আদায়ের যে চেষ্টা সেটাকে আমরা সঠিক মনে করি না। এর কারণ প্রথমত, আগেই বলা হয়েছে এটা হলো একটা মানবাধিকার আন্দোলন যার মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, এই ধারার অনুসারীরা অধিকার আদায়ের জন্য জনগণের শক্তির উপর নির্ভর না করে কিছু এনজিওর উপর নির্ভর করেন। গণআন্দোলনের উপর জোর না দিয়ে সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক,লবিং ইত্যাদির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করেন (আন্দোলনের এই সকল ফোরামে অবশ্যই গুরুত্ব রয়েছে, এবং আমরা এগুলো ব্যবহার করার পক্ষে, কিন্তু একমাত্র এ ধরণের কাজ করেই অধিকার পাওয়া যাবে এই বিশ্বাসকে আমরা ভ্রান্ত মনে করি)।

তৃতীয়ত, সরকার আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেই আপনাআপনি অধিকার আদায় হয়ে যাবে তা আশা করা ভ্রান্তি বিলাস মাত্র।

চতুর্থত, সরকার আদিবাসী শব্দটি নিয়ে সহজেই দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করতে পারে। তারা প্রচার করে বাংলাদেশে বাঙালিরাই হলো আদিবাসী এবং তা একদিক দিয়ে বিচার করলে মিথ্যাও বলা যায় না। আসলে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি ও অধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে একটা কন্ট্রাডিকশন বা বৈপরীত্য রয়েছে। সরকার আভ্যন্তরীণ চাপে পড়ে বা আন্দোলনের কারণে যখনই অধিকার দিতে বাধ্য হবে, একমাত্র তখনই জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র অনুমোদন করবে। বিপরীতভাবে অর্থাৎ আগে ওই ঘোষণাপত্র অনুমোদন করবে, তারপর আমাদের অধিকার দেবে -তা হয় না। এ ধরণের নজীর পৃথিবীর কোন দেশে আজ পর্যন্ত দেখা যায় নি।

সুতরাং আদিবাসী স্বীকৃতির চেষ্টা নাকি জনগণের নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করে গণআন্দোলন? এই দুটি ধারা থেকেই আমাদের বেছে নিতে হবে কোন ধারাটির মাধ্যমে আসলে প্রকৃত জাতীয় মুক্তির অধিকার আদায় করা সম্ভব। সেজন্য জনগণের প্রকৃত অধিকার আদায়ের তাগিদে আমাদেরকে মৌলিক ও মানসম্মত দাবির কিনারায় এসে সরকারের কাছে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে হবে, সংগ্রাম করতে হবে। শুধুমাত্র বছরের একটি দিন অধিকার আদায়ের একটা ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে আদিবাসী হওয়া নিয়ে সরকারের কাছে দাবি জানালে কখনো পাহাড়ি জনগণের প্রকৃত জাতীয় মুক্তির অধিকার অর্জন সম্ভব নয়। এতে শুধু মানুষজন, ইয়াং জেনারেশন বিভ্রান্ত হবে বৈকি! অন্য কোনভাবে এর কোন অর্থ নেই।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আদিবাসী, আন্দোলন, জাতীয় মুক্তি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন