আরাকান আর্মির সঙ্গে 'যোগাযোগ‌'

আপত্তি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে জান্তা সরকার

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বাংলাদেশ। আনুষ্ঠানিক না হলেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার খবরে ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করেছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। জেনারেল মিন অং হ্লায়িংয়ের সরকার ঢাকায় কূটনৈতিক পত্র দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্র জানা যায়, আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পর সম্প্রতি এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। চিঠিতে কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে জান্তা সরকার বলেছে, ‘আরাকান আর্মি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। তারা নন-স্টেট অ্যাক্টর।’

‘একটা সন্ত্রাসী সংগঠন ও নন-স্টেট অ্যাক্টরের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কীভাবে যোগাযোগ করে’— সেই প্রশ্নও রেখেছে জেনারেল মিন অং হ্লায়িংয়ের সরকার।

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের চিঠির বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে, সরকারের একটি সূত্র বলছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মিয়ানমার সরকারের চিঠির জবাব পাঠানোর কথা রয়েছে।

বিগত সময়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ থাকলেও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আনেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলি–সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান।

ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে খলিলুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশ আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। যেদিন আরাকান আর্মি সীমান্তে তাদের পতাকা উত্তোলন করেছিল, সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম যে এটি একটি নতুন বিশ্ব। ফলে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আরাকান আর্মিকে একটি সংকেত পাঠানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটি নির্দিষ্ট স্তরে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের আগে বিশেষ প্রতিনিধি খলিলুর রহমান জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত জুলি বিশপের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন বলে অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন।

‘মিয়ানমার সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়, আবার আরাকান আর্মিতে যারা আছে তারাও পয়সা নিচ্ছে’— স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যোগাযোগ আছে সেটি মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া যায়।

এ বিষয়ে মিয়ানমার অনুবিভাগ নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশের সাবেক কর্মকর্তারা বলছেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ বিগত সময়ে হয়েছে। তবে, এটি কখনো প্রকাশ্যে আনা হয়নি। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। শুধু তা-ই নয়, মিয়ানমারে থাকা বাংলাদেশের একটি মিশনও অনানুষ্ঠানিকভাবে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ করত।

এক কূটনীতিক বলেন, অতীতে আরাকান আর্মির সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে। বিষয়টি গোপন রাখা হতো। বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে বলা যায়। আরাকান আর্মি স্বীকৃতি চায়। সেজন্য আমরা না চাইলেও আরাকান আর্মি আমাদের কাছে আসত যোগাযোগ করতে। জান্তা সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আছে। সেই কারণে চলমান পরিস্থিতি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক— উভয় দিক বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এগোতে হবে।

গত ১৮ এপ্রিল ‘ফরেন সার্ভিস ডে’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক আলোচনা সভা শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথে বড় সমস্যা আরাকান আর্মি। বিদ্রোহী গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান না হওয়ায় তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় যাওয়া যাচ্ছে না। আবার তাদের এড়িয়েও এ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়।

তৌহিদ হোসেন বলেন, সত্যিকার অর্থে আমরা এখন নতুন প্রতিবেশীর মুখোমুখি, যারা আবার নন-স্টেট অ্যাক্টর। কাজেই তাদের সঙ্গে আমরা না পারছি সরাসরি আচরণ করতে, না পারছি উপেক্ষা করতে। এটি একটি কঠিন পরিস্থিতি।

আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগের বিষয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজারের টেকনাফের সীমান্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছিলেন, মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ফলে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি— উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের। উভয় পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগও রয়েছে।

চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ আহমেদ বলেন, ‘আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ যেটা হচ্ছে, সেটা দরকার। আমি মনে করি, এই যোগাযোগ আরও আগে করা উচিত ছিল; দেরি হয়ে গেছে। আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারে অন্যান্য যাদের প্রভাব আছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। মিয়ানমার আপত্তি করে এখন খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। আমরা তাদের বলতে পারি— আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ করছি না, কিন্তু আমাদের স্বার্থটা তো দেখতে হবে। জান্তা সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছে— এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। তাহলে তারা আমাদের কী বলবে?’

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও ঢাকা সফরে এসে ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসার পরামর্শ’ দিয়েছেন। গত ১৫ মার্চ ঢাকায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবর্তন এবং তাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আরাকান আর্মির সঙ্গে সংলাপে বসা জরুরি।’

আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ যেটা হচ্ছে, সেটা দরকার। আমি মনে করি, এই যোগাযোগ আরও আগে করা উচিত ছিল; দেরি হয়ে গেছে। আরাকান আর্মি ছাড়াও মিয়ানমারে অন্যান্য যাদের প্রভাব আছে, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। মিয়ানমার আপত্তি করে এখন খুব বেশিকিছু করতে পারবে না
তিনি আরও বলেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে একত্রিত করে একটি সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে। এর প্রথম ধাপ হবে সহিংসতা বন্ধ করা এবং একইসঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা, যা মিয়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম করবে, যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে।’

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে জেনারেল মিন অং হ্লায়িং। এরপর থেকে দেশটিতে শুরু হয় সহিংসতা। রাখাইনে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আরাকান আর্মি লড়াই করছে। বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।

সূত্র : ঢাকা পোস্ট

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আরাকান আর্মি
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন