উত্তপ্ত রাখাইন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সক্রিয় দালাল চক্র

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র সংঘাত চলছে আরাকান আর্মি ও সরকারের জান্তা বাহিনীর মধ্যে। তাদের তীব্র লড়াইয়ের কারণে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফের সীমান্ত এলাকা। এতে টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ঘুমহীন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। এরমধ্যে অন্তত ৩০ পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য মিলেছে। গত এক মাসে এই সব পয়েন্ট দিয়ে কমপক্ষে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে ধারণা করছে সীমান্তের মানুষ। তবে দায়িত্বশীল সংস্থার কাছে এর কোন সঠিক পরিসংখ্যা নেই।

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন জানিয়েছেন, মংডু শহরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল যুদ্ধ চলছে। ওই শহরে বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ান দখলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী আরকান আর্মি সদস্যরা। ব্যাটালিয়ান দুইটি রক্ষা করতে বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মর্টার শেল ও মিসাইল হামলা চালাচ্ছেন। এসবে বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ। আকাশে বিমানের চক্কর মর্টার শেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। এতে ঘুমহীন রাত আতঙ্কের মধ্যে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই পরিস্থিতির মধ্যে সীমান্তের ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বেড়েছে ক্রমাগত। বিজিবি ও কোস্টগার্ড বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে।

তিনি আরো জানান, অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ক্যাম্পে প্রবেশ করলেও অনেকেই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় লাখের কাছা-কাছি রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে রয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জড়ো রয়েছে হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের প্যারাংপুরু নামের এলাকায়।

সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেয়া তথ্য জানা যায়, আগস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত কম হলে ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ হয়েছে। টেকনাফের বেশির ভাগ জাদিমোরা, দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলির ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্ত সহ অন্তত ৩০ টি পয়েন্টে দিয়ে এসব রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে। মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় এই অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জনপ্রতিনিধি বলছেন, অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কিছু সংখ্যক বিজিবি সদস্যরা আটকও করেছে। গত শুক্রবার ভোরে শাহপরীরদ্বীপ থেকে অনুপ্রবেশের সময় আটক হওয়া রোহিঙ্গাদের বিজিবির একটি গাড়ি যোগে টেকনাফের দিকে নিয়ে যেতেও দেখেছেন তারা।

রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে নাফ নদী অতিক্রম করে অনুপ্রবেশে দালালের সহযোগিতার কথা স্বীকার করে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নজির আহমদ জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে কেবল কেরনতলি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় অনেক রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিজিবি এসব রোহিঙ্গাকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বলে জানতে পেরেছেন।

শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকারী কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে আলাপ হয়েছে প্রতিবেদকের। টেকনাফের একটি পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করা রোহিঙ্গা পরিবারের অনেক সদস্যই কান্না করছিলেন।

তারা বলেছেন, মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গা শূন্য। ওখানে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টার শেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। প্রাণ রক্ষায় যে যে দিকে পাচ্ছেন পালাচ্ছেন। দালালদের জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এখন ক্যাম্পে প্রবেশের চেষ্টা করছেন।

ওই সব রোহিঙ্গা বলছেন, লাখের কাছা-কাছি রোহিঙ্গা সীমান্ত জড়ো হয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন।

উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর এসেছে। নতুন করে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।

টেকনাফে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। ক্যাম্পে কঠোর নিরাপত্তা-ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরি বলেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, আগস্ট মাসের ৫ তারিখের আগে পরে বাংলাদেশের সরকার পতন পরিস্থিতিতে ৮ হাজার মত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। এটা পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বলেছে। এর পরেও কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য পাওয়া গেলেও তার সঠিক পরিসংখ্যা পাওয়া যায়নি।

বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, সীমান্তে বিজিবি কঠোর এবং সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। যারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে তাদের প্রতিহত করে ফিরে দেয়া হচ্ছে। অনুপ্রবেশের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য বিজিবির কাছে নেই।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন