parbattanews

পার্বত্য পরিস্থিতি পরিকল্পিতভাবে উত্তপ্ত করা হচ্ছে : ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথক নয় ঘটনায় অপহরণ গুম খুনের শিকার ১৩ জন

12767749_1276438392372496_498259382_n

পার্বত্যনিউজ রিপোর্ট :

পার্বত্য চট্টগ্রামকে পরিকল্পিতভাবে উত্তপ্ত করার জন্য আঞ্চলিক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীরা চক্রান্ত করছে। আর এ কারণেই একের পর এক ঘটানো হচ্ছে অপহরণ, গুম, খুনের ঘটনা। বিচ্ছিন্নতাবাদী এই ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতেই চলতি ফেব্রুয়ারি মাসে এ পর্যন্ত পৃথক ৯টি ঘটনায় ১৩ জনকে অপহরণ, গুম ও হত্যা করেছে। এসব একটি সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই মনে করছেন পার্বত্য বিষয়ক গবেষক, বিশ্লেষকরা।

শুধু তাই নয়, একদিকে গুম, খুন এবং অপহরণ করে আতঙ্কময় করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামকে, অন্যদিকে ফেসবুক, বিভিন্ন ব্লগসাইটসহ বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা সৃষ্টিরও পাঁয়তারা করছে। তাই এ ব্যাপারে সরকার যথাযথ দৃষ্টি না দিলে এবং অপরাধীদের দমন করতে না পারলে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। এমনকি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে প্রশাসনের।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত পৃথক ৯টি ঘটনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে ১৩ জনের অপহরণ, গুম, খুন হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে এখন পর্যন্ত লাশ পাওয়া গেছে দুজনের, পালিয়ে আসতে পেরেছে একজন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কিংবা মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্তি পেয়েছে পাঁচ জন, খোঁজ নেই বাকি পাঁচ জনের।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার বড়ডলু মাস্টার পাড়ার বাসিন্দা মো. জয়নাল আবেদীনের পুত্র মো. মোরশেদ (২২) নিখোঁজ রয়েছে।পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দরিদ্র পরিবারের উদীয়মান যুবক মো. মোরশেদ (২২) প্রতিবেশী মো. ওবায়দুল হকের মোটর সাইকেল ভাড়ায় চালিয়ে আসছিল। প্রতিদিনের ন্যায় গত ৬ ফেব্রুয়ারী সকালে গাড়ী নিয়ে যাত্রী পরিবহনে যায়। এর পর থেকে নিখোঁজ রয়েছে মোরশেদ। ৮ ফেব্রুয়ারি মোরশেদের পিতা মো. জয়নাল আবেদীন মানিকছড়ি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী নং ২৮৪ তারিখ- ৮.২.১৬ খ্রি. রজু করেন। নিখোঁজ মোরশেদ ১০০ সিসি প্লাটিনা মোটর সাইকেল চালাত। গাড়ীর চেচিস নং-MD2A18AZ2FWD-38192, ইঞ্জিন নং-DZZWEDO1643 রং কালো। নিখোঁজ মোরশেদের পিতা মো. জয়নাল আবেদীন ও পরিবার পরিজনের ধারণা সন্ত্রাসীরা তাকে অপরণ করে নিয়ে হয়তো গুম করেছে! এতো দিন লুকিয়ে কিংবা আত্মগোপনে থাকার মতো ছেলে নয় মোরশেদ।

রাঙ্গামাটির লংগদু উপজেলার গাঁথাছড়া এলাকার বাসিন্দা জনৈক হাশেমের পুত্র আনোয়ার হোসেন (২৮) গত ৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার গাছ কেনার প্রয়োজনে বাঘাইছড়ি উপজেলার দূরছড়ি শিজকমুখ এলাকায় যান। কিন্তু শনিবার ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মোবাইলে তাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। রোববারা তার মোবাইল ফোনটি হঠাৎ সচল হয়। সেই ফোন থেকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা আনোয়ার তাদের জিম্মায় আছে এবং দুই লক্ষ টাকা মুক্তিপণ পেলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানায়। স্থানীয় সূত্রগুলো আনোয়ার অপহরণ হয়নি বলে জানালেও তার পরিবার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে লংগদু থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত আনোয়ারের খোঁজ পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে তার পরিবার।

৮ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটি সদরের রাজবন বিহারপুর থেকে নির্মানাধীন ব্রীজের কাজের শ্রমিক আব্বাস, ছোট মানিক ও বড় মানিক নামে তিনজন শ্রমিককে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় একটি উপজাতীয় সংগঠনের সন্ত্রাসীরা। ১৫ দিন নিখোঁজ থাকার পর রবিবার দিবাগত রাত ১১ টায় মুক্তি পেয়েছে রাঙামাটির তিন নির্মাণ শ্রমিক। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আড়াই লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেযেছে এই তিন নির্মাণ শ্রমিক। তবে রাঙামাটি সদর থানার ওসি মোহাম্মদ রশিদ  মুক্তিপণের কথা অস্বীকার করে জানান, প্রশাসনের চাপের মুখে অপহরণকারীরা শ্রমিকদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি কাপ্তাইয়ে পিকনিকে বেড়াতে এসে ২ গামেন্টর্স কর্মী অপহরণ হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম ইপিজেট ইয়াং ওয়াং পোষাক কারখানা হতে তিনটি বাস যোগে ১শ’ ১৮জন গামের্ন্টস কর্মী কাপ্তাইয়ে পিকনিকে আসে। পিকনিকে এসে গার্মেন্টর্স কর্মী সুখি চাকমা (১৮) ও কেয়া চাকমা (২০) কাপ্তাইয়ের আপস্ট্রিম জেটিঘাট এলাকায় দুপুর দেড়টার দিকে ঘুরাফেরা করার সময় কয়েকজন পাহাড়ী দুবৃর্ত্ত তাদের ইঞ্জিন চালিত বোটে করে উঠিয়ে নেওয়ার অভিযোগ করে সাথে থাকা অন্যন্যা গামের্ন্টস কর্মীরা। ঘটনাটি এলাকার প্রশাসন ও সকল গার্মেন্টস কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে সকলের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক দেখা দেয়।

এলজিইডির আওতায় পানছড়ি বাজার থেকে মরাটিলা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ কাজের জন্য স্থানীয় পাহাড়িরা চাঁদা দাবি করে আসছিল। এরই জের ধরে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি  সকালে পানছড়ি উপজেলার তালতলা এলাকা থেকে আল-ফালাহ্ ট্রেডিং কর্পোরেশনের ঠিকাদার সাইফুদ্দিন শাহিন গাজী ও ম্যানেজার মো. রুহুল আমিনকে অপহরণ করা হয়। তাদের মুক্তির জন্য বিভিন্ন সময় ৫০-২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবী করা হয় পহরণকারীদের পক্ষ থেকে। ২২ ফেব্রুয়ারি অহৃতরা মুক্তি পায়। তবে তারা মুক্তিপণ দিয়ে মুক্তি পেয়েছে নাকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সে ব্যাপারে ভিন্ন মত পাওয়া গেছে মাঠ পর্যায়ে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি  রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক এবং ওয়ার্ড সভাপতি প্রান্ত দাস পাহাড়ী কর্তৃক অপহরণের শিকার হন। অপহরণকরীরা প্রান্ত দাসকে মারধর করে অন্য এলাকায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পথিমধ্যে কৌশলে তিনি পালিয়ে চিৎমরম ইউপি সদস্যের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। পরে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা খবর পেয়ে তাকে চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থেকে নিখোঁজ হয় মো. আজিজুল হাকিম শান্ত (২৪) নামে ভাড়ায় চালিত এক মোটর সাইকেল চালক। মোটরসাইকেলসহ যুবক নিখোঁজের ঘটনায় শুক্রবার সকালে মাটিরাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়। পরে ২১ ফেব্রায়ারি নিখোঁজ হওয়ার চারদিন পর মাটিরাঙ্গা উপজেলাধীন রিছাং ঝর্নার কাছাকাছি দুর্গম পাহাড় থেকে মটরসাইকেল চালক আজিজুল হাকিম শান্ত‘র লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ধন বিকাশ ত্রিপুরা এবং খগেন্দ্র ত্রিপুরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ইতোমধ্যে শান্ত হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে বলে জানা গেছে।

বান্দরবানের রুমা সদরে লালুমিয়া খামার এলাকা থেকে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় ২০ ফেব্রুয়ারি এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এলাকাবাসী ও থানা পুলিশ জানায় প্রয়াত লালুমিয়া খামার এলাকায় একটি গাছে রশি বাধা অবস্থায় ঝুলন্ত লাশ দেখতে পেলে স্থানীয়রা থানা পুলিশকে খবর দেয়। রাতে পুলিশের পর্যবেক্ষণে রেখে পরদিন শনিবার বেলা সাড়ে ১০টায় থানা অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শরিফুর রহমান শফিক এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এসআই মোহাম্মদ আলমগীর নেতৃত্বে ঝুলন্ত লাশটি উদ্ধার করা হয়।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে মোটর সাইকেল চালক নিখোঁজের রেশ না কাটতেই আরো এক মাওলানা নিখোঁজ বলে জানা গেছে। রবিবার সন্ধায় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেন মাওঃ আবুবকর ছিদ্দিক এবং রাত ১০.৩০ মিনিটে তিনি অক্সিজেন গিয়ে পৌছান। অক্সিজেন পৌঁছানোর কিছু সময় পর তিনি ফোন করে জানান তাকে পুলিশে তুলে নিয়ে গেছে। কোথায় আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোথায় আছি বলতে পারি না তবে একটি গর্তের মধ্যে আছি মনে হচ্ছে এই কথা বলার পর ফোন কেটে যায়। ফোন কাটার পর থেকেই অপহৃতের মোবাইলটিবন্ধ রয়েছে। তবে অপহৃতের চাচাত ভাই মানিকছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম জানান, চট্টগামের বিভিন্ন থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন মাওঃ আবু বকর নামে পুলিশ কাঊকে আটক করেনি।

পার্বত্য চট্টগ্রামে একের পর এক ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারও চালানো হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে। হঠাৎ করেই ওয়েবসাইট, ব্লগ ও সামাজিক গণমাধ্যমগুলোতে  পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের বাংলাদেশ, বাঙালি, সেনাবাহিনী ও সরকার বিরোধী, বিদ্বেষমূলক, হিংসাপরায়ণ, সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পার্বত্যবাসী বিশেষ করে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলাদেশ, বাঙালী ও সরকার বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহলের মত।

মূলত: একের পর এক অপহরণ করে ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে পর্যটন মৌসুমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যটন খাত অচল করে দেয়া এর লক্ষ্য। ইতোপূর্বে পাহাড়ী সংগঠনগুলো তাদের ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের অংশ হিসাবে পর্যটনখাতকে অচল করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিল। কাজেই চলমান অপহরণ প্রক্রিয়া সন্তু লারমা ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের অংশ বলেই মনে কারছে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহল।

এর সর্বশেষ প্রমাণ গত ২১ ফেব্রুয়ারি মাটিরাঙ্গায় অপহৃত এক বাঙালী যুবকের লাশ উদ্ধারের পর দুপুর থেকে একাধিক ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে একটি অস্পষ্ট পুরাতন ছবি, সেনাবাহিনী ও বাঙালিদের জড়িয়ে নাম সর্বস্ব কিছু নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদের লিংক শেয়ার করা হয়। সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক এসব ছবি ও নিউজের লিংকগুলো এক আইডি থেকে অন্য আইডিতে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে একজনের ওয়াল থেকে অন্যজনের ওয়াল, ফেসবুক পেইজ ও গ্রুপে ভাসতে থাকে এসব ছবি ও সংবাদগুলো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞমহলের মতে, অচিরেই এ প্রবণতা রোধ করতে না পারলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের আগামী প্রজন্ম গড়ে উঠবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি আনুগত্যহীন ও প্রচণ্ড সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন হয়ে। তাই এ ব্যাপারে সরকার যথাযথ দৃষ্টি না দিলে এবং অপরাধীদের দমন করতে না পারলে যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় ধরনের বিপর্যয়। এমনকি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে প্রশাসনের।

Exit mobile version