ইংল্যান্ডে ইসলামী খেলাফত: ডলার ও দিনার
১৯৭৩ সালের পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্বর্ণজমা রেখে ডলারের মান নিয়ন্ত্রণ করতো। আরব ইজরাইল যুদ্ধের (১৯৬৭-১৯৭০) পর ওপেক যখন আমেরিকার উপর তেল অবরোধ জারি করে। এবং ঠিক তখনই আমেরিকার ডলারের পতন ঘটতে থাকে। মার্কিন সিনেট তখন দিশেহারা হয়ে যায়। কি করা যায় বা কোন উপায়ে ডলারকে আন্তর্জাতিক মূদ্রা হিসাবে পুনঃস্থাপন করা যায়। সেই উপায় খুঁজতে থাকে।
সৌভাগ্যক্রমে তারা পেয়েও যায় কৌশল। ইউ এস এ ডলারের মান আন্তর্জাতিক বাজারে ধরে রাখতে সৌদি আরব, ইকুয়েডর, পানামা, ভেনেজুয়েলা, ইন্দোনেশিয়া সহ তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখাতে শুরু করে। হোয়াইট হাউজ সেই সকল দেশগুলোকে জ্ঞান করে, আপনাদের আমরা সামরিক নিরাপত্তা প্রদান করবো। বিদ্যুতের বিপ্লব করে দেশকে ভরিয়ে দেবো আলোয় -আলোয়।
আধুনিক শহর ও সড়ক নির্মাণে করবো সহযোগিতা। তবে শর্ত হলো, আপনাদের কেবল আমাদের নিকটই তেল বিক্রি করতে হবে। তেলের খনির আধুনিকায়নে আমাদের ইঞ্জিনিয়ার কাজ করবে। আপনাদের অর্থ জমা রাখার ব্যাংকও হবে আমাদের দেশে। আপনাদের তেলের বিনিময়ে স্বর্ণমূদ্রার পরিবর্তে ডলার প্রদান করা হবে।
বিভিন্ন প্রলোভনপ্রসূত এক প্রকারে বাধ্য করা হয় তেল সমৃদ্ধ দেশগুলোকে।উল্লেখিত চুক্তি ছাড়াও বিভিন্ন শর্ত দিয়ে আরব দেশে সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তেলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় আমেরিকা। তখন থেকেই এই ডলার পেট্রোডলারে রূপ ধারন করে। অর্থাৎ, পেট্রোলের বিনিময়ে ডলার। ফলে, পৃথিবীতে ডলারের সম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা হয়। প্রকারান্তরে কায়েম হয় মার্কিনীদের ভোগবাদি খেলাফত।
এতক্ষণ বয়ান করলাম সভ্যতার শীর্ষযুগের ইতিহাস। একে সভ্যতার ইতিহাসের তৃতীয় কাল নামে নামকরণ করা যায়। এবং আরব সভ্যতাকে উৎকর্ষতার দ্বিতীয় কালের মুল্লুক হিসেবে অবিহিত করা যায়। উল্লেখ্য, গ্রীস, পারসিক, মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয়সহ সমকালীন প্রভৃতি সকল সভ্যতাই ছিলো প্রথম কালের উৎকর্ষতার অনন্য যুগ। যেখানে গ্রীস ছিল অন্যান্য সকল সভ্য সম্রাজ্যের খলিফা।
প্রসঙ্গত, বর্তমান সভ্যতায় ডলারের সমরূপ প্রভাবশালী মূদ্রাও ইসলামের ইতিহাসে খুজে পাওয়া যায়। এ সকল মূদ্রা আব্বাসি খেলাফতের সমকালীন অন্যান্য দেশে ব্যবহার ও সংগ্রহ করা ছিলো খুবই সন্মানজনক। মূদ্রাগুলো স্বর্ণ দ্বারা পুরোগঠিত ছিল বলে পৃথিবীর সকল দেশ এই মূদ্রা দ্বারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য করা হত।
এদিকে, বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে মহাস্তানগড়ে খলিফা হারুনুর রশিদের মূদ্রা পাওয়া গেছে। এছাড়া, ইন্দোনেশিয়া সূমাত্রায়ও আব্বাসী আমলের মূদ্রা পাওয়া যায়। মধ্য এশিয়ার তুর্কিমিনিস্থানে ৮ম ও ৯ম শতকের আব্বাসী মূদ্রার অস্তিত্ব মেলে।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ তথা ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনেও আব্বাসী খেলাফতের মূদ্রা প্রকাশ্যে আসে।
এছাড়া, ইংল্যান্ডেও আব্বাসি দিনার ১৯১৩ সালে আবিষ্কৃত হয়। প্রাপ্ত মুদ্রার এক পাশে OFFA REX (Offa the King) খোদাই করা আছে। এর অপর পাশ উল্টালে যে কেউ আশ্চর্য হয়ে যাবে যে, সেখানে আরবি হরফে লেখা ছিল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অর্থ, আল্লাহ তায়ালা ব্যাতীত কোন মাবুদ বা খোদা নেই।
আজ থেকে সারে বার’শ বছর আগের কথা। ইংল্যান্ডের আড়াই হাজার মাইল পশ্চিমের একটি রাজ্যে রাজা থিংফ্রিথ এর অফা নামে এক রাজপূত্র ছিল। যিনি ৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে মধ্য ইংল্যান্ডের সিংহাসনে আরোহন করেন। তাকে আবার খ্রিষ্টানদের কিং অব মার্সিয়াও বলা হয়। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ব্রিটেন শাসন করেন।
অনেক ইতিহাসবিদ আলফ্রেড দ্যা গ্রেটের পর তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এ্যাংলো-স্যাক্সন রাজা বলে বিবেচনা করেন। ৭৮০ সালে তিনি তার ক্ষমতা ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্তৃতি ঘটান। তাঁর আমলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম ছিল আব্বাসি স্বর্ণমুদ্রা।
যা অদ্যাপি এখনো ইংল্যান্ডের জাদুঘরে সুরক্ষিত রয়েছে। এই মুদ্রাটি ৭৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আল-মনসুরের খেলাফতের সময় আব্বাসী দিনারের একটি কপি ছিল। খুব সম্ভবত এ্যাংলো-স্যাক্সন বণিকরা এই মুদ্রা ব্যবহার করত বলে ধারনা করা হয়।
ইংল্যান্ডে এ্যাংলো-স্যাক্সনদের নিকট এটি ইসলামী স্বর্ণমুদ্রা নামে পরিচতি। এটি ছিল তৎকালীন আমলে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রা। এবং অফা’র মুদ্রাটি যথেষ্ট মৌলিক ছিল। এছাড়া, এটি বিদেশীদের নিকটও গ্রহণযোগ্য ছিলো। কেবল এলিট শ্রেণিই এই মূদ্রা ব্যবহার করত।
অন্যান্য মূদ্রার মত সকল কাজে এর ব্যবহার হত না। তবে বহিঃবাণিজ্যে ডলারের মত দিনারকে ব্যবহার করা হত। জাল মূদ্রা হলে স্থানীয় বণিকরা এটি ব্যবহার করতেন না। তৎকালে ইংল্যান্ডে স্বর্ণমূদ্রা খুবই দুষ্প্রাপ্য ছিলো। যাদের নিকট এই মূদ্রা ছিলো তাদের ধনী বলে মনে করা হত।
বাণিজ্যিক সূত্রে এই মূদ্রা ইংল্যান্ডের মার্সিয়াতে আসে। তবে স্থানীয়ভাবেও রাজা অনুরূপ মূদ্রা তৈরি করতেন। এই মূদ্রা দ্বারা বোঝা যায় না যে আব্বাসী খেলাফত ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। তবে গবেষকগণ বলেন, আব্বাসীদের একটি সফট পাওয়ার ব্রিটেনে ছিলো।
আব্বাসী মূদ্রা ডলারের মতই শক্তিশালী ছিলো যা সারা পৃথিবীতে তৎকালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। কাজেই, স্পষ্টতই বলা যায়, আরব সভ্যতার স্বর্ণযুগে দিনারের মূল্য ছিলো অনন্য।
তথ্যসূত্র:
১. একটি অর্থনৈতিক ঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতা, জন পার্কিন্স, অনুবাদ: দেবাশীষ চক্রবর্তী
২. The House of Wisdom, Jamal Al khalili, অনুবাদ: তারেকুল ইসলাম (লেখক)
৩. Article: The Soft Power of The Abbasid Caliphate in England by Nasser AlFalasi, (Sail Magazine)
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহকারী শিক্ষক, ইকরা আব্দুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়, লোহাগাড়া, চট্টগ্রাম।