আলীকদমে ভূগর্ভস্থ পানির সংকট, ত্রাহি অবস্থা স্থানীয়দের

fec-image

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে বিশুদ্ধ খাবার পানির চরম সংকট সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কিংবা স্থানীয় প্রশাসনিক পর্যায়ে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। উপজেলা সদরে পানি সংকট নিরসনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০১১ সালের জুন মাসে পানি শোধনাগার প্রকল্প গ্রহণ করে। সেই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ গতবছর মে মাস থেকে শুরু হলেও কাজের ধীরগতির কারণে এখনো পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্রমাগত নির্বিচারে বন নিধন ও স্থানীয়রা ঝিরি-ঝর্নার সঠিক ব্যবহার করতে না পারায় পানির উৎসও দিন দিন কমে যাচ্ছে। সেই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে। বিগত প্রায় দু’দশক ধরে আলীকদম উপজেলার প্রধান নদী মাতামুহুরী নাব্য সংকটে ভুগছে। পাশাপাশি মাতামুহুরীর উপনদী হিসেবে থাকা খালগুলোর দু’পাশে বৃক্ষ নিধন, অপরিকল্পিত জুম চাষ, পাথর উত্তোলন হয়েছে বিগত কয়েক দশক ধরে। এ কারণেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর কমে গেছে বলে মনে করেন স্থানীয় পরিবেশবাদী ও ঠিকাদার উইলিয়াম মারমা।

তিনি বলেন, এলাকার ঝিরি-ঝর্নাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্নার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কুয়া। কিন্তু, পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন ও বন উজাড়ের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে; পানির উৎস কমছে। কারণ, গাছপালা না থাকলে পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না।

সরেজমিন উপজেলার উত্তর পালং পাড়া, সিলেটি পাড়া, পান বাজার, পূর্ব পালং পাড়া, বাস স্টেশন, খুইল্যা মিয়া পাড়া, ছাবের মিয়া পাড়া, থানা পাড়া প্রভৃতি পাড়ায় ঘুরে দেখা গেছে, এক কলসি পানির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় মা-বোনদের খালি হাতে ফিরে যেতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এসব দুর্গম এলাকার মানুষ খাবার পানির সঙ্কটে ভুগলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে খাবার পানির সঙ্কটে এলাকার জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

উপজেলা সদর ও আশেপাশে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে যেসব রিংওয়েল ও টিওবওয়েল বসনো হয়, তা সঠিকভাবে স্থাপন করা হয় না। এছাড়াও উপজেলা পরিষদের এডিপির বরাদ্দে এলজিইডি থেকেও যেসব রিংওয়েল স্থাপন করা হয় তার বেশিরভাগ কাজও বর্ষা শুরু হলে। সরকারি এ দু’টি সংস্থার বেশিরভাগ রিংওয়েল-টিউবওয়েল স্থাপন করা হয় মে মাসের শেষে এবং জুন-জুলাইয়ে।

এ সময় বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ফলে ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীরে গেলে পানি পাওয়া যায়। প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি-এপ্রিল) পর্যন্ত ৩০ থেকে ৪০ ফুট গভীর রিংওয়েল-টিউবওয়েলগুলোতে আর পানি পাওয়া যায় না।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের মতে, ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানির উৎস পাওয়া যাচ্ছে না। বিভিন্ন এলাকায় পাথুরে হওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। একসময় পার্বত্য এলাকা সুবিস্তৃত অরণ্য ও প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। পানির উৎসও ছিল ব্যাপক। সময়ের বিবর্তনে আজ পাহাড়ের সেসব বিস্তৃত অরণ্য ও প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে পানির উৎস হ্রাস পেয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

স্থানীয় সাংবাদিক এসএম জিয়াউদ্দিন জুয়েল জানান, পাহাড়ের গাছপালা এবং নদী, ছড়া, ঝিরি বা ঝরনার পাথরগুলোই মূলত পানি ধরে রাখে। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্তৃক নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন এবং স্থানীয় উন্নয়ন কাজে ব্যাপকহারে পাথর উত্তোলনের কারণে পানির উৎস দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও পাহাড়ে লাভজনক বিবেচনায় লাগানো হচ্ছে প্রচুর সেগুন গাছ। সেগুন গাছ প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে। এতে মাটির গুণাগুণও নষ্ট হয়ে যায়। ব্যাপকহারে সেগুন গাছ লাগানোর ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে পানির সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, আলীকদমের প্রধান নদী মাতামুহুরী নাব্যতা সংকটে ভূগছে বিগত দু’দশকের বেশি। মাতামুহুরীর বুকে জেগে উঠা চরে নির্বিচারে তামাক চাষ হচ্ছে। পাশাপাশি রোয়াম্ভু খাল, তৈনখাল, চৈক্ষ্যংখাল, ভরিখাল প্রভৃতি খালের বুকে তামাক চাষ হচ্ছে। এক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসন কিংবা কৃষি বিভাগের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তামাক ক্ষেতে প্রচুর পানি দিতে হয়। খাল এবং ঝিরির মাঝে গর্ত খুঁড়ে পানি উত্তোলন করায় আশেপাশের ঝিরি-খালগুলোতে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। তামাক চাষের কারণে এ উপজেলার কৃষি, পরিবেশ-প্রকৃতির অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।

স্থানীয় সাংবাদিক মো. কামরুজ্জামান জানান, আলীকদম উপজেলায় কয়েক বছর আগে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জিএফএস প্রকল্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। রেপাড়পাড়া বাজার পয়েন্ট থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে দুপ্রুঝিরি মুরুংপাড়ার পাশে একটি পাহাড়ি ঢালুতে জিএফএস পদ্ধতিতে পানি সরবরাহের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। কিন্ত প্রকল্পের সঠিক দেখভাল না থাকায় জিএফএস এর পানি প্রতিনিয়ত অপচয় হয়ে থাকে। জিএফএস এর পানি তামাক চাষেও ব্যবহৃত হয়। এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কার্যকর উদ্যোগ নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ মুহিববুল্লাহ পাহাড়ে সুপেয় পানির সঙ্কট নিয়ে একটি গবেষণা করেছেন। তার মতে, শুকনো মৌসুমে পাহাড়ে পানির সঙ্কটের কয়েকটি কারণ হলো- বৃষ্টি কম হওয়া, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, নলকূপে পানি না আসা আর ছড়া শুকিয়ে যাওয়া। তিনি আরও বলেন, বন-পাহাড়ে লাগানো কিছু গাছপালা অনেক পানি টেনে নিচ্ছে। এ ছাড়া পাহাড়ধস এবং জনবসতি বাড়ার কারণেও অনেক পানির উৎস ধ্বংস হয়ে গেছে।

বান্দরবান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বলেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে আলীকদম উপজেলা পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে উপজেলা সদরের আশেপাশে পানি সংকট কেটে যাবে। তিনি জানান, বর্তমানে প্রকল্পের কাজ চলমান আছে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: আলীকদম, পানি, ভূগর্ভস্থ
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন