উপজাতি কি হীনজাতি?

আদিবাসী বিষয়ে দুই ধরণের সংজ্ঞা আছে। একটি আইএলও কনভেনশন ১৬৯ এ উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি বিশ্বের সামান্য কয়েকটা দেশ গ্রহণ করেছে। আরেকটি হচ্ছে- একাডেমিক সংজ্ঞা। যেটি আভিধানিক, ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক গবেষকগণ দিয়েছেন। এই সংজ্ঞাগুলো বিশ্বব্যাপী সর্বজন স্বীকৃত। বিশ্বের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এ সংজ্ঞাগুলো পড়ানো হয়। সেভাবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও পড়ানো হয়। এমনকি বাংলাদেশের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বাংলাদেশের ট্রাইবালদের আইএলও কনভেনশন ১৬৯ অনুযায়ী আদিবাসী দাবি করছেন তারাও স্টুডেন্টদেরকে এই সংজ্ঞাগুলো পড়ান এবং মার্কিং করেন।
বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা জোবাইদা নাসরিন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপিকা ড. সাদেকা হালিম, অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস এবং অন্যান্য এই ধারার শিক্ষকগণ যখন ছাত্রদেরকে আদিবাসী সংজ্ঞা পড়ান তখন আদিবাসী তত্ত্বের নৃতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও আভিধানিক সংজ্ঞাগুলো অস্বীকার করেন না। কেউ বলেন না, এগুলো পুরাতন, এগুলো বাতিল, বলেন না, যে এগুলো ভুল। যে সমস্ত ট্রাইবাল স্টুডেন্ট নৃবিজ্ঞান পড়ছেন তারাও আদিবাসী সংজ্ঞা যখন নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দেন তখন বলেন না যে, তারা ভুল করেছিল বা এগুলো এখনকার যুগে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তারা এগুলোই পড়ান এগুলোই লিখেন এবং এগুলো থেকেই নম্বর পান। সমগ্র বিশ্বের একাডেমিক পাঠ্যসূচিতে এগুলো রয়ে গেছে। কোন বিশ্ববিদ্যালয় এগুলোকে প্রত্যাহার করে নেয়নি। অর্থাৎ আদিবাসী বিষয়ে পৃথিবীতে দুই ধরনের সংজ্ঞা আছে। একটি আইএলও কনভেনশন থেকে পাওয়া, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গ্রহণ করেনি। আরেকটি একাডেমিক, যা বিশ্বের সকল দেশ ও সকল মানুষ গ্রহণ করেছে। আমরা সকল দেশ ও সকল মানুষের কথা বলছি।
বাংলা ভাষায় ‘গণমাধ্যম’ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ করা হয়েছে- mass media. জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে সংঘটিত mass killing এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে গণমাধ্যমে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু ‘গণহত্যা’ শব্দটির প্রকৃত ইংরেজি প্রতিশব্দ- genocide. কিন্তু ইংরেজি genocide ও mass killing শব্দ দুইটির অর্থগত পার্থক্য অনেক।
- আদিবাসী বিষয়ে লেখকের অন্যান্য লেখা:
- ♦ বাংলাদেশে আদিবাসী বিতর্ক
- ♦ বিশ্ব আদিবাসী দিবস ও বাংলাদেশের আদিবাসিন্দা
- ♦ আদিবাসী স্বীকৃতি দিতে সমস্যা কোথায়?
- ♦ আদিবাসী বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইনের ভুল ব্যাখ্যা ও অপপ্রয়োগ
- ♦ বাংলাদেশের উপজাতীয়রা আদিবাসী নয় কেন?
- ♦ কুকি-চিন জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের আদিবাসী নয়
- ♦ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করতে তথ্য বিবরণী জারী করেছে সরকার
- ♦ বাংলাদেশের উপজাতিদের ‘আদিবাসী স্বীকৃতি’ আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে
- ♦ বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী (পর্ব- ১)
- ♦ বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী (পর্ব- ২)
- ♦ বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী ( পর্ব-৩)
- ♦ বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী ( পর্ব- ৪)
- বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী (শেষ পর্ব)
বাংলা ভাষায় ‘উপপত্নী’ বলে প্রচলিত একটি শব্দ থাকলেও বাস্তবে বা প্রায়গিকভাবে উপপত্নীর কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই। মুসলিম আইন অনুসারে স্ত্রীর বাইরে কেবলমাত্র দাসীর সাথে যৌন সম্পর্ক করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও একাধিক পত্নী রাখার সুযোগ রয়েছে ইসলামী শরীয়তে। একজন পুরুষ একসাথে চারজন পত্নী রাখতে পারেন। কিন্তু এই চারজনই পত্নী। এদের কেউ উপ বা সহকারী পত্নী নয়। ডাকার সুবিধার্থে আপনি বড় পত্নী, ছোট পত্নী বা বড় বউ ছোট বউ ডাকতে পারেন, কিন্তু আইনে স্ট্যাটাস সমান। শরিয়া আইন অনুযায়ী পত্নী সিকি, আধা, কোয়াটার, থ্রি-কোয়াটার হয় না। অ্যাসিস্ট্যান্ট ওয়াইফ, ডেপুটি ওয়াইফ, অ্যাসোসিয়েট ওয়াইফ রাখার কোন সুযোগ নেই। বৌ বৌ ই। এর বাইরে যিনি আছেন তার পরিচয় দাসী। ভিডিও অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে, এই দাস প্রথা এখন হারাম। কাজেই যৌনসঙ্গী হিসেবে দাসী রাখার সুযোগ নেই। আবার যৌন সঙ্গী হিসেবে কাউকে নির্দিষ্ট করে কোথাও সংরক্ষণ করলে তাকে দাসী বলা হয় না। ইসলামী পরিভাষায় দাস বা দাসী একটি বিশেষ অবস্থা বোঝায়। এর কাছাকাছি যেটা সমাজে প্রচলন আছে তাকে রক্ষিতা বলা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে এই দাসী প্রথার কাছাকাছি এই রক্ষিতা প্রথার প্রচলন আছে। আগেকার রাজা, জমিদারগণ তাদের বাগানবাড়িতে রক্ষিতা রাখতেন। এখনকার শিল্পপতিরাও নাকি রক্ষিতা রাখেন। মাঝে মাঝে গণমাধ্যমে এমন নিউজ চোখে পড়ে। কিন্তু দাসী ও রক্ষিতা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। স্ত্রী বা পত্নী তো আরো অনেক দূরে। কাজেই উপপত্নী বলে কোন বস্তু আমাদের সমাজে কখনো বা কোন কালে ছিল না।
‘উপ’ শব্দটি আলাদা করে বাংলা ভাষায় একটি উপসর্গ। বাংলা ভাষায় এমন কতগুলো অব্যয়সূচক শব্দাংশ রয়েছে যা স্বাধীন পদ হিসেবে বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে না,এগুলো অন্য শব্দের আগে বসে এই শব্দগুলোকে উপসর্গ বলে। এটি কোন শব্দের পূর্বে বসে শব্দটির অর্থ পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা নতুন শব্দ তৈরি করে থাকে। যেমন- উপলক্ষ, উপবন প্রভৃতি। কিন্তু ‘উপ’ শব্দের অর্থ ছোট, হীন, নীচ এমন কোন ব্যাখ্যা আমি বাংলা ভাষায় কোথাও পাইনি। কাজেই আজকে যারা উপজাতি শব্দের অর্থকে ‘ছোট জাতি’ বা ‘নীচু জাতি’ ‘হীন জাতি’ বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, বা যাদের কাছে এরকম মনে হচ্ছে, তারা আসলে কীসের ভিত্তিতে দিচ্ছেন, বলছেন- আমার জানা নেই। এটা কি তাদের অজ্ঞতা, নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পক্ষপাত খতিয়ে করে দেখা যেতে পারে। যারা উপশব্দটির অর্থ ছোট বা ক্ষীণ বলে ব্যাখ্যা করছেন তাদের কাছে প্রশ্ন, উপলক্ষ অর্থ কি ছোট লক্ষ্য? উপহার অর্থ কি ছোট হার? উপকূল কি ছোট কুল?
উপনদী অর্থ ছোট নদী নয়। কোন নদী যখন অন্য কোন নদীর সাথে মিশে তাকে ঐ নদীর উপনদী বলা হয়। আবার কোন নদী থেকে যখন অন্য নদী সৃষ্টি হয় তখন ওই নদীকে উক্ত নদীর শাখা নদী বলা হয়। বাংলা ভাষায় ছোট নদীকে নদ বলা হয়, উপনদী নয়। ঠিক তেমনি উপবন অর্থ ছোট বন নয়। বনের অগ্রভাগ বা অংশবিশেষকে উপবন বলা হয়। উপগ্রহ অর্থ কোনো গ্রহকে ঘিরে ঘূর্ণায়মান আরেকটি গ্রহকে উক্ত গ্রহের উপগ্রহ বলে। উপসাগর অর্থ ছোট সাগর নয়, স্বতন্ত্র পরিচয়ধারী মহাসাগর বা সাগরের অংশবিশেষ। যেমন ভারত মহাসাগরের এক একটি বিশেষ অংশকে এক একটি নামে ডাকা হয় আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর, আন্দামান সাগর প্রভৃতি। স্বতন্ত্র নদীর মত এগুলো কোনো আলাদা সাগর নয়। মহাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্যধারী অংশকে উপমহাদেশ বলা হয়। উপমহাদেশ অর্থ ছোট মহাদেশ নয়। আবার উপধাতু শব্দের অর্থ ছোট ধাতু বা নিম্নমানের ধাতু নয়।
যেমন উপভাষা অর্থ কোন ক্ষুদ্র জাতির ভাষা বা নিম্ন শ্রেণীর মানুষের ভাষা অথবা কম মানুষ বলা ভাষা, ছোট ভাষা, নীচু ভাষা নয়, তেমনি উপজাতি শব্দের অর্থ নীচু জাতি, হীন জাতি নয়।
পলিটিক্যাল সাইন্সে নেশন বা জাতি গঠনে বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য ও উপাদানের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠী যখন বিশেষ কিছু উপাদান ও বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তখন তারা জাতি হিসেবে পরিচিত হয়। এই বৈশিষ্ট্য ও উপাদান নিয়ে আলোচনা করে বর্তমান লেখাটি দীর্ঘায়িত করতে চাইছি না। কিন্তু কোন বিশেষ জনগোষ্ঠীর ভিতরে যদি জাতি গঠনের এক বা একাধিক উপাদানের ও বৈশিষ্ট্যের অনুপস্থিতি থাকে তখন তারা উপজাতি হিসেবে আখ্যাত হয়। তবে ইংরেজি শব্দ mass killing এর সঠিক প্রতিশব্দ যেমন বাংলা গণহত্যা নয়। ঠিক তেমনি ইংরেজি tribe বা tribal শব্দের সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ উপজাতি হতে পারে কিনা তা নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হতে পারে। কেননা ইতিহাস সমাজবিজ্ঞান প্রত্নতত্ত্ব ও নৃবিজ্ঞানে tribal শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলায় উপজাতি শব্দটি তার পুরোপুরি কাভার করে কিনা তা নিয়ে আমার কিছুটা সন্দেহ রয়েছে।
এ সত্ত্বেও আমাদের দেশের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে পরিচিত করিয়ে আসছে। এই ঐতিহাসিক পরিক্রমায় এদেরকে কখনো উপজাতি শব্দের বিরোধিতা করতে দেখা যায়নি। কিংবা উপজাতি পরিচয় দিতে তাদের মধ্যে কোন হীনবোধ বা হীনমন্যতা পরিলক্ষিত হয়নি। উদাহরণ হিসেবে যখন শান্তি চুক্তি হয়েছে তখন পার্বত্য চট্টগ্রাম কে একটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসাবে এরাই স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়াও ৫২ টি উপজাতি বা উপজাতীয় শব্দ সম্বলিত এই চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন তাদের নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বদ্রিপ্রিয় লারমা যিনি সন্তানের নামে খ্যাত। শান্তি চুক্তির সময় এই ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এই চুক্তির বিভিন্ন ধারা ও শর্ত নিয়ে বিরোধ করে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু এই বিরোধ বা বিভক্তির শর্তগুলোর মধ্যে কোথাও উপজাতি শব্দ পরিবর্তন বা আপত্তি লক্ষ্য করা যায়নি। এতে অন্তত এটা পরিষ্কার যে অন্তত ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর নিজেদেরকে উপজাতি পরিচয় দিতে দীনবন্ধু বোধ করেননি।
কিন্তু 1997 সালের অনেক আগেই কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন চায়ের তাদের আদিবাসী ও ট্রাইবাল বিষয়ক কনভেনশন-১৬৯ উপস্থাপন করেছে। এই কনভেনশনেই ইন্ডিজেনাস ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর নতুন সংজ্ঞা উপস্থাপন করা হয়েছে যেটা অনুসরণ করে আজকে তারা নিজেদেরকে আদিবাসী দাবি করছেন। অর্থাৎ আমরা একথা বলতে পারি যে আইএলও কনভেনশন ১৬৯ যাতে আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা উপস্থাপিত হওয়ার পরও বাংলাদেশের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবি করেনি এমনকি তারও প্রায় এক দশক পরে নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে আখ্যাত করে চুক্তি করেছে।
এছাড়াও আরো একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, বাংলাদেশ যে ৪৫ টি জনগোষ্ঠীকে উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বলে আখ্যা দিয়েছে তার মধ্যে মাত্র ১৩ টি পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাস করে বাকিরা সমতলে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী অধিকাংশ মানুষ সমতলে বসবাস করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ট্রাইবাল বা জন জাতির মধ্যে আদিবাসীর দাবি সমতল থেকে আসেনি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছে এখনো এই দাবি লিড দেয়া হচ্ছে বা প্রমোট করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বা পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে। সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে এই জাতি এই দাবি এতটা উচ্চকিত নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনাপ্রবাহের উপর লেখা পাহাড়ী লেখকদের লিখিত বিভিন্ন পুস্তক থেকে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী উপজাতি হিসেবেই স্বীকৃত হয়ে আসছিলেন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলো কবে থেকে এই দাবি শুরু করেছে। মূলত ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ইউনাইটেড ডিক্লিয়ারেশন অফ ইন্ডিভিজনেস পিপল অনুমোদনের পর থেকে বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু চিহ্নিত গোষ্ঠীর তরফ থেকে এই দাবি তোলা শুরু হয়। তবে ব্যাপকভাবে এই দাবি জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে বিগত পাঁচ ছয় বছরে।
আমার দীর্ঘ অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণে আমি দেখেছি এই দাবির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউনাইটেড নেশন ডিক্লিয়ারেশন অফ ইন্ডিজ পিপলস এর মধ্যে থাকা কিছু শর্ত এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য পাশ্চাত্যের বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ। বাংলাদেশে এই দাবি নিয়ে যে প্রবল আন্দোলন বা বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয় এর পেছনে বিপুল অর্থের সরবরাহ জড়িত রয়েছে। এ নিয়ে আমি অতীতে অনেক আলোচনা করেছি।
এখন উপজাতি বললে বা শুনলে যাদের উপপত্নী জাতীয় কিছু মনে হয়, অনুভূতি হয়, হীনবোধ হয়, নীচু বা ছোট জাতের মনে হয়; এখন তাদের প্রশ্ন করা যায়, ‘অ-উপজাতি’ শুনলে আপনাদের কী মনে হয়, কী অনুভূতি জাগে? পার্বত্য চট্টগ্রামের আদি বাঙালি, মুঘল আমলে, ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান আমলে প্রত্যাবাসিত বাঙালি এবং ৭০ দশকের শেষে ও আশির দশকের শুরুতে প্রত্যাবাসিত বাঙ্গালীদেরকে তাদের নাগরিক সনদে লেখা হয় আ-উপজাতি। এই বাঙ্গালীদের জন্য আপনার অনুভূতি কী? নাকি আপনার অনুভূতি কেবলই একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য- এ প্রশ্ন করাই যায়।
তবে যে কোনো কারণেই হোক, শত শত বছর ধরে উপজাতি পরিচয় দিয়ে আসা বাংলাদেশের ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী যদি এখন নিজেদের উপজাতি হিসেবে পরিচিত করাতে হীনবোধ করে তবে সেটা একান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। আমি জোর করে তাদের উপজাতি অভিহিত করতে বা তাদের পরিচিতি হিসেবে উপজাতি শব্দ বলপূর্বক আরোপ করার পক্ষপাতি নই। এই প্রক্রিয়ারই পরবর্তী ধাপ হিসেবে তারা যদি তাদের নিজেদের নতুন কোনো পরিচয়ে পরিচিতি করাতে বা স্বাচ্ছন্দ বোধ করতে চান তাতেও আমার খুব বেশি আপত্তি নেই। কিন্তু তাই বলে তারা যদি আমার পরিচয় কেড়ে নিয়ে নিজেদের পরিচিতি করাতে চান তাহলে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ধরুন কোনো ব্যক্তি শত শত বছর ধরে তার নিজের যে বাড়িতে বসবাস করতো, হঠাৎ তার মনে হলো, বাড়ি পরিবর্তন করবেন। করতেই পারেন। কিন্তু আরেকজনের বাড়ি নিজের বাড়ি বলে মূল বাড়িওলাকে ভূয়া বলে দখল করে বসবাস করতে চাইলে কেউ সেটা মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশে বাঙালিরাই আদিবাসী। পাহাড়িরা যদি উপজাতি পরিচয় দিতে অপছন্দ করেন তবে তারা তাদের ভিন্ন পরিচয় যেমন, জনজাতি ইত্যাদি গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে বাঙালির পরিচয় আদিবাসী কেড়ে নিয়ে নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দিবেন এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
♦ লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।