উপেক্ষিত পার্বত্য বাঙালির সাংবিধানিক অধিকার

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিক বৈষম্য নিয়ে লিখতে গেলে কোনটা ছেড়ে কোনটা দিয়ে শুরু করবো সেটা ভেবে তালগোল পাকিয়ে যায়? যেহেতু ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে স্বাক্ষরিত ‌পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭’ মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইনসমূহ সংশোধিত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসিত হচ্ছে, তাই এই চুক্তি থেকে শুরু করায় শ্রেয় মনে হচ্ছে! এই চুক্তির ভূমিকায় লিখা আছে “বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতার প্রতি পূর্ণ ও অবিচল আনুগত্য রাখিয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সকল নাগরিকের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও অর্থনৈতিক অধিকার সমুন্নত এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা এবং বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্ব স্ব অধিকার সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক জাতীয় কমিটি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অধিবাসীদের পক্ষ হইতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নিম্নে বর্ণিত চারি খণ্ড (ক, খ, গ, ঘ) সম্বলিত চুক্তিতে উপনীত হইলেন”। এই ভূমিকা বা প্রারম্ভ পড়ে যতোটা মন ভরে ওঠে, চুক্তির অধিকাংশ ধারা এই প্রারম্ভ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর সংবিধানের সাথে মিলিয়ে পড়তে গেলে এর চেয়ে একশ গুণ বেশি মন হতাশ হয়ে যায়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সমস্যার মূলেই হলো ভূমি সমস্যা, এই ভূমি সমস্যা সম্পর্কে চুক্তির ঘ খণ্ডের ধারা ৩ এ বলা আছে উপজাতীয় পরিবারগুলোর ভূমির মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে পরিবার প্রতি ২ একর ভূমি বন্দোবস্ত প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। বিপরীতে পুনর্বাসিত বাঙালির ভূমি বা একটি ভিটে প্রাপ্তি কিংবা পুনঃ পুনর্বাসিত করার বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ নেই! চরমভাবে পুনর্বাসিত বাঙালি বিদ্বেষী বিভিন্ন লেখক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের গোপনীয় মেমো নং ৬৬৫-গ, তারিখ ০৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮০ এর বরাত দিয়ে বিস্তারিতভাবে লিখে দাবি করেছেন যে, সরকার সর্বমোট ১১.৫ একর ভূমি বন্দোবস্ত প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আশির দশকের শেষ হতে বিপুল পরিমাণ ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত করেছে। আজকের দিনের বাস্তবতা হলো শান্তিবাহিনীর হাতে হাজারে হাজারে হত্যার শিকার হওয়ার পর এসব বাঙালি পরিবারের অধিকাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি মালিকানা বিহীনভাবে দলবদ্ধ মানবেতর জীবনযাপন করছে। এদেরকেও ভূমি প্রদান বা যথাযথ পুনর্বাসন সংক্রান্ত কোন শব্দ চুক্তিতে থাকা উচিত ছিলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি সমস্যার মূল কারণ হলো ব্রিটিশ শাসনামল থেকে আজ অবধি চলে আসা সামন্তবাদ ও সামন্ত প্রভু তোষণ, এই পার্বত্য চুক্তিতেও সেটার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি! চুক্তির ঘ খণ্ডের ৮নং ধারায় বর্ণিত আছে, “রাবার চাষ ও অন্যান্য জমি বরাদ্দঃ যে সকল অ-উপজাতি ও অ-স্থানীয় ব্যক্তিদের রাবার বা অন্যান্য প্লান্টেশনের জন্য জমি বরাদ্দ করা হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে যাহারা গত দশ বছরের মধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করেন নাই বা জমি সঠিক ব্যবহার করেন নাই সেসকল জমির বন্দোবস্ত বাতিল করা হইবে।” অর্থাৎ পাহাড়ি কোন সামন্ত প্রভু যদি ৫০০ একর বা আরও বেশি ভূমি বন্দোবস্ত/ইজারা নিয়ে কিছুই না করেন, তারপরও তাঁর ভূমি বন্দোবস্ত বা ইজারা বাতিল হওয়ার সুযোগ নেই! উপরন্তু দ্য চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন, ১৯০০ ব্যতিত পার্বত্য চট্টগ্রামে অন্য কোন ভূমি আইন বলবৎ নেই। হিল রেগুলেশন কিংবা পার্বত্য চুক্তির কোথাও ব্যক্তি বা পরিবারের নামে ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ কোন সীমা উল্লেখ নেই, উল্টো রয়েছে পাহাড়ি সামন্ত প্রভুদের ভূমি মালিকানা ও কর্তৃত্বের ব্যাপক সুরক্ষা!

আমাদের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদ আছে, “সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী”। ২৮ নং অনুচ্ছেদে বিশদভাবে আছে ধর্ম, প্রভৃতি কারণে বৈষম্য না করার বাধ্যবাধকতা, একজন সামন্ত প্রভু কখনো অনগ্রসর বিবেচিত হতে পারেন না বিধায় এখানে অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এর বিশেষ ব্যবস্থা সে প্রাপ্য হতে পারে না, অন্তত বিশাল পরিমাণে ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে। অথচ, পার্বত্য চুক্তিতে পাহাড়ি সামন্ত প্রভুদের সুরক্ষার জন্যই করা হলো চরম অনিময় এবং অবাক করা বিষয় হলো সামন্তবাদকেই আবার জাতি ধর্মের ভিত্তিতে বিচার করা হয়েছে। এই ধারা আক্ষরিক অর্থে চুক্তি স্বাক্ষরের সাথে সাথেই পাহাড়ি সামন্ত প্রভুদের স্বার্থ সুরক্ষিত করেছে এবং অ-উপজাতি ও অ-স্থানীয় সামন্ত প্রভুদেরকে মূলত সতর্ক বার্তা দিয়েছে। গভীরে চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে যে, সকল বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে পাহাড়ি ভূমিহীন বা সকল ভূমিহীনের ভূমির মালিকানা পাওয়া চরম আপেক্ষিক হয়েই রইলো!

চুক্তির খ খণ্ডের ৩নং ধারায় প্রদত্ত অ-উপজাতি বাসিন্দার সংজ্ঞা সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬ এবং দ্য সিটিজেনশীপ এ্যাক্ট, ১৯৫১ এর সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে একজন বাঙালি পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হওয়ার জন্য অত্যন্ত কঠিন শর্ত আরোপ করেছে বলে প্রতীয়মান। পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করার পরও ভূমি সমস্যার মারপ্যাঁচে একজন নাগরিকের পার্বত্য চট্টগ্রামে নাগরিকত্ব স্বীকৃত না হওয়া কীভাবে ন্যায্য হতে পারে? নাগরিকত্ব আইন ও সংবিধানের কোথাও ভূমির মালিকানা নাগরিকত্বের শর্ত হিসেবে আছে বলে জানা নেই, আবার ধর্ম ও গোত্রের ভিত্তিতে ভূমিহীন পাহাড়ি নাগরিক কিন্তু ভূমিহীন বাঙালি নাগরিক নয় বিবেচিত হলে এখানে বাঙালি ব্যক্তিটির সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ এ প্রদত্ত অধিকারের লংঘন নয় কি?

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ এ আছে “প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে”, অনুচ্ছেদ ১২’তে আছে ধর্ম নিরপেক্ষতা বজায় রাখার নির্দেশনা, অনুচ্ছেদ ১৯ (১) ধারায় বলা আছে, “সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন”, অনুচ্ছেদ ১৫’তে বর্ণিত আছে নাগরিকের মৌলিক প্রয়োজন পূরণে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য, অনুচ্ছেদ ২৯ (১) এ বর্ণিত আছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে”, অনুচ্ছেদ ২৯ (২) এ বর্ণিত আছে, “কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভে অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাঁহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না”। অথচ, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আওতায় জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল প্রকার শাসনতান্ত্রিক নিয়োগ ও সরকারি চাকুরিতে নিয়োগে দুই তৃতীয়াংশ উপজাতিদের অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা কোন শীর্ষে পদে নিয়োগে বাঙালির সমঅধিকার দূরে থাকুক, নিয়োগের সুযোগই রাখা হয়নি! এখানে অনেকগুলো সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লংঘনের প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। এখন যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি ও বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী সমান সমান সেক্ষেত্রে এই আসন সংরক্ষণের হার পুনঃ বিবেচনা করা প্রয়োজন নয় কি?

চুক্তি স্বাক্ষরের ২৭ বছর পরও চাকুরি ও শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রদত্ত কোটা পুনঃ বিবেচনা করে কোন কোন জনগোষ্ঠীর অনগ্রসর অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে এবং কারা এতো বছরেও কোটার সুবিধা পায়নি ও কেন পায়নি, এগুলো মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে না কেন? সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিগত ২৭ বছরে এই অগ্রাধিকার কোটার সুফল প্রান্তিক উপজাতিদের নিকট পৌঁছেছে কিনা সেটা কেন খতিয়ে দেখা হবে না? উপজাতি কোটা যদি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বড় বড় পদে কর্মরত থেকে শহরে বসবাসকারী কর্মকর্তা ও ভূস্বামী এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গের বংশধরগণের ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার, সামরিক কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও বিসিএস ক্যাডার হতে কিংবা সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ পেতে কাজে আসে, তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে কোটা সুবিধা প্রদানের বিধান কেন নয়? এরকম কোন ব্যবস্থা ব্যতিত আশানুরূপভাবে প্রান্তিক পাহাড়িদের নিকট সরকার প্রদত্ত বিশেষ ব্যবস্থার সুফল কি কোন দিনও পৌঁছাতে পারবে?

এই সংক্রান্তে শান্তি চুক্তিরও আগে অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন প্রয়াত প্রথা বিরোধী লেখক হুমায়ূন আজাদ, তিনি লিখেছেন, “যে তেরটি উপজাতি পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস করেন, তাঁরা সবাই সমানসংখ্যক যেমন নন, তেমনি সমান অগ্রসরও নন; এবং সবাই একাত্মও নন। তাঁদের সমাজ স্তরে স্তরে বিন্যস্ত; সবার ওপরে রাজারা (রাজা তিনজন- চাকমা, মোং, বোমাং), আর সবার নিচে সাধারণ মানুষ। ওই সাধারণ মানুষদের ওপর আছেন পাড়া/গ্রামের প্রধান ‘কারবারি’রা, তাদের ওপর মৌজার প্রধান ‘হেডম্যান’রা; এবং তাঁদের ওপরে অভিজাতমণ্ডলি, যারা রাজা, রাজপুত্র, রাজকন্যা, দেওয়ান এবং চেয়ারম্যান, সাংসদ, মন্ত্রী, উপদেষ্টা ইত্যাদি। অভিজাতমণ্ডলি ধনী, তারা নানাভাবে সম্পর্কিত;- একই পরিবারের কেউ হয়তো স্থানীয় পরিষদের চেয়ারম্যান, কাকী হয়তো প্রাক্তন সাংসদ, মামা হয়তো বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু। তাঁরা রাষ্ট্রীয় সুযোগসম্মান বেশ ভোগ করেন, সরকারি পার্টিতে সুন্দরভাবে কথা বলেন, চমৎকার কাটা চামচে খান, ইংরেজিতে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতে পছন্দ করেন।”

শান্তি চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সমূহকে একটি সাধারণ পরিচয় “উপজাতি”তে আবদ্ধ করে সকল সুযোগ সুবিধা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ হাস্যকরভাবে ঐ একই চুক্তিতে চাকমা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে সকল ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহকে অলিখিতভাবে চাকমাদের অধীনস্থ করে দেওয়া হয়েছে, এটার যৌক্তিকতা ও নিশ্চয়তা সৃষ্টি হলে কোথা হতে? “উপজাতি” হিসেবে নির্ধারিত শাসনতান্ত্রিক নিয়োগগুলোতে গোত্রগত শ্রেণি বিভাগ চরমভাবে বিদ্যমান! সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(৪) এবং ২৯ (৩) এ পিছিয়ে পড়া ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ বিধানের সুরক্ষা দিচ্ছে, কিন্তু অবশ্যই সেটা এতো ব্যাপক ও বিশাল আকারে সকল ক্ষেত্রে হওয়ার কথা নয়, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো যেই প্রান্তিক উপজাতিদের জন্য এতো সুবিধা প্রদানের কথা বলা হচ্ছে, গত ২৭ বছরে সেটা পাহাড়ের সামন্ত প্রভুদের ডিঙ্গিয়ে তাদের নিকট তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে পৌঁছাতে পারার কোন চিহ্ন মোটেই দৃশ্যমান নয়।

আবার সংবিধানের ২৬ নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকারের সহিত অসমঞ্জস আইন বাতিল হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ আছে, অর্থাৎ চাকরিতে নিয়োগ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে যৌক্তিক মাত্রা ব্যতিত এতো ব্যাপক হারে বিশেষ বিধানের মাধ্যমে পার্বত্য বাঙালির মানবাধিকার ও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার সীমিত করার কোন বৈধতা সাংবিধানিকভাবে সৃষ্টি হতে পারে কি না তা গভীরভাবে বিবেচ্য!

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ এ মৌলিক অধিকার হিসেবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার এর কথা বর্ণিত আছে, অথচ “পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি-বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১৬) এর ধারা ১৬’তে বলা আছে কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন আপীল করা যাইবে না”, ধারা ৭(৫) বর্ণিত আছে চেয়ারম্যানসহ উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের গৃহীত সিদ্ধান্তই কমিশনের সিদ্ধান্ত বলিয়া গণ্য হইবে। আবার ঐ আইনের ধারা ৩ (২) মোতাবেক বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন কমিশনের চেয়ারম্যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান বা তাঁর প্রতিনিধি হলেন সদস্য, সংশ্লিষ্ট জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হলেন সদস্য, সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফ বা তার মনোনীত প্রতিনিধি হলেন সদস্য এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার বা মনোনীত একজন অতিরিক্ত কমিশনার হলেন সদস্য। এখানে কমিশনের চেয়ারম্যান সহ মোট ৫ জনের মধ্যে একজন সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং একজন গণকর্মচারীকে বাঙালির প্রতিনিধি মনে করার সুযোগ কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা বাকি তিন জন সদস্য নিশ্চিতভাবে উপজাতি হবেন বিধায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মতামত প্রদানে সমতা এবং পার্বত্য বাঙালির ন্যায় বিচার প্রাপ্তির জন্য নিশ্চয়তা বা প্রতিনিধিত্ব কোথায়?

যেহেতু কোন আপলি করা যাবে না, সেক্ষেত্রে মূলত উপজাতি জনপ্রতিনিধি অধ্যুষিত ও প্রভাবিত কমিশন কর্তৃক বিচারে পার্বত্য বাঙালির বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার কীভাবে সুরক্ষিত হবে তা অবশ্যই আরো পরিস্কারভাবে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। তাই কমিশনে সমান সংখ্যক পার্বত্য বাঙালির প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টির যৌক্তিকতা স্পষ্ট প্রতীয়মান। এই আইন সম্পর্কিত আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এতে “পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি” এর ভিত্তিতে অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। কিন্তু রীতি ও পদ্ধতির সুনির্দিষ্ট কোন ব্যাখ্যা দেয়া নেই।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সংবিধানের ৩৪(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ, আবার The Chittagong Hill Tracts Regulation, 1900 এর বিধি ১৮ এর অধীনে প্রণীত Rules for the Administration of the CHT Regulation এর বিধি ৪২ক মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামে মাত্র কয়েকটি শ্রেণি ব্যতিত বাকি সকল ৪৫ বছরের নিচের বয়সের পুরুষকে শ্রমে বাধ্য করার বৈধতা আছে! আবার ঐ আইনের মূল অংশে বিধি ৪ এ বলা আছে এই আইনের তফসিল অনুমোদিত আইন ব্যতিত কোন আইন পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য হবে না, তবে সরকার প্রয়োজন মনে করলে যে কোন আইন বা সেটার অংশ বিশেষ গেজেট/নোটিফিকেশন এর মাধ্যমে জারী করতে পারবে, এই তফসিলে আইন অনুমোদিত আছে প্রায় ২৫০টির মতো, যার অধিকাংশ কম গুরুত্বপূর্ণ, অথচ বাংলাদেশে আইন জারী আছে ২০০০ এর চেয়েও অনেক বেশি!

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১ এ বর্ণিত হয়েছে, ” বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” নামে পরিচিত হইবে।” অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির খ খণ্ডের ধারা ৩২ এ বর্ণিত হয়েছে, “৭৯ নম্বর ধারা সংশোধন করিয়া নিম্নোক্তভাবে এই ধারা প্রণয়ন করা হইবেঃ পার্বত্য জেলায় প্রযোজ্য জাতীয় সংসদ বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত কোন আইন পরিষদের বিবেচনায় উক্ত জেলার জন্য কষ্টকর হইলে বা উপজাতীয়দের জন্য আপত্তিকর হইলে পরিষদ উহা কষ্টকর বা আপত্তিকর হওয়ার কারণ ব্যক্ত করিয়া আইনটির সংশোধন বা প্রয়োগ শিথিল করিবার জন্য সরকারের নিকট লিখিত আবেদন পেশ করিতে পারিবে এবং সরকার এই আবেদন অনুযায়ী প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করিতে পারিবে।”

উল্লখ্য যে, এখানে পরিষদ বলতে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিন জেলার তিনটি জেলা পরিষদ কে বুঝানো হয়েছে। তাই অনেক বিশেষজ্ঞ হয়তো ভাবছেন “গণপ্রজাতন্ত্রী” শব্দটি সরিয়ে অন্য কোন শব্দ নিয়ে আসলে এবং প্রাদেশিক সরকার বা সায়ত্তশাসন টাইপ কিছু সংবিধানে ঢুকিয়ে দিলে হয়তো সমস্যা মিটে যাবে! এটা তাদের নিতান্তই একপক্ষীয় ভ্রম মাত্র। মোটাদাগে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান যে, বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংখ্যার ঠিক অর্ধাংশ পার্বত্য বাঙালির সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার এবং সাংবিধানিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা না হলে সাংবিধানিক সংকট নিরসন হওয়ার পরিবর্তে বৃদ্ধির পাওয়ার আশঙ্কাই হয়তো অনেক বেশি!

লেখক: পার্বত্য চট্টগ্রাম গবেষক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন