ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধাঁচের প্রতারণার প্রমাণ  

fec-image

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাদিয়া রাফিয়া রাফা (২৪) গত বছরের ৩০ অক্টোবর ইভ্যালি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে কক্সবাজারে রয়েল টিউলিপ রিসোর্টে একটি রুম বুক করেছিলেন। এ জন্য তিনি ছয় হাজার ৬৪১ টাকা দেন। তাঁর কোড নম্বর ১৫৩৯৯৫৪৯৭। এক মাস পর ইভ্যালি থেকে কল করে তাঁকে জানানো হয়, হোটেলটিতে সেই রুম বুক করার অফারটি আর নেই। অথচ অ্যাপে লেখা দেখাচ্ছিল সেখানে রুম আছে। এরপর তিনি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য দুই মাস ইভ্যালির অফিস ঘুরেও টাকা ফেরত পাননি। ক্ষুব্ধ ফাদিয়া রাফা বলেন, ‘দুই মাস ধরে ইভ্যালিতে কল করছি; কিন্তু আমার কল রিসিভ করে না। তাদের সার্ভিস ভালো না, তারা প্রতারক।’

সাদিয়া রাফার মতো লাখো গ্রাহকের কাছ থেকে অভিনব কায়দায় গ্রাহকদের লোভনীয় প্রস্তাবের ফাঁদে ফেলে ভয়ানক প্রতারণা করেছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আট ধরনের প্রতারণার মাধ্যমে প্রচলিত বিভিন্ন আইন ভঙ্গের প্রমাণ পেয়েছে খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি তদন্ত টিম অনুসন্ধান করে নানা প্রতারণা ও অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে। তদন্তে দেশীয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অর্ডার করা পণ্য নির্ধারিত সময়ে ডেলিভারি না দেওয়া, গ্রাহকদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগ না রাখা, পণ্য ডেলিভারি দিতে ব্যর্থ হলে অগ্রিম নেওয়া টাকা ফেরত না দেওয়া, ক্যাশব্যাক হিসাবে টাকা না দিয়ে ই-ব্যালেন্স দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ওই তদন্তের ওপর ভিত্তি করে গত ১২ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দিনের কাছে পাঠিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত সেপ্টেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে করা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পুলিশ সদর দপ্তরকে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, নানা কৌশলের আশ্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ কম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র এক কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় নানা অভিযোগ জমা পড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসার ধরন দেখে বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কা করছেন, এতে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ রয়েছে।

পণ্য কিনলেই টাকা ফেরতের অস্বাভাবিক অফার দিয়ে ব্যবসা করছে ইভ্যালি। ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশব্যাক অফার দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার পণ্য কিনলে সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা ফেরত দেওয়া হবে। নানা ধরনের লোভনীয় অফার দিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করা হচ্ছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইভ্যালির কার্যক্রমের ধরন অনেকটাই এমএলএম কম্পানির মতো। এমএলএম কম্পানিগুলোর প্রতারণার চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হচ্ছে, ইভ্যালিও তা-ই করছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এখানে মানি লন্ডারিং হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা বলেন, ইভ্যালির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ ওঠার পর বিএফআইইউ থেকে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংক হিসাবের পাশাপাশি চেয়ারম্যান ও এমডি মো. রাসেলের ব্যাংক হিসাব এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে বিএফআইইউ থেকে অভিযোগগুলো তদন্ত করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো থেকে আর তাদের ব্যাংক হিসাব স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়নি। ফলে এক মাস পর তাদের ব্যাংক হিসাব অটো চালু হয়ে যায়।

সূত্র জানিয়েছে, বিএফআইইউর তদন্তেও ইভ্যালির বিরুদ্ধে উত্থাপিত কিছু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে ইভ্যালিকে প্রচলিত আইন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নীতিমালা মেনে ব্যবসা করতে নির্দেশনা দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পণ্য অর্ডার করার ক্ষেত্রে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের বদলে ইভ্যালিকে ‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’ পদ্ধতি প্রবর্তনে বাধ্য করতে নির্দেশনা দেওয়ার জন্যও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ছয়-সাত মাস আগে অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর এখনো পণ্য কিংবা টাকা ফেরত না পাওয়া ক্রেতাদের সাক্ষাৎকার এবং দেশে প্রচলিত এ সম্পর্কিত আইন পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করে পণ্য বা রিফান্ড না পাওয়া, গিফট কার্ড পেয়েও তা ব্যবহারের সুযোগ না পাওয়ার যেসব অভিযোগ ক্রেতারা করেছেন, সেগুলো পুলিশের সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম শাখার মাধ্যমে তদন্ত করে দেখারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ইভ্যালি কত অর্ডার নিয়েছে এবং তার বিপরীতে কী পরিমাণ ডেলিভারি দিয়েছে, প্রতি মাসে তার রিপোর্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে জমা পাঠাতে ইভ্যালিকে নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশও রয়েছে প্রতিবেদনটিতে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শামীম হাসান স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনটিতে ইভ্যালির বিরুদ্ধে আট ধরনের অনিয়ম পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব অপরাধের দায়ে বিদ্যমান ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এবং দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর বিভিন্ন ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ অনুযায়ী ইভ্যালির এসব অপরাধের দায় কম্পানির মালিক মো. রাসেল আহমেদের ওপর বর্তায়।

এদিকে ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওনা টাকা নগদ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ফেরত না দিয়ে ই-ওয়ালেটে যোগ করা এবং ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য কেনার সময় ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে না দেওয়ার অভিযোগেরও প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ইভ্যালিতে অর্ডার করা পণ্যের বিপরীতে অনেক সময় অন্য পণ্য, কমমূল্যের পণ্য ও মানহীন পণ্যও সরবরাহ করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের সোনাপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ ফেরদৌস ফকির জানিয়েছেন, গত বছরের ৬ জুন একটি ল্যাপটপের অর্ডার দেন তিনি। সর্বোচ্চ ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তিনি ল্যাপটপ বা টাকা কোনোটিই পাননি।

রাজধানীর পূর্ব বাসাবোর আনিসুর রহমান গত ১৬ জুন একটি জিইসি ফ্যান, তিনটি মোবাইল ফোন, একটি ওয়েট স্কেল, একটি ওভেন, একটি ব্যাগ অর্ডার করে ৮৪ হাজার ২৭৮ টাকা পরিশোধ করেন। তিনি কোনো পণ্য হাতে পাননি। অগ্রিম মূল্য পরিশোধের পর দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও পণ্য বা পণ্যমূল্য কোনোটিই ফেরত না পাওয়ার এ রকম আরো অনেক ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইভ্যালির বিভিন্ন অফারের মধ্যে গিফট কার্ড অন্যতম লোভনীয় একটি অফার। যেমন—কোনো ক্রেতা নগদ ছয় হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করে গিফট কার্ড কিনলে তার ইভ্যালি অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকার ব্যালেন্স জমা হয়। ওই ব্যালেন্স নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যবহার করে কোনো পণ্য ক্রয় না করলে তা বাতিল হয়ে যায়।

ই-কমার্স পরিচালনাবিষয়ক আলাদা কোনো আইন দেশে প্রচলিত না থাকলেও বিদ্যমান দণ্ডবিধি ১৮৬০ ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইন ২০০৯ অনুযায়ী অগ্রিম মূল্য নেওয়ার পর সময়মতো পণ্য সরবরাহ না করা ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ’ ও ‘প্রতারণা’।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ইভ্যালি তার গ্রাহকদের সঙ্গে হটলাইন নম্বর, সাপোর্ট ই-মেইল, ইভ্যালি অ্যাপ্লিকেশন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যথাযথভাবে যোগাযোগ করে না। এ ধরনের ঘটনা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

ক্যাশব্যাক অফারের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ ই-ব্যালেন্স থেকে পণ্য ক্রয়ের সময় ১০০ শতাংশ ব্যবহার করতে না দেওয়াকে ‘প্রতারণা’ হিসেবে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার মতো অসাধুতার জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডাদেশ হতে পারে।

২০১৮ সালের ১৪ মে যৌথ মূলধনী কম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর ইভ্যালি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করা এই কম্পানির বর্তমান পরিশোধিত মূলধন এক কোটি টাকা। ইভ্যালির নিবন্ধিত গ্রাহক এখন ৩৭ লাখেরও বেশি এবং মাসিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। বর্তমানে প্রায় ২৫ হাজার বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন