আলীকদমের গহীন অরণ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানের সন্ধানে

fec-image

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫) বিপর্যয়ের স্মারক বহন করছে আলীকদম উপজেলার মাতামুহুরী রিজার্ভে কালাপাহাড় এলাকার বিমানঝিরি!

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দু’টি যুদ্ধ বিমান ভেঙ্গে আছড়ে পড়েছিল এই কালাপাহাড় ছড়ার একটি ঝিরিতে।

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্মৃতিকে মনে রাখতে সেখানকার মুরুং জনগোষ্ঠী ঝিরিটির নামকরণ করেন ‘বিমানঝিরি’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক কোন সন-তারিখে এ যুদ্ধ বিমান দু’টি বিধ্বস্ত হয়েছিল সে বিষয়ে অনুসন্ধান বিষয়ক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ এবং অনলাইনে ব্রিটিশ ও জাপানের রেকর্ড তল্লাশীর কাজ চলমান।

এখনো পর্যন্ত সুনির্দ্ধিষ্ট তারিখ ও সন খুঁজে পাওয়া না গেলেও আমরা ক’জন মিলে খুঁজে পেয়েছি সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানের ধ্বংসাবশেষ! এ নিয়ে আজকের প্রতিবেদন।

২০২১ সালের ডিসেম্বর। আমরা ক’জন মিলে প্রস্তুতি নিই সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমান খুঁজে বের করবো।

আমাদের সফর সঙ্গীর মধ্যে ইসমত ইলাহী ভাই একজন অনুসন্ধিৎসু ও ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বিমানের অনুসন্ধানে গহীন অরণ্যে ট্রেকিং-এর এ সিদ্ধান্ত ছিল অতর্কিত। ঘড়ির কাটায় সময় তখন সকাল নয়টা।

আগের দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী কুরুকপাতা বাজারের পাশে মাতামুহুী নদীঘাটে বাধা আছে নৌকা। সাথে রয়েছেন দু’জন গাইড।

আলীকদম সদর থেকে সড়ক পথে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে কুরুকপাতা বাজার। এক সময় সেখানে একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম ছিল নৌকা।

এলাকাটি একসময় ছিল অতিশয় দুর্গম। অবশ্য এখন সড়ক যোগাযোগ হওয়ায় কুরুকপাতাকে এখন আর দুর্গম বলা যায় না।

কুরুকপাতা বাজারে সকালের খাবারটা খেয়ে নিলাম।

নদীঘাটে বাধা ইঞ্জিন চালিত নৌকাযোগেই আমাদের গন্তব্যস্থল কালা পাহাড় ছড়ার মুখ পর্যন্ত।

সকাল থেকেই মনে অন্যরকম একটা শিরহণ কাজ করছিল। কারণ আমরা যাচ্ছি আজ থেকে প্রায় ৭৮ বছর আগে আলীকদমের মাটিতে বিধ্বস্ত হওয়া যুদ্ধ বিমানের ধ্বংসাবশেষ খুঁজতে।

কুরুকপাতা বাজার ঘাট থেকে স্রোতের বিপরীতে আমাদের নৌকা চলছে উজানে। খরস্রোতা মাতামুহুরীর বুকে নৌভ্রমণ এমনিতেই আনন্দের।

নদীর দু’ধারে হাজার বৃক্ষরাজি। রয়েছে সারি সারি লতাগুল্ম। মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে পাখির দল। নদীর পাড়ে পড়ে দেখা মিলছে সাদা বক। মনে ভ্রমণের আনন্দ!

তার চেয়ে মনে শিহরণ জাগছে ইতিহাসের একটি অধ্যায়ের ধ্বংসাবশেষ আজ খুঁজে বের করবো।

পাহাড়, ঝর্ণা, নদী এবং সাদা মেঘের মিতালী একসঙ্গে দেখতে হলে মাতামুহুরী নদী ভ্রমণের বিকল্প নেই।

মাতামুহুরীর এই বিশাল সৌন্দর্য কোনো ক্যামেরার ফ্রেমে বেঁধে প্রকাশ করা যায় না!

কুরুকপাতা বাজার ঘাট থেকে আমাদের নৌকা উজানে চলছে। নৌকা যত উপরের দিকে যাচ্ছে মনে হচ্ছে নদীর দু’ধারের পাহাড় আরো বিস্তৃত হচ্ছে।

এক অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হচ্ছিলাম। নদীর দু’ধরের গাছপালা, পাহাড়ের ফাঁকে আকাশের মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি মনকে মোহাচ্ছন্ন করছিল। কিন্তু সবকিছু চাপিয়ে দোল খাচ্ছিলাম সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উন্মাতাল দিনগুলোর কথা ভেবে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন হয়েছিল তখন জন্মও হয়নি আমার এই ধারাধামে। কিন্তু ইতিহাস পড়ে জানার অবসর হয়েছে।

বলা হয়ে থাকে গত শতাব্দীতে মানবসভ্যতার কয়েকটি বিপর্যয়ের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) ছিল সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। এ বিপর্যয়ের ঢেউ লেগেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা আলীকদমেও!

সকল যুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও ছিলো বিবাদমান জাতি বা রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও অধিকার লাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যা এ জনপদের পাহাড়ে-পর্বতে সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন রেখে গিয়েছিল।

এশিয়ার দেশ জাপান যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অধিকার করে ব্রিটিশ ভারতের দিকে অগ্রসর হয় তখন তৎকালীন বার্মা (বর্তমান মায়ানমার) সন্নিহিত অঞ্চল হিসেবে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আক্রান্ত হতে থাকে।

এ সময় মায়ানমার সীমান্তবর্তী আলীকদম, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও থানচিতে দেখা দেয় যুদ্ধকালীন অস্থিরতা। এ অঞ্চলের অর্থনীতি ও জননিরাপত্তা ভেঙ্গে পড়ে।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা দীর্ঘ দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় সর্বত্র। যুদ্ধে ঝরে যায় অসংখ্য প্রাণ।

আসি মূল আলোচনায়।
কুরুকপাতা থেকে রওয়ানা হয়ে আধা ঘন্টা পর আমাদের নৌকা কালা পাহাড় ছড়ার মুখে এসে থামলো। এ এলাকাটি আমার পূর্ব পরিচিত।

তবে এর আগে কখনো ছড়া মুখ থেকে ভেতরের দিকে যাওয়া হয়নি।

আমাদের গাইড কংদুক ম্রো জানালেন এবার হাঁটতে হবে। তার দেখানো মতে ছড়ার পাশ ঘেঁষে হাঁটা শুরু হলো আমাদের।

আনুমানিক ১০ মিনিট হাঁটার পর এবার আমাদেরকে খাঁড়া একটি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠতে হবে। ছড়ার পাশ থেকে পাহাড়ি রাস্তাটি খাড়া উপরে উঠে গেছে।

খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠা শুরু হলো। অর্ধেক পথ উঠেই সকলের নাভিশ্বাস।

আনুমানিক ২০মিনিট একনাগাড়ে হাঁটার পর বুঝা গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত বিমান দেখার সখ সহজে মিটবে না! কিছুক্ষণ হাঁটি আবার কিছুক্ষণ জিরোই।

একদম খাড়া পাহাড় উঠার পর উঁচু-নীচু অনেক রাস্তা পাড়ি দিলাম। আমরা যে পথ ধরে হেঁটে চলেছি সেটি তংপ্রে মুরুং পাড়ার রাস্তা।

সরকারি প্রকল্পে বছরখানেক আগে মাটির রাস্তা নির্মাণ হয়েছে। তাই রাস্তাটি মোটামুটি প্রশস্ত।

ঘন্টাখানেক হাঁটার পর গাইড জানালেন এবার পাহাড় থেকে ঝিরিতে নামতে হবে। এবার পাহাড় থেকে খাড়া নীচে নামার পালা।

পাহাড়ে উঠার চেয়ে নামার পথটা ছিল বিপদসংকুল। একটু অমনযোগী হয়ে পা দিলে অন্তত দু’শ ফুট নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি! সুতরাং প্রতি পদে সতর্ক পদক্ষেপ সকলের!

অবশেষে আমরা খাড়া পাহাড় থেকে ঐতিহাসিক সেই প্লেন ঝিরিতে নামলাম! বারবার শিহরিত হচ্ছিলাম। খানিকপর দেখবো যুদ্ধবিধ্বস্ত প্লেনের ভাঙ্গা অংশ।

গাইড আমাদেরকে জানালেন, ক’দিন আগেই এই ঝিরিপথ বেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন গেছে। পায়ের চিহ্নও দেখালেন।

প্লেনঝিরিতে রয়েছে প্রচুর পাথর। রয়েছে সুউচ্চ গিরিখাত। এসব গিরিখাতের কিছুদূর পরপর গভীর পানি। একটি গিরিখাতে দেখা গেল প্রচুর পানি।

গাইড জানালেন কোমর পর্যন্ত হবে পানি। কনকনে ঠাণ্ডা!

আমাদের মধ্যে একজন ছাড়া আর কেউ উদ্যোগী হলো না এ গিরিখাতের পানি ডিঙ্গাতে।

গাইড জানালেন এই গিরিখাত পার হয়েই রয়েছে প্লেন ভাঙ্গার অংশ!

সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। আবার খাড়া পাহাড় উঠতে হবে। পাহাড়ে উঠার পর এবার খাড়া পাহাড় বেয়ে ঝিরিতে নামতে হবে। সকলেই নেমে গেছে।

আমি নামার পথে মাঝপথেই লতা ধরে ঝুলে থাকলাম। সাহস পাচ্ছি না আর নীচে নামতে। পা পিছলে গেলেই একেবারো সোঝা গিয়ে পড়তে হবে পাথরযুক্ত খাদে।

অবস্থা বেগতিক। এমন সময় আমাদের একজন গাইড নিচ থেকে উপরে উঠে এলেন। তিনি খাড়া পাহাড়ের মাটিতে সিঁড়ির মতো করে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে যাওয়ার পথকে সুগম করলেন।

অবশেষে নেমে গেলাম আবার প্লেন ঝিরিতে!

গাইড আমাদেরকে ঝিরির একটি জলাশয়ে নিয়ে গেলেন। দেখলাম সেখানে একটি মাঝারি ধরণের লোহার গোল চাকতি ডুবে আছে।

ভালো করে লক্ষ্য করলাম সেটি একটি ইঞ্জিন। পানিতে নেমে আমাদের ক’জন টানাটানি করেও ইঞ্জিনটি নাড়াতে পারলো না।

গাইড জানালেন আরো উজানে যে ইঞ্জিনটি আছে সেখানে পানি নেই। ঝিরির অল্প পানিতেই পড়ে আছে। সেখানে পৌঁছে গেলাম খানিক পর।

দেখলাম মরিচায় ধরা মাঝারি ধরণের একটি ইঞ্জিন পড়ে আছে। নাটবল্টু সব মরিচায় একাকার। জীর্ণশীর্ণ ইঞ্জিনের চারপাশ। আমাদের টীম প্রধান ইসমত ভাই ইঞ্জিনটি উল্টাতে চেষ্টা করলেন। গাইডসহ সকলের প্রচেষ্টায় ইঞ্জিনটি উল্টানো গেল।

ইঞ্জিন উল্টানোর পর অবাক করার একটি বিষয় লক্ষ্য করলাম আমরা!

আনুমানিক ৭৮ বছর আগে বিধ্বস্ত হয়েছিল এই যুদ্ধ বিমান। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো ইঞ্জিনের কয়েকটি নাট এর ভেতর থেকে কিছু তার (কয়েল) বের হয়ে আছে একদম মরিচা ধরা ছাড়া।

সেখানে মরিচার কোন আঁচ লাগেনি! বিষয়টির হেতু আমরা বুঝতে পারলাম। মেশিন অন্যসবে মরিয়া ধরে জীর্ণশীর্ণ। কিন্তু শুধুমাত্র কয়েকটি তার (কয়েল) একদম নতুনের মতো চিকচিক করছিল।

এবার আমাদের ফেরার পালা। গাইড জানালেন, এই ঝিরির পরের ঝিরির নাম তিয়াশর ঝিরি। সেখানে রয়েছে একটি ঝর্ণা। আমরা উদ্যোগী হলাম আলীকদমের গহীনে লুকিয়ে থাকা এই ঝর্ণা দেখার জন্য!

আমাদের হাঁটা শুরু হলো তিয়াশর ঝর্ণা দেখতে!

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন