parbattanews

আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছৈয়দ হোছেনের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগের পাহাড়’

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি মদিনাতুল উলুম মডেল ইন্সটিউট আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ

অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ নানা অভিযোগ উঠেছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি মদিনাতুল উলুম মডেল ইন্সটিউট আলীম মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছৈয়দ হোছেনের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনৈতিক উপায়ে অর্থ আদায়, মাদ্রাসা বোর্ডের সাথে কমিটি জালিয়াতিসহ দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে তার অপসারণ চেয়েছেন স্থানীয়রা। অভিযোগ অস্বীকার করে অধ্যক্ষ বলছেন, এগুলো তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।

সম্প্রতি নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীর সঙ্গে অর্ন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশের পর অধ্যক্ষের নামে নানা অভিযোগ নতুন করে সামনে এসেছে। এ ব্যাপারে বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসন পৃথক দুটি দল তদন্ত করেছে। জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সুমা রাণী ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের বিদায়ী কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন এই দুটি তদন্ত করেন।

প্রাপ্ত তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, মদিনাতুল উলুম মডেল ইন্সটিউট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৯০ সনে। ২০০১ সনে এমপিওভুক্ত হয়। সেসময় মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল হাকিম বর্তমান অধ্যক্ষ ছৈয়দ হোসেনকে নাইক্ষ্যংছড়ি বাজার মসজিদ থেকে নিয়ে মাদ্রাসায় এবতেদায়ী পদে চাকুরী দেন। এর পর সহ-সুপার ও ২০০৫ সনে সুপার হিসেবে পদোন্নতি পান ছৈয়দ হোছেন। সে থেকে প্রায় সাড়ে ৭শ শিক্ষার্থীর মাদ্রাসাটি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি।

মাদরাসার একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেন, অধ্যক্ষ ছৈয়দ হোছেন ২০১৪ সালে ভূয়া কাগজপত্র দাখিল করে নিম্ম স্কেল থেকে উচ্চতর স্কেল নেন। অথচ মাদ্রাসা বোর্ডের প্রবিধানমালা অনুযায়ী, কোন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী উচ্চতর পদে নতুন নিয়োগ লাভ করলে পূর্বতন পদের কোন বেতনভাতা উত্তোলন করতে পারবেন না। কিন্তু ছৈয়দ হোসেন সুপার পদ থেকে পদত্যাগ করে অধ্যক্ষ পদে যোগদান করলেও জালিয়াতি করে পূর্বের পদের বেতনভাতা ভোগ করছেন।

মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক মাওলানা আবু বক্কর বলেন, কোন দাখিল মাদরাসা আলীম মাদ্রাসায় রূপান্তর হলে বিধান মতে সুপার ও সহ সুপার যথাক্রমে অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদ পাবেন। আলীম স্তর এমপিভুক্ত হওয়ার পর অধ্যক্ষ এবং উপাধ্যক্ষ নিজ পদের বেতনভাতা প্রাপ্ত হবেন। কিন্তু মাদরাসায় এই নিয়ম মানা হচ্ছে না।

অভিযোগে জানা গেছে, ২০১১ সনে নির্বাহী কমিটির সভায় হিসাব নিরীক্ষায় ১ লক্ষ ৬৩ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। পরে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বেসরকারী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা পরিচালনার বিধানে সবধরনের লেনদেন সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বাক্ষরে ব্যাংকে করার নির্দেশনা থাকলেও মাদ্রাসায় এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। অথচ প্রতি বছর মাদ্রাসায় অন্তত ৩০ লক্ষ টাকা আয়সহ বিভিন্ন সময় সরকারী অনুদানের অর্থের লেনদেন হচ্ছে।

প্রত্যেক মাসে শিক্ষকদের বেতনের ১০ শতাংশ সিপিএফ (কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড) দেওয়ার কথা থাকলেও তা পাচ্ছেন না বলে জানান মাদ্রাসার শিক্ষক ছৈয়দুল বশর, মোহাম্মদ ইছহাক, তাজেম উদ্দিনসহ অন্যরা। এ নিয়ে ইতোপূর্বে এক শিক্ষক আদালতে মামলাও করেছেন।

মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আলী আকবর, জলিলুর রহমান, অলিউল্লাহ, মির আহম্মদ এই প্রতিবেদককে বলেন, সম্প্রতি মাদ্রাসার নির্বাহী কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের স্বাক্ষর জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী ওবাইদুল হাকিম ও মাওলানা হেলাল উদ্দিনকে কমিটি গঠনের বিষয়ে কিছু জানানো হয়নি বলে অভিযোগ করেন।

নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মাদ্রাসা কমিটির সদস্য তসলিম ইকবাল চৌধুরী বলেন, নির্বাহী কমিটি গঠনের পূর্বে শিক্ষানুরাগী সদস্য মনোনয়নের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে তিনজনের নামের তালিকা মাদ্রাসা থেকে পাঠানো হয়। এই তালিকা থেকে ২০১৮ সনের ১৩ ডিসেম্বর অধ্যাপক শফিউল্লাহ ও তসলিম ইকবাল চৌধুরীকে মাদ্রাসার শিক্ষানুরাগী সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়।

কিন্তু জেলা প্রশাসকের সেই চিঠি জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ আমার নাম কেটে অন্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। এদিকে মাদরাসা বোর্ডের প্রজ্ঞাপন বিকৃত করে ব্যাংকে কমিটি জমা দেওয়ার ঘটনায় সম্প্রতি মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছৈয়দ হোছেনের কাছে ব্যাখা চেয়েছে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয়রা জানান, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নৈতিক স্খলনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বোন পরিচয় দিয়ে এক ছাত্রীর সাথে সেলফি ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হন তিনি। এছাড়া ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস কেমি নামে এক ছাত্রীর কাছ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের সংবাদ সম্প্রতি ফেইসবুকে ভাইরাল হয়।

জানতে চাইলে প্রিন্সিপাল ছৈয়দ হোসেন বলেন, সেলিফি সংক্রান্ত যে ছাত্রীর কথা বলা হচ্ছে তাকে আমি বিয়ে করেছি। নির্বাহী কমিটির কাগজপত্র জালিয়াতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন- মাদরাসা বোর্ডে আগের কমিটি ছিল। পরে তা সংশোধনের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে কমিটি বিকৃত করার বিষয়ে ব্যাংকের কোন ব্যাখ্যার চিঠি তিনি পাননি। এছাড়াও অন্যন্য অভিযোগগুলো সত্য নয় বলে দাবী করেন তিনি।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১৮ বছর ধরেই এই মাদ্রাসায় আছেন প্রিন্সিপাল ছৈয়দ হোছেন। এর আগেও একাধিকবার তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ ওঠে। প্রায় প্রতিবারই তদন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। অপকর্ম আড়াল করতে তার নিজস্ব কিছু ভক্ত রয়েছে। এই অবস্থায় এলাকার অভিজ্ঞজনেরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উদ্ধর্তন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

সম্প্রতি প্রিন্সিপাল এর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করা বান্দরবান জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সুমা রানী দে এই প্রতিদেককে বলেন, অধ্যক্ষের সঙ্গে ছাত্রীর অন্তরঙ্গ ছবি প্রকাশের পর নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসার বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু পরে ওই ছাত্রীকে অধ্যক্ষ বিয়ে করার কারনে বিষয়টি থমকে ছিল। অধ্যক্ষের অন্যান্য বিষয়গুলো কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে অভিযোগগুলো পুনরায় সরেজমিনে তদন্ত করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিয়া আফরিন কচি বলেন, অধ্যক্ষের নারী সংক্রান্তসহ কয়েকটি অভিযোগ উপজেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হবে। তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি।

Exit mobile version