parbattanews

উন্নয়নে মরা গাঙ্গ কোহেলিয়া, কপাল পুড়ছে স্থানীয়দের

কক্সবাজারের মহেশখালীর ঐতিহ্যবাহী কোহেলিয়া নদী ভরাট করে তৈরি হচ্ছে সড়ক। এতে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন নদীটি। বেকার হয়ে পড়ছে জেলে, মাঝি। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের বর্জ্য, বালি ও কাদা মাটির কারণে কোহেলিয়া নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় ওই নদী দিয়ে এখন নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কপালে হাত পড়েছে ট্রলার মালিক, লবণ ব্যবসায়ী ও মাঝিমাল্লাদের।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, উপকূলীয় অঞ্চল মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলার মধ্যবর্তী নদীর নাম কোহেলিয়া। এক কালের প্রমত্তা কোহেলিয়া নদী তার নিজস্ব স্রোত হারিয়ে এখন প্রায় মরা গাঙ্গে পরিণত হতে চলেছে।

দেখা গেছে, ড্রেজার মেশিন দ্বারা ধলঘাটার হাঁসের চর থেকে বালি এনে ভরাট কাজ চলছে। ফলে এ বালির অংশবিশেষ ও প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য কোহেলিয়া নদীতে এসে পড়ায় বর্তমানে গভীর এ নদী একেবারে ভরাট হয়ে গেছে। পূর্ণ জোয়ার ছাড়া নদীতে কোন ধরণের নৌযান চলাচল করতে পারে না। আবার জোয়ার হলেও গভীরতা কমে যাওয়ায় মাতারবাড়ি কোহেলিয়া নদীর উপর স্থাপিত ব্রিজের কারণে সকল ধরণের নৌযান ব্রিজ অতিক্রম করে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে না পারায় এখানকার লবণ ব্যবসায়ী, ট্রলার মালিক ও নৌযানের মাঝি-মাল্লারা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।

কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে চকরিয়া উপজেলা পেরিয়ে মহেশখালী দ্বীপ। দ্বীপের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর, একদিকে কোহেলিয়া নদী। নদীর ওপর বদরখালী সেতু। সেতুটি দ্বীপকে মূল ভূখন্ডের সঙ্গে বেঁধেছে। মাতারবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব দিকে কোহেলিয়া নদী, উত্তর দিকে উজানটিয়া নদী এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। এছাড়া ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে রাঙ্গাখালী খাল। প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ট্যাক্সি বা রিক্সা। এছাড়া তারা বেশি ভাগ নৌপথে এ ইউনিয়নে যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলে বাহাদুর। ১৬ জানুয়ারি কথা হয় তার সাথে। বর্তমান চিত্র তুলে ধরে বাহাদুর বলেন, কোহেলিয়া নদীর পাশেই আমার বাড়ি। আমার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরা। এখন কোহেলিয়া নদী ভরাট করে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য রাস্তা করছে যার কারনে নদী ছোট হয়ে গেছে। তাতে আমাদের এখন মাছ মারতে যেতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে। তিনি আরো বলেন, গত পরশু মাছ মারতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোস্ট গার্ড  আমার জাল নিয়ে কেটে ফেলেছে। এ কেমন বিচার?

মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে দেশের সর্ববৃহৎ কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য মাতারবাড়ীর দক্ষিণে ১৪১৪ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে বর্তমানে সেখানে মাটি ভরাট করে প্রকল্পের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। আর সে সব প্রকল্পের বিভিন্ন বর্জ্য ও পলি মাটিগুলো পাইপের মাধ্যমে সরাসরি কোহেলিয়া নদীর উপর ফেলায় দিন দিন ভরাট হচ্ছে এ নদীটি ।

অপরদিকে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য নদী ভরাট করে মাতারবাড়ী ব্রীজ থেকে দক্ষিণে প্রায় ৩০০ ফুট প্রস্থ বিশাল সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। সাড়ে ১৩ কিলোমিটার লম্বা এই সড়কটি ব্যবহার হবে শুধুমাত্র কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য। সড়কের জন্য ব্যয় হচ্ছে আনুমানিক সাড়ে ৬০০ কোটি টাকা। এই সকড়টি নির্মাণের কাজ করছে মীর আকতার হোসেন কনস্ট্রাকশন লিঃ নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ।

মাতারবাড়ীতে নির্মাণাধীন কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের পলি মাটি নদীর পানির সাথে মিশে গিয়ে বর্তমানে নদীর পানি ঘোলাটে এবং দূষিত হওয়ায় নদীর দু’পাশে প্রায় অর্ধশত চিংড়ি মাছের প্রজেক্টে প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে মাছ মারা যাচ্ছে ।

চিংড়ি প্রজেক্টের ইজারাদারদের প্রতি বর্ষা মৌসুমে শত কোটি টাকা লোকসান গুনতে হয়। চিংড়ি খাত থেকে সরকার প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশের চাকা সচল রাখলেও এনিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কোন মাথাব্যথা করছেনা। এমতাবস্থায় যদি কোহেলিয়া নদীটি হারিয়ে যায় তাহলে এক দিকে যেমন এ নদীর উপর নির্ভরশীল কয়েক হাজার জেলে পরিবারসহ অন্যান্য পেশার লোকজন যেমন বিভিন্ন ইঞ্জিন চালিত নৌ-যানে থাকা শ্রমিক, লবন শ্রমিক ও চাষীরা বেকারত্ব হবে। তেমনিভাবে নদীর উভয় পাশে থাকা শতাধিক চিংড়ি প্রজেক্ট গুলোতে মাছের দুর্দিন দেখা দিবে। এতে সরকারও বিশাল অংকের রাজস্ব হারাবে।

কোহেলিয়া নদী দিন দিন ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ায় জেলেদের জালে আগের মত তেমন আর ধরা পড়ছেনা সামুদ্রিক মাছ। ফলে বেকারত্ব ও অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে জেলে পরিবারগুলো। স্থানীয় জেলে হাসান বলছিলেন এসব কথা। আরাফাত নামের আরেক দিনমজুর বলছিলেন দুঃখের কথা। তিনি বলেন, এমনভাবে আমাদের রিজিক ধ্বংস করে ফেলবে ভাবতে পারি নাই। যেখানে আমরা জাল দিয়ে মাছ ধরতাম সেখানে এখন গাড়ি নিয়ে চলাচল করার জন্য সড়ক নির্মাণ কাজ চলছে।

বর্তমানে কোহেলিয়া নদীটি ভরাটের কারণে ভাটার সময় ছাড়াও পূর্ণ জোয়ারেও এখন বড় ও মাঝারি লবন বোটসহ বিভিন্ন ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচল করতে পারছে না। আগে এ নদীতে দেখা যেত পাঁচ হাজার মণ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন লবণের বোট চলাচল করতে। শুধু তাই নয়, এ নদীর উপর নির্ভরশীল বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস মাছ, কাঁকড়া ও লবন নিয়ে।

কোহেলিয়া নদী হারিয়ে যাওয়া মানে মহেশখালীর প্রায় লক্ষাধিক মানুষের জীবন জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাওয়া। নদীতে জেগে ওঠা চরগুলো একের পর এক খন্ড খন্ড ভাবে দখল করে নিচ্ছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ভূমি দস্যুরা। তারা প্রথমে ছোট ছোট বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের তৈরি করে। তার পর নদীর চর অবৈধ ভাবে দখল করে নেয়। ফলে দিন দিন ছোট হয়ে আসছে কোহেলিয়া নদী। এভাবে একের পর এক ভূমিদস্যুরা নদীর চর দখলে নিলেও এ নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের।

অন্যদিকে মাতারবাড়ী ব্রীজের উত্তর পাশে ব্রীজ লাগোয়া নদী থেকে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে গর্ত করে বালি বিক্রি করছে এক শ্রেণির স্থানীয় প্রভাবশালী কিছু মানুষ। এতে মাতারবাড়ীর একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম এ ব্রীজটি হুমকির মূখে রয়েছে বলে মনে করছে স্থানীয়রা ।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা কক্সবাজার জেলা সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, আমরা কোহেলিয়া নদী পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। দেখে অবাক হয়েছি। এমন একটি জীবন্ত সত্তা নদী ভরাট করে কিভাবে সড়ক তৈরি করতে পারে? আমাদের বুঝতে বাকি নেই নদী ভরাট করলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবেনা বিধায় তারা এই পথ বেঁচে নিয়েছে।

কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, মহেশখালীর কোহেলিয়া নদীসহ কক্সবাজারের সকল নদী নিয়ে আমাদের বিশাল পরিকল্পনা রয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের একটা মিটিং রয়েছে। এর পরেই বিস্তারিত বলা যাবে।

Exit mobile version