উত্তপ্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম: কেন?
মাত্রই কথা শেষ করলাম পার্বত্য চট্টগ্রামে আমার দীর্ঘদিনের জানাশোনা কয়েকজন পাহাড়ি ও বাঙালিদের সাথে। শেষ কথা হলো তরুলতা ত্রিপুরার সাথে। যাকে আমি ২০০৫ সালে পাহাড়ি অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করি। সেই থেকে সে আমাকে দাদা বলে সম্ভাষণ করে। দীঘিনালা বাজার থেকে একটু দূরে তাদের গ্রাম। পাড়া থেকে নিরাপদ দূরে চলে গেছে। পাড়ার ঘর পাহাড়ায় আছে তার স্বামী কৃষ্ণ এিপুরা (ছদ্মনাম)।
পেশায় একসময় সিএনজি চালক ছিলো। এখন পেশা বদলে বাবুর্চি। পাহাড়ি-বাঙালি দুধরনের রান্নাতেই সে পাকা।
দীঘিনালা মূল বাজার থেকে একটু দূরের পাহাড়ি দোকানে আগুন দিয়েছে দূর্বৃত্তরা -পুড়ে গেছে পাহাড়িদের শুটকির দোকান, ছোট মুদি দোকান, ঔষধের দোকান, এসব।বোয়ালখালীর দিকে যেতে রাস্তার পাশের দোকানগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কৃষ্ণ এখনও তার পাড়াতে আছে লুটপাট ঠেকাতে। তার মতে খাগড়াছড়ির ঘটনার উত্তাপে দীঘিনালায় এসব ঘটছে।
পানছড়িতে কথা হলো রবিন এিপুরা নামের আমার আরেক পাহাড়ির (সূত্র) সাথে। সেও একটি আঞ্চলিক দলের ক্যাড়ার। পানছড়িতে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। স্বাভাবিক বলতে পাহাড়ি-বাঙালি নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে আছে। বাজারে দোকান সকাল থেকে খোলা ছিলো। এই পানছড়ি ১৯৮৬ সালে নালকাটা ম্যাসাকারের জন্য আন্তর্জাতিক হেডলাইনে পরিণত হয়েছিল। সেটা ছিলো সন্তুলারমা কর্তৃক একটি পরিকল্পিত গণহত্যার পাল্টা প্রতিক্রিয়া। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে পানছড়ি, তবলছড়ি, তাইন্দং, শনটিলা, কুমিল্লা টিলা, লোগাং- এসব স্থানে অরক্ষিত বাঙালি পাড়ায় রাতে ঘুমন্ত বাঙালিদের উপর সশস্ত্র আক্রমণ। ঘটনার দু’দিনের মাথায় বাঙালিরা সংগঠিত হয়ে পাল্টা আক্রমণে চেঙ্গীর পানিকে লাল করে দেয়।
এরপরে ১৯৯২ সালের মে মাসে লোগাং এ চেঙ্গী নদীর ধারে এক বাঙালি রাখাল বালকের গলাকাটা লাশ পাওয়াকে কেন্দ্র করে ঘটে গ্রেট লোগাং ম্যাসাকার। মধ্য দুপুরের তপ্ত সূর্যালোকের দাবদাহ বাঙালির মধ্যে তৎক্ষণাৎ সৃষ্টি করে ‘মব জাস্টিস’ মানসিকতা। অজ্ঞাত সংখ্যক পাহাড়ি মারা পড়ে। জেএসএস’র সুপরিকল্পিত মিডিয়া ক্যাম্পেইনে সন্তু লারমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল হয়। দেশের ভিতরে এবং বাইরে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারীরা আড়ালে পড়ে যায়। কাঠগড়ায় দাড়ায় বাঙালি ও সেনাবাহিনী। শেখ হাসিনা দ্রুত পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন, তার রাজনৈতিক বক্তব্য তৎকালীন বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে হলেও তিনি প্রকৃত সত্য না জেনেই যে বক্তব্য দেন তাতে পাহাড়ে নেতৃত্বহীন বাঙালিদের কোন কথাই তখন দেশের মানুষ জানতে পারেনি।
১৯৮৯ সালেও লংগদুতে একই ঘটনা ঘটে। ৪ মে (সম্ভবত) সন্ধ্যার একটু আগে তৎকালীন বাঙালি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে খুব কাছে থেকে গুলি করে হত্যা করে ব্যাপক বাঙালি-পাহাড়ি সংঘাতের সূচনা করা হয়।
উপরের সবগুলো ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য একটিই- ব্যাপক সংখ্যায় পাহাড়ি শরণার্থী সৃষ্টি করে ভারতে নিয়ে যাওয়া। যেন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইসূতে ভারতকে আরো দৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত করা যায়। সরকারকে চাপে ফেলা যায়। সেনাবাহিনীকে ব্যাতিব্যস্ত রাখা যায়। সেনাবাহিনী উৎপ্রীড়ক, খুনি রেপিস্ট’ এসব ট্যাগ লাগানো যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইসূগুলো এতই স্পর্শ কাতর যে, যেকোন সামাজিক বা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে সহজেই রাজনৈতিক রূপ দেওয়া যায়।
আজই কথা বললাম মমতাজ চাকমার সাথে। ভালোবেসে এক বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করেছে অনেক আগে। পানছড়িতেই থাকে স্বামীর সাথে। বললো, না তাদের এখানে এখন পর্যন্ত কোন সমস্যা হয়নি। বাঙালি-পাহাড়ি নেতৃত্ব যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যার যার সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ১৯৮৬-১৯৯২ সালের ঘটনা থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে -আর নয় হানাহানি।
ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পাহাড়িদের অংশগ্রহণ দেখিনি। কেন তারা অংশ নিবে? উপজাতির কোটার সিংহভাগই তো যেত তিনটি গোত্রে পাতে-‘চামাত্রি’। চাকমা- মারমা -এিপুরাদের ঘরে। আজ সে কোটা ০.৫% এ নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে। আর এই বৈষম্যকেই প্রতিবাদ করেছিলো নাথান বম- কুকি-চিন এর ব্যানারে। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের মিসহ্যান্ডলিং এর কারণে ওরা ভুল পথে পা বাড়ায়। ওরা সীমান্ত অতিক্রম করে মিজোরামে শরআর্থী হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের জন্য হাত ফসকে যাওয়া এক পাখি। একে খাঁচায় বদ্ধ করতে হলে সীমান্ত জুড়ে শরণার্থীর ঢল নামাতে হবে। ভারতের হাতে দু’টো কার্ড: ‘ সংখ্যালঘু’ আর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’।
আওয়ামী সরকারের সময় ভারতকে এ দুটো কার্ড খেলতে হয়নি। সন্তু লারমা নাথান বম বহু হুমকি-ধামকি দিয়েছে। ভারত মাতা নিরব ছিলেন। সন্তু লারমা আর তার ভাই এমএন লারমা ১৯৭২ সালে ভারতের সহায়তায় পার্বত্য চট্টগ্রামে একটা স্বাধীন জুম্মল্যান্ডের প্রস্তাব নিয়ে ইন্দিরার দ্বারস্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু সে অনুরোধে সাড়াতো দেয়নি বরং গোপনে বঙ্গবন্ধুকে এই লারমা ভ্রাতৃদ্বয়ের গোপন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেন।
তবে ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের পর দৃশ্য পটে হাজির হন ইন্দিরা। দিল্লিতে ডেকে নেন লারমা ভ্রাতৃদ্বয়কে। কি চাই তোমার??
পানছড়ির লোগাং সীমান্তের ভগবান টিলা নামক স্থানে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে খালাস হয় আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের ফেলে যাওয়া অস্ত্র গুলি। নগদ টাকাও পান লারমারা।
১৯৭৩ সালে দীঘিনালার বাজারে পোস্টার পড়েছিলো তৎকালীন শান্তি বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার সন্তুলারমা নামে:
“পাহাড়িরা অস্ত্র ধর বাঙালিরা পাহাড় ছাড়ো”
“বাঙালির রক্ত নাও পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন কর”
( তথ্য সূত্র: পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিবাহিনী জিয়া ও মঞ্জুর হত্যা, লেখক: মহিউদ্দিন আহমেদ)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কোন ঘটনা পিছনে একটা সাম্প্রদায়িক উস্কানি থাকে। কেউ কোন কর্মসূচি দিলে তা ভণ্ডুল করার জন্য অন্তর্ঘাতমূলক কাজ হয়।
রাঙামাটিতে সংঘাত -বৈষম্যবিরোধী মিছিলে কে বা কারা ঢিল ছুঁড়ে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করলো তা বুঝতে দেশের নানান প্রান্তে ৫ আগস্টের পরবর্তী কর্মসূচি গুলিতে কি ঘটেছিলো তা বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়।
শাহাবাগে হিন্দু ব্যানারে কারা নেমেছিলো?
খাগড়াছড়ি রাঙামাটিতে বৈষম্যবিরোধী ব্যানারে কারা সেনাবাহিনীর পায়ে পা লাগিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো? সারা দেশ জুড়ে যখন সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসিত তখন এরা ঢাকাতে মেট্রোরেলের পিলারে ‘কল্পনা চাকমার’ গ্রাফিতি একেঁ কি মেসেজ দিতে চায়? এরা ৩১ বছর আগে আন্তকলহে ‘রহস্যময় অন্তর্ধান’ কল্পনার খোঁজ চায়। কিন্তু ১৯৮৮ সালে খাগড়াছড়ির রাবার বাগান থেকে সন্তুর জেল সহযোগী চবাই মগের খোঁজ জানতে চায় না।
সেনাবাহিনী “উৎপীড়ক” প্রতিদিন শত শত পাহাড়ি নারী সেনাবাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ‘। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বয়ানে ভরে যাচ্ছে। অথচ এরাই কোটার সুবিধা নিয়ে সেনাবাহিনীর চাকরির কোটাগুলো খেয়ে ফেলছে।
পাহাড়ে আজ যা ঘটছে বা ঘটবে তার ফসল সীমান্তের ওপারে চলে যাবে। ভারতের মিডিয়াগুলো আজ তার স্বরে চিৎকার করবে -“গেল গেল”!
পাহাড়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ, ইসলামিকরণ হচ্ছে। ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীতে ব্যাপকহারে ইভানজেলিক খ্রিষ্টান কার্যক্রম বা গীর্জার ধ্বনি এরা দেখে না শুনে না। শুনে শুধু আজানের ধ্বনি।
শেষ মেষ কথা একটাই পাহাড় থেকে সেনাবাহিনীর প্রত্যাহার চাই। বাঙালিদের বহিষ্কার চাই। বাঙালিরা নাকি বহিরাগত। পাহাড়ের ৮০ শতাংশ বাঙালি পাহাড়ে জন্ম নেওয়া। স্বাধীন দেশে সে কিভাবে বহিরাগত হয়? নানিয়ারচরের সমাধীস্থলে শুয়ে থাকা বীরশ্রেষ্ঠ কি বহিরাগত?
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যা ঘটছে তা ১৯৭৬, ১৯৮৪, ১৯৮৬, ১৯৯২ ও ১৯৯৬ সালের ঘটনা প্রবাহের সাথে তুলনা যোগ্য।
পাহাড় অস্থিতিশীল হলে সরকার দুর্বল হবে তাই রাঙামাটিতে বাঙালির লাশ কালভার্টের নিচে পড়ে থাকে। তারই প্রতিক্রিয়ায় পাহাড়িদের দোকান পোড়ে বাড়ি পোড়ে। সীমান্তে জড় হবে শরণার্থী। তবেই না ইউনূসকে ফাঁদে ফেলে “চট করে ঢুকে পড়বো, আমি তো কাছেই আছি”!!