আদি ইতিহাসের আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী বিতর্ক

fec-image

‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ কিংবা ‘ভূমিপুত্র’ আর ‘বহিরাগত’ প্রপঞ্চগুলো ‘পরিচয়ের রাজনীতি’র সাক্ষ্য বহন করে। দুনিয়ার নানা দেশে নানা অঞ্চলে এ রকম ইস্যু নিয়ে জটিল রাজনীতি ও দীর্ঘমেয়াদি গোষ্ঠীগত বিবাদ ঘটতে দেখা যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি অধিবাসীরা নিজেদের আদিবাসী দাবি করছে, এজন্য আন্দোলন করছে আর সেখানকার বাঙালি অধিবাসীদের সেটেলার বলে খারিজ করে দিতে চাইছে। আদিবাসী বলতে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ভ্যান স্যান্ডেল উল্লেখ করেছেন ‘সবচেয়ে আদিমতম সময় থেকে কোনো স্থানের অধিবাসী যারা’। তবে ঐতিহাসিক কিংবা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের আলোকে এ অঞ্চলে বাঙালি এথনিক জনগোষ্ঠীর অবস্থান নিয়ে নির্মোহ কোনো আলোচনা এখনো আমার চোখে পড়েনি। আজকের লেখায় আমি মূলত ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব-নৃতত্ত্বনির্ভর কিছু আলাপের ভেতর দিয়ে উল্লিখিত বিতর্কের সারবত্তা দেখার চেষ্টা করব।

দুনিয়ায় মানুষের ইতিহাস হলো তার অভিবাসনের গতিপথ। নিরন্তর এক স্থান থেকে সে আরেক স্থানে পরিভ্রমণ করেছে। এ পরিভ্রমণের নানা পর্যায়ে তার সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটেছে, শিকার ও সংগ্রহনির্ভর জীবন ছেড়ে একসময় স্থায়ী আবাস গড়েছে, কৃষিকাজ রপ্ত করেছে, উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনের ধারাবাহিকতায় স্তরায়িত সমাজ, নগর, ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ সাধিত হয়েছে। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ধারাবাহিকতায় মানুষ আজ সভ্যতার শিখরে পৌঁছে গেছে। একই ভাষা, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ একই এলাকায় আগে-পরে একাধিকবার অভিবাসিত হয়েছে। মানুষের এ প্রাচীন অভিবাসনকে শনাক্ত করা হয় তিনটি জ্ঞানতাত্ত্বিক উপায়ে-প্রত্নতত্ত্ব, জেনেটিকস ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান।

বর্তমান বাংলাদেশে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক জীবনের নিদর্শন নবপলীয় (হাতিয়ার) হাতকুঠার ও বাটালি পাওয়া গেছে-নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বর, হবিগঞ্জের চাকলাপুঞ্জি, কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি, নওগাঁর টেকথা, ফেনীর ছাগলনাইয়া ও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে। সঠিক ও নিবিড় অনুসন্ধান চালালে এর বিস্তৃতি আরো বাড়বে।

নবপলীয় যুগকে শনাক্ত করা হয় আধুনিক সভ্যতার শুরু হিসেবে। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল কৃষিকাজ ও স্থায়ী বসতির সূচনা। প্রাচীন বাংলাদেশে এসব হাতিয়ারপ্রাপ্তি এ অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক মানববসতির আকর নিদর্শন বহন করে। প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ারপ্রাপ্তির ভৌগোলিক বিস্তার সাপেক্ষে বলা যায়, প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির মানুষের এ বিস্তার পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সিলেট, লালমাইয়ের পাহাড়ি এলাকা এবং মধুপুর গড় এবং বরেন্দ্র ভূমি পর্যন্ত ভূখণ্ডে বিস্তৃত ছিল। এত দিন পর্যন্ত এ সময়ের সাংস্কৃতিক অগ্রগতি সম্পর্কিত তথ্য গবেষকদের কাছে অপ্রতুল ছিল। তবে সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক হাতিয়ার ব্যবহারকারী মানুষের এ বসতি গড়ে উঠেছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের প্রথম দিকে। প্রত্নতাত্ত্বিক ও জেনেটিক যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে তাতে বোঝা যায়, এ অঞ্চলে এক ধরনের বুনো ধান পাওয়া যেত, যা ছিল খরা ও বন্যাসহিষ্ণু। এছাড়া অতি অল্প পরিমাণ পানি কিংবা কেবল বৃষ্টিপাতের ফলে পাওয়া পানিতেও এ ধান চাষাবাদ করা যেত। পাশাপাশি এ ধান অতি অল্প সময়ে পেকে যাওয়ায় দ্রুত সংগ্রহ করা যেত। এছাড়া সেই সময়ে জলবায়ু হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত শুষ্ক, ফলে পরিবেশের সঙ্গে এ রকম অভিযোজনসম্পন্ন ধানপ্রাপ্তি মানুষকে প্রাগৈতিহাসিককালে এ এলাকায় বসতি স্থাপন ও জীবন নির্বাহের একটি অনুকূল পরিবেশ এনে দিয়েছিল। প্রত্নউদ্ভিদ সাক্ষ্যে জানা যায়, বুনো ধান ছাড়াও তৎকালীন লোকেরা স্থানীয়ভাবে চাষ করত সহজলভ্য কাউন, চিনা, নানা রকমের ডাল, বুনো সরিষা, তরমুজজাতীয় ফল। বুনো ফলের মধ্যে ছিল কলা, কাঁঠাল, জলপাই, কমলালেবুজাতীয় ফল, যা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবহার করত বলে অনুমিত হয়।

এ প্রাচীন কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী বসতির ধারাবাহিকতায় খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দের মাঝামাঝিতে কালক্রমে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গড়ে তুলেছিল অনেকগুলো নগর ও বন্দর। সেই নগর ও বন্দরের কেন্দ্রগুলো ছিল উয়ারি-বটেশ্বর, মহাস্থানগড়, বানগড়, টেকথা প্রভৃতি।

প্রাগৈতিহাসিককাল-পরবর্তী সময়ে নানাদিক থেকে সময়ে সময়ে নানা ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় এসেছে, একে অন্যের সঙ্গে বহুমাত্রিক উপায়ে মিথস্ক্রিয়া করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সপ্তদশ শতক ও তৎপরবর্তী সময়ে কিছু জনজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি গড়ে তুলেছিল। যা-ই হোক, এ এলাকায় নানামুখী রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল যা খুব সম্ভবত মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল এবং বাংলা ভাষা কেন্দ্র করে একটি স্বতন্ত্র মানব ভাষাগোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল। তবে ঠিক কোন সময়ে এ রূপান্তর প্রক্রিয়াটি পরিপূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল তা নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধানের আবশ্যকতা রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যে এটি প্রমাণিত যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ি এলাকা থেকে মধুপুরগড় ও বরেন্দ্র ভূমির লালমাটিতে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার বছরের প্রাচীন মানববসতির ধারাবাহিকতা এখনো বহমান। ১৮৬৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামের ইংরেজ প্রশাসক লুইনের বর্ণনায় দেখা যায়, সেখানে চাকমা, মারমাদের পাশাপাশি বাঙালি গ্রামের অস্তিত্বের কথা। বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতে বাঙালি নামে যে জনগোষ্ঠী দেখা যায় তারা হাজার হাজার বছর ধরে এ ভূখণ্ডে বসবাসরত আদিম অধিবাসীদের উত্তর পুরুষ। বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গে যে বাঙালিরা বসবাস করে, সমতলে আর পাহাড়ে, এরা এই ভূমিরই সন্তান।তবে প্রাচীনকাল থেকেই এ ভূখণ্ডে বাঙালি ছাড়াও নানা জনজাতির বসবাস ধারাবাহিকভাবেই চলমান রয়েছে। কী সমতলে কিংবা পাহাড়ে সবখানেই সবাই ছিল ও আছে। তারাও এ মাটিরই সন্তান।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে বাঙালি ছাড়াও চাকমা, মারমা, মগ, মুরংসহ প্রায় ১৩টি জনজাতি (নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ) বসবাস করে বলে জানা যায়। ঐতিহাসিক যেসব প্রমাণাদি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় উল্লিখিত জনজাতিগুলো সপ্তদশ শতক ও তৎপরবর্তী সময়ে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানা অঞ্চল থেকে এসেছে। আমার ধারণা, এসব জনজাতির কেউ কেউ একাধিক পর্বে এ অঞ্চলে এসেছিল। ২১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র জনতা’ ব্যানারে কিছু ছাত্রের সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়েছে যে, এ এলাকায় তারা মুঘল আমল থেকেই বসবাস করছে। এ কারণে তারা আদিবাসী আর বাঙালিরা হলো ‘সেটেলার’। অর্থাৎ তারা পরিষ্কারভাবে বলতে চাইছেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র হলেন তারা আর বাঙালিরা হলো বহিরাগত সেটেলার। এ দাবির প্রতি বাঙালি ভদ্র সমাজ অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে যদিও এর ঐতিহাসিকতা অপ্রমাণিত। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে এ অঞ্চলে আদিবাসী মানুষের জীবন শুরু হয়েছিল প্রায় ২৫০০-৩০০০ বছর আগে যা অধুনা আদিবাসী দাবিদার জনগোষ্ঠীর আগমনেরও প্রায় কমপক্ষে দুই হাজার বছরের পুরনো। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য জুম্ম ছাত্রদের দাবিকে সমর্থন করে না এবং এ ভূখণ্ডে তাদের ‘আদিবাসী’ হওয়ার দাবিটি ঐতিহাসিকভাবে অসাড় ও অগ্রহণযোগ্য প্রতিপন্ন করে।

দিল্লি স্কুল অব ইকোনমিকসের অধ্যাপক ও সমাজবিজ্ঞানী Andre Beteille, যিনি দীর্ঘদিন ধরে এশিয়ার আদিম অধিবাসীদের নিয়ে গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন। তিনি মনে করেন যে ‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ প্রপঞ্চ এশিয়ায় প্রযোজ্য নয়। এখানকার জনজাতিগুলোর অভিবাসনের যে বৈশিষ্ট্য ও তাদের ভেতরের নৃতাত্ত্বিক মিথস্ক্রিয়ার কারণেই এভাবে পৃথকীকরণ সমস্যাজনক। প্রায় একই রকম অভিমত ব্যক্ত করেছেন প্রফেসর John Bowen ও Benedict Kingsbury। প্রফেসর Willem van Schendel যিনি দীর্ঘদিন ধরে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষের অভিবাসন, পরিচয়ের রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন। তার লেখা The dangers of belonging tribes, indigenous peoples and homelands in South Asia প্রবন্ধে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে ‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ প্রপঞ্চটি প্রযোজ্য নয়। কেননা এ এলাকার প্রাচীন মানুষের অভিবাসন এবং এথনিক বৈশিষ্ট্য এমন যে তাদের এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। তার মতে, ‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ বিশেষণ দুটি উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ সেখানে ঔপনিবেশিক দখলদার শক্তি হিসেবে ইউরোপিয়ানরা ঊনবিংশ শতকে গমন করেছিল এবং স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর নিপীড়ন ও রাজনৈতিক আধিপত্য ও কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল।

বাংলাদেশ একটি বহুজাতি ও ধর্মের মানুষের দেশ। এখানে কোনো জাতির মানুষ বেশি, কেউ কম; কোনো ধর্মের মানুষ বেশি, কোনো ধর্মের মানুষ কম। এ দেশে সব ধর্ম ও জাতির অধিকার সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ‘সেটেলার’ তকমা দিয়ে যে বিভাজন করা হয়েছে, যা সুস্পষ্টভাবে জাতিগত নিপীড়নের শামিল এবং একাধারে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট। ‘আদিবাসী’ ও ‘সেটেলার’ কিংবা ‘ভূমিপুত্র’ আর ‘বহিরাগত’ প্রপঞ্চগুলো আদি মানব অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত, যা পরিচয়ের রাজনীতির সাক্ষ্য বহন করে। এর মাধ্যমে যে জ্ঞান উৎপাদন করা হয় তা কখনো কখনো এক সম্প্রদায় দ্বারা আরেক সম্প্রদায়কে ‘অপরায়ণ’ করে, হেজমনি তৈরি করে রাজনৈতিক কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ হাসিল করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবাঙালি সম্প্রদায় কর্তৃক নিজেদের ‘‌আদিবাসী’ দাবি করা এবং প্রতিবেশী বাঙালি সম্প্রদায়কে ‘‌সেটেলার’ হিসেবে উপস্থাপন দৃশ্যত এ ধরনের একটি রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ যার মাধ্যমে অবাঙালি সম্প্রদায় তাদের নিরঙ্কুশ আঞ্চলিক রাজনৈতিক আধিপত্য বজায় রাখতে এবং প্রতিবেশী বাঙালি সম্প্রদায়কে তাদের ন্যায়সংগত অধিকার থেকে খারিজ করে দিতে চায়।

পাহাড়ে বসবাসরত অবাঙালি ও বাঙালি সবাই বাংলাদেশের নাগরিক, সবার সমানাধিকার, সুবিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কারো প্রতি যেন জুলুম না হয় সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। একটি বিষয় পরিষ্কার সেটা হলো এ আদিবাসী কিংবা সেটেলার বিতর্ক অন্তঃসারশূন্য এবং বিভেদের রাজনীতি দিয়ে মোড়ানো। এটি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য হওয়া কাম্য।

মিজানুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি ফেলো, আর্কিওলজিক্যাল সায়েন্স, স্কুল অব আর্কিওলজি, ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড

সূত্র: বণিক বার্তা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন