parbattanews

আলীকদম ভ্রমণ ও লাল বাহিনীর ইতিহাস পাঠ

রিয়াদুল মল্লিক রানা, ঢাকা থেকে:

অফিসের রুটিন মাফিক কর্মব্যস্ততা, ঢাকা শহরের তীব্র যানজট আর যান্ত্রিক জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। আমরা চার বন্ধু মিলে তাই সিদ্ধান্ত নিলাম দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। প্রকৃতির কাছাকাছি নিরিবিলি পরিবেশে কোথাও। বন্ধু পিয়াল বললো, চল সাজেক বা নিলগীরি যাই। সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কবির বলে উঠলো- ‘ওখানে নয়, চল আমরা এবার নতুন কিছু প্ল্যান করি। এবার আমরা গহীন পাহাড়ে যাবো যেখানে কেউ যায়না’। ‘গহীন পাহাড়’- শব্দটা শুনতেই রক্তের মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর শীতল স্রোত বয়ে গেল। মামুনের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়াতে। ও বললো- চল বান্দরবানের আলীকদমে যাই। নিরিবিলি জায়গা, পর্যটক কম। মাতামুহুরি নদী আর পাহাড়ের অপূর্ব মিলন দেখা যাবে। সবাই রাজি হয়ে গেলাম।

সায়েদাবাদ থেকে হানিফ পরিবহনে চেপে বসলাম। গন্তব্য আলীকদম। দীর্ঘ যাত্রার পর চকোরিয়া নামে একটা জায়গাতে নামলাম আমরা। মামুন বললো, এখান থেকে নাকি চান্দের গাড়িতে করে আলীকদম যেতে হবে। চান্দের গাড়ি!!! সেটা আবার কি? খোলা একটা পিকআপ ভ্যানের মত গাড়ি, স্থানীয়রা বলে চান্দের গাড়ি। অগত্যা চান্দের গাড়িতে উঠে পড়লাম আমরা। সু-উচ্চ আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে চলছে চান্দের গাড়ি। মনে হল যেন রোলার কোষ্টারে চড়েছি। অদ্ভূত, অপূর্ব, অসাধারণ পাহাড়ি দৃশ্য দেখতে দেখতে পৌঁছালাম আলীকদম। ছোট একটা উপজেলা। সুন্দর-সাজানো গোছানো।

পরিচয় হলো ইয়ারিং মুরং নামে মাঝবয়সী এক পাহাড়ির সাথে। তাকে আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা বললাম। সব শুনে ইয়ারিং বললো যে, সে আমাদেরকে তার পাড়াতে (গ্রাম) নিয়ে যাবে। আলীকদম থেকে নৌকা যোগে ৫/৬ ঘণ্টা লাগবে। তারপর হেঁটে আরো ৩ ঘন্টার পথ। ইয়ারিং বললো- ‘আজ যাওয়া যাবে না। রাত হয়ে যাবে। রাতে পথে ডাকাতি হয়’। ডাকাতির কথা শুনে আমরা সবাই ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু সেটা প্রকাশ করলাম না। ফ্যাসফেসে গলায় পিয়াল বললো- ‘কারা ডাকাতি করে’? জবাবে ইয়ারিং বললো- ‘আগে শান্তিবাহিনী করতো এমন কিছু সন্ত্রাসী অস্ত্র জমা না দিয়ে এখনো পাহাড়ে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, খুন, গুম, ধর্ষণসহ নানান অরাজকতা করে বেড়াচ্ছে। ঐ দলেরই কিছু লোক এই এলাকায় আত্নগোপনে আছে’। ডাকাতির ভয়ে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম পরদিন ভোরে আমরা ইয়ারিংয়ের পাড়াতে রওনা দিবো।

পরদিন সকালে ইঞ্জিন চালিত নৌকাযোগে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। মনের মধ্যে এক অজানা ভয় কাজ করছে। এই ইয়ারিং নিজেই শান্তিবাহিনী না তো? ইয়ারিংকে বাজিয়ে দেখার জন্য আমরা নানান ধরনের প্রশ্ন করতে লাগলাম তাকে। কবির বললো- ‘আচ্ছা ইয়ারিং আপনি কি আগে শান্তিবাহিনীতে ছিলেন’? আমাদের প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠলো ইয়ারিং। সে বললো-‘আমি তো মুরং, আমি ছিলাম মুরংবাহিনীতে। আমি কিভাবে শান্তিবাহিনীতে থাকবো’? ‘মুরং বাহিনী’ কি সেটা জানার আগ্রহ জাগলো। ইয়ারিং বললো এ ব্যাপারে পোয়ামুহূরীতে (একটি জায়গার নাম) গিয়ে বিস্তারিত বলবে কারণ ইঞ্জিন নৌকার শব্দে ঠিকমত কথা শোনা যাচ্ছিলো না।

দুপুরে পৌঁছালাম পোয়ামুহূরী নামক জায়গাতে। ছোট একটা বাজার। আশেপাশে ১/২ কিঃমিঃ এর মধ্যে কোন জনবসতি নেই। ইয়ারিংকে জিজ্ঞেস করলাম এমন নির্জন স্থানে বাজার? শান্তিবাহিনী আসে না? জবাবে বাজারের সাথে লাগোয়া পাহাড়টি দেখিয়ে ইয়ারিং বললো- ‘এই পাহাড়ের উপরে সেনা ক্যাম্প আছে। শান্তিবাহিনী এখানে আসবে না ভয়ে’। একথা শুনে ভরসা পেলাম আমরা। ঠিক হলো রাতে আমরা পোয়ামুহূরী বাজারেই থাকবো।

ইয়ারিং আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলো মেনপাত মুরং, ম্যাংকাই মুরং আর মেনরই মুরং নামে আরো কিছু মুরংদের সাথে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তাদের সবার কাছ থেকেই শুনতে থাকলাম শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে মুরং বাহিনীর সংগ্রামের ইতিহাস।

এক সময় বান্দরবান জেলার লামা আর আলীকদম ছিলো শান্তিবাহিনীর অভয়ারণ্য। তাদের অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন, হত্যা-লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজিতে এই অঞ্চলের সাধারণ পাহাড়ি-বাঙ্গালীরা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা বাংগালীরা ছিলো নিরস্ত্র, নিরীহ এবং অসহায়। তারা শান্তিবাহিনীর অত্যাচার মুখবুজে সহ্য করে গেছে। প্রতিরোধ করতে পারেনি। এই শান্তিবাহিনী মুরংদের উপরও নানাভাবে অত্যাচার, নির্যাতন, ধর্ষণ ও চাঁদাবাজি করতো।

শান্তিবাহিনীর দাবী পূরণ করতে না পারলে মুরংদেরকে জীবন দিতে হতো। দিনের পর দিন শান্তিবাহিনীর এই অত্যাচারে একসময় অতিষ্ট হয়ে মুরংরা এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। দুক্কা মুরং, মেননাও মুরং, আনাচরণ ত্রিপুরা, পাখি মগ, রেনক্রি মুরং, মেনলে মুরং, প্রেনএ মুরং, হমকাম মুরং, মেনরাই মুরং, পারাও মুরং, রেংচু মুরং, বোলাই মুরং, লাংগি মুরং, রাংক্লাং মুরং, তংলক মুরং, চমবট মুরং, সেক্সে মুরং, মাংরূম মুরং এরকম আরো কিছু মুরং নেতারা মিলে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৮৫ সালে আলীকদমের মাতামুহুরী রিজার্ভ ফরেস্টের কচ্ছইপ্যা মুখের লোংরা পাড়ার ঝিনঝিরিতে অবস্থিত শান্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্পে একরাতে মেনলে মুরুং এর নেতৃত্বে মুরংদের একটি দল দা, কুড়াল, লাঠিসোটা ও গাদা বন্দুক নিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত হামলায় শান্তিবাহিনীর সদস্যরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে যে যার মতো করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। মেনলে মুরংয়ের দল ঐ আস্তানাটির দখলে নিয়ে নেয় এবং সেখান থেকে বিপুল পরিমান অস্ত্র ও গুলি হস্তগত করে তারা। এভাবেই মুরং বাহিনীর প্রাথমিক অস্ত্র ভান্ডার গড়ে উঠে। এই ঘটনার পর থেকে মুরংরা নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে আরো একতাবদ্ধ হয়ে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

মুরুংদের এই সাহসিকতা দেখে এদের পাশে এসে দাঁড়ায় সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। ফলে ১৯৮৫ সালে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে ‘মুরুং বাহিনী’। লাল রং এর পোষাক পরতো বলে স্থানীয়রা তাঁদেরকে ‘লাল বাহিনী’ বা ‘গরম বাহিনী’ নামেও ডাকতো। পরবর্তীতে মুরং বাহিনীর সদস্যরা সরকার স্বীকৃত আনসার-ভিডিপিতে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়ে এলাকার জনগণের জান-মালের নিরাপত্তাসহ নিজেদের ও অন্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করতে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি দমনে সেনাবাহিনী, বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি), পুলিশ ও আনসার-ভিডিপিদের সহায়তা করা এবং শান্তিবাহিনীর হাত থেকে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত উপজাতিদের নিরাপত্তা দান।

মুরংবাহিনী গঠিত হবার পর থেকে শান্তিবাহিনীরা মুরং নিধনের জন্য ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা দিনেরাতে বিভিন্ন সময়ে মুরং পাড়াগুলোতে হানা দিতে থাকে। তখন মুরং বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের পাড়ায় বাংকার খুঁড়ে ও চলাচল পথে বিশেষ পদ্ধতিতে ‘বাঁশকল’ নামে এক ধরণের ফাঁদ তৈরী করা শুরু করলো। বাঁশকলের ভয়ে পাহাড়ি এলাকায় রাস্তা দিয়ে সহজভাবে শান্তিবাহিনীর সদস্যরা চলাচলে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো।

ধীরে ধীরে মুরংবাহিনীর সুনাম সর্বমহলে ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়রা এ বাহিনীকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আশির্বাদ হিসেবে মনে করতে থাকে। শান্তিবাহিনীর ভয়াবহ তাণ্ডব ও অত্যাচারযজ্ঞ যখন তুঙ্গে তখন মুরংবাহিনী বীরবিক্রমে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সাহসী ভূমিকা পালন করে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে শান্তিবাহিনীর তাণ্ডবে অশান্তির আগুন জ্বলছিল সেখানে মুরংবাহিনীর একের পর এক শান্তিবাহিনীর উপর সফল আক্রমন আর কর্মতৎপরতার ফলে ১৯৮৬ সাল থেকে লামা ও আলীকদম উপজেলা শান্তিবাহিনী মুক্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়।

মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলাম মুরংবাহিনীর সংগ্রামের ইতিহাস। এখানে ঘুরতে না এলে এই ইতিহাস হয়তো কখনোই জানা হত না। আমি নিশ্চিত আমার মত অধিকাংশ মানুষই পার্বত্য চট্টগ্রামের এইসব ইতিহাস জানেনা। ইয়ারিং মুরংকে জিজ্ঞেস করলাম- শান্তিচুক্তি তো হয়ে গেছে এখন কি পাহাড় শান্ত? নাকি এখনো সন্ত্রাস চলে? মুরংবাহিনী কি এখন আর আছে? জবাবে ম্যাংকাই মুরং বললো- ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাথে শান্তিবাহিনীর সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হয়।

শান্তিচুক্তির ফলে সংগত কারণে মুরং বাহিনীর কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। ফলে এরপর থেকে মুরং বাহিনীর কর্মতৎপরতা কমতে শুরু করে। মুরং বাহিনীর সেই হারানো ঐতিহ্য ও জৌলুস এখন তেমন একটা নেই। তবে কতিপয় উদ্যমী, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক মুরং যুবকরা তাদের বাহিনীর নামটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সদা তৎপর। পাশাপাশি যেকোন পরিস্থিতিতে তারা সরকার, স্থানীয় প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর পাশে থেকে সর্বদা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত আছে।

মেনপাত মুরং বলেন- এখনো মুরং বাহিনীকে ধ্বংস ও এ সম্প্রদায়ের উন্নয়নকে ব্যাহত করতে পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান সশস্ত্র আঞ্চলিক উপজাতীয় সংগঠনগুলো তৎপর রয়েছে। ফলে কিছু কিছু মুরং যুবক টাকার লোভে ঐ সমস্ত সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের রাষ্ট্র বিরোধী কার্যকলাপে জড়িত হয়ে পড়ছে। এমনকি মুরং সম্প্রদায় বর্তমানে খ্রিষ্টান মিশনারীদের ধর্মীয় আগ্রাসনের টার্গেটে পরিণত হওয়ায় তাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও সামাজিক পরিবেশ দিন দিন বিলুপ্তির পথে ধাবিত হচ্ছে। তবে মুরং নেতারা তাদের সম্প্রদায়ের যুবকদেরকে এ সমস্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়া এবং ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। মুরংবাহিনীর গর্বের সংগ্রামের ইতিহাস শুনতে শুনতে কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছিলো তা টের পাইনি।

আমরা পরে আরো দুইদিন ওখানে ছিলাম। পোয়ামুহূরী ঝর্ণা, দামতুয়া জল প্রপাত, ডিমপাহাড়, ইন্দুমুখ, সিন্ধুমুখ, বড়আগলা, তরনীপাড়া নামক জায়গাগুলোতে ঘুরেছিলাম। মুরংদের সাথে থেকেছি, খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। তাদের মত সহজ সরল মানুষ আমার জীবনে খুব কমই দেখেছি। ঢাকায় ফিরে আসার পর আবার সেই কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক জীবনের রুটিনে বাঁধা পড়েছি। তবে ক্ষণে ক্ষণে মন চলে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা মাতামুহূরী নদীর কোল ঘেঁসে গড়ে ওঠা ঐ স্বর্গরাজ্যে। যেখানে বাস করে শান্তিবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ‘মুরং উপজাতি’। স্যালুট মুরংবাহিনীকে, স্যালুট মুরং উপজাতিকে।

Exit mobile version