আর টু পি নীতির আলোকে মানবিক করিডোর: বাংলাদেশের নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে?

fec-image

বর্তমান বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ‘Responsibility to Protect’ বা সংক্ষেপে R2P একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হিসেবে বিবেচিত।

২০০৫ সালে জাতিসংঘের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে গৃহীত এ নীতির মূল উদ্দেশ্য হলো-যেকোনো দেশের অভ্যন্তরে যদি গণহত্যা, জাতিগত নিধন, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্দিষ্ট নৈতিক দায়বদ্ধতায় হস্তক্ষেপ করতে পারবে।

যদিও এই নীতির মূল উদ্দেশ্য মানবিকতা রক্ষা, বাস্তবে এটি কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের ওপর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতা, গৃহযুদ্ধ এবং সেনা অভিযান নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। নিরীহ বেসামরিক জনগণ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের দিকে প্রবেশ করছে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি “মানবিক করিডোর” স্থাপনের প্রস্তাব করেছে, যা সরাসরি মিয়ানমার থেকে বিপদাপন্ন জনগণকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এ প্রস্তাব R2P নীতির ধারায় উত্থাপিত হলেও এটি বাংলাদেশের জন্য এক গভীর নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রথমত, পার্বত্য চট্টগ্রাম এমনিতেই একটি সংবেদনশীল অঞ্চল। দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় জাতিগত সংঘাত, বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতা, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ চলমান। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তি স্বত্বেও এখনও এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর মধ্যে যদি একটি মানবিক করিডোর চালু করা হয়, তবে তা ওই অঞ্চলের বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গা সংকট ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জন্য এক বহুমাত্রিক বোঝায় পরিণত হয়েছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী অবস্থান করছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, নিরাপত্তা এবং শিক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে। পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাদক ব্যবসা, জঙ্গি তৎপরতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বাড়ছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য একটি বড় হুমকি। এই পরিস্থিতিতে মানবিক করিডোরের নামে নতুন করে শরণার্থী প্রবেশের সুযোগ তৈরি হলে দেশের উপর চাপ আরও বহুগুণে বেড়ে যাবে।

তৃতীয়ত, একটি মানবিক করিডোর কার্যত বাংলাদেশের ভূখণ্ডের একাংশে আন্তর্জাতিক বা বিদেশি সংস্থার সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ও কার্যক্রম প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দিতে পারে। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণের ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ইতিহাস বলে, যখন কোনো রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের কোনো অংশ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বা সহায়তায় ছেড়ে দেয়, তখন তা ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমন করিডোরের মাধ্যমে বিদেশি সংস্থা, আন্তর্জাতিক বাহিনী বা এমনকি বড় পরাশক্তিগুলোর আগমন ঘটলে, দেশের নিরাপত্তা নীতির ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে।

চতুর্থত, মানবিক করিডোর স্থাপনের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় অপরাধমূলক তৎপরতা বৃদ্ধির ঝুঁকি রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ও দুর্গম অঞ্চলগুলো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, মাদক চোরাচালানকারী, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। মানবিক করিডোরের আড়ালে এসব গোষ্ঠী অনায়াসে যাতায়াত ও সংগঠিত হতে পারবে, যা দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক ভয়াবহ বার্তা হতে পারে।

পঞ্চমত, কূটনৈতিকভাবে এই করিডোর একটি বিপজ্জনক উদাহরণ তৈরি করতে পারে। মিয়ানমার যদি এটি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে, তবে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। চীন, ভারত, এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো এই অঞ্চলে ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। এই প্রেক্ষাপটে মানবিক করিডোরের আড়ালে কোনো পরাশক্তির হস্তক্ষেপ হলে, বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান চরম সংকটে পড়তে পারে। বিশেষ করে, চীন ও রাশিয়ার মতো দেশ যারা R2P নীতির প্রয়োগে বরাবরই রক্ষণশীল অবস্থানে রয়েছে, তারা এমন উদ্যোগে বাংলাদেশের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে।

ষষ্ঠত, দেশের জনগণের মধ্যেও এই করিডোর নিয়ে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন। নতুন করে আরেকটি শরণার্থী সঙ্কট বা মানবিক করিডোর বাস্তবায়ন হলে, তা সামাজিক ভারসাম্য, অর্থনৈতিক চাপ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে স্থানীয় জনগণের জীবিকা, নিরাপত্তা ও সম্পদের ওপর আগ্রাসন বাড়তে পারে।

সপ্তমত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও বাড়তি চাপ তৈরি হবে। মানবিক করিডোর কার্যকর রাখতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি হবে। এতে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা আরও কঠিন হয়ে উঠবে।

অষ্টমত, ভবিষ্যতে যদি আন্তর্জাতিক মহল মানবিক করিডোরের স্থায়ী রূপ দাবি করে বা এটিকে দীর্ঘমেয়াদে রূপান্তরিত করতে চায়, তবে তা বাংলাদেশের জন্য এক অপ্রত্যাশিত নিরাপত্তা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এই করিডোর যেন স্থায়ী ‘গলদ’ হয়ে না দাঁড়ায়, সেই বিষয়টি শুরু থেকেই বিবেচনায় নিতে হবে।

পরিশেষে বলা যায় যে, মানবিক করিডোরের ধারণা মানবিকতা ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা থেকে উত্থিত হলেও, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বাস্তবতায় এটি এক বিপজ্জনক চ্যালেঞ্জ। R2P নীতির প্রয়োগে সাবধানতা ও কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সীমান্ত নিরাপত্তায় জোর দেওয়া। মানবিকতা ও নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, যাতে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: নিরাপত্তা, বাংলাদেশ, মানবিক করিডোর
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন