একে একে চলে যাচ্ছেন বরেণ্য নায়করা

fec-image

একে একে পরপারে পাড়ি জমাচ্ছেন দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে অত্যন্ত দাপটের সঙ্গে বিচরণ করা সোনালি যুগের ষাট-সত্তর দশকের তারকা নায়করা। সর্বশেষ মারা গেলেন ‘মিয়া ভাই’খ্যাত ‘সুজন সখি’র নায়ক আকবর হোসেন পাঠান দুলু ওরফে ফারুক। সিঙ্গাপুরের মাউন্ড এলিজাবেথ হাসপাতালে দীর্ঘ আট বছর আসা-যাওয়া, চেকআপ, চিকিৎসা শেষে ১৫ মে সোমবার সকাল ১০টায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

’৭০-এর একেবারে শুরুতে আসা ফারুকের ক্যারিয়ার এতটাই বর্ণাঢ্যময় ছিল, সমসাময়িক কোনো নায়কই সেটা অর্জন করতে পারেননি। কেননা, চলচ্চিত্র তারকা হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ঢাকা-১৭ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার গৌরব করেছেন। তবে টিভি তারকাদের মধ্যে আসাদুজ্জামান নূর শুধু এমপিই নন, পূর্ণ মন্ত্রী হওয়ারও গৌরব অর্জন করেছেন।

সিনেমার প্রধান চরিত্রই হচ্ছে নায়ক ও নায়িকা। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রির অধিকাংশ সিনেমাই নায়কনির্ভর। নায়ক মানেই তার নায়িকাও থাকতে হবে। ষাটের দশক থেকে আজ অবধি নায়ক ছাড়া সিনেমা কল্পনাও করা যায় না। এই নায়ক হিসেবে কেউবা এশটি-দুটি সিনেমা করেই হারিয়ে গেছেন আবার কেউ কেউ তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন বছরের পর বছর।

ষাট ও সত্তর দশকে যেসব নায়ক তারকা খ্যাতি পেয়েছেন প্রত্যেকেই যার যার জায়গায় লিজেন্ড। সেই তারকা নায়কদের একে একে প্রায় সবাই যখন পৃথিবী ছাড়ছেন তখন তাদের নায়িকারা (ব্যতিক্রম কবরী, করোনার ছোবলে মৃত্যু হয়) প্রায় সবাই পর্দার বাইরে সুন্দর সুস্থভাবেই দিন যাপন করছেন।

ফারুকের আগে তারই সমসাময়িক ঢাকাই চলচ্চিত্রের আরেক যুবরাজ ওয়াসিম। পারিবারিক নাম মেজবাহউদ্দিন আহমেদ। ১৫২টি সিনেমার এই অভিনেতাও নায়ক জীবনে পার করেছেন এক বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার। ‘দি রেইন’খ্যাত এই অভিনেতা যতটি সিনেমা করেছেন প্রায় সবই ছিল ব্যবসা সফল। ওয়াসিম পৃথিবী ছাড়েন দু’বছর আগে করোনাকালে ২০২১ সালের ১৮ এপ্রিল।

ঢাকাই সিনেমার রোমান্টিক হিরো নায়করাজ রাজ্জাক। ঢাকাই সিনেমায় নায়িকা সুচন্দার বিপরীতে ষাট দশক থেকে যাত্রা করা এই অভিনেতার ক্যারিয়ার ছিল অনেক বর্ণাঢ্য ও উজ্জ্বল। অনেক কালজয়ী সিনেমার অভিনেতা রাজ্জাক শুধু অভিনয়েই নন, প্রযোজনা ও পরিচালনায়ও পেয়েছেন অভাবনীয় সাফল্য। এদেশের ইতিহাসে তিনিই প্রথম অ্যাকশন সিনেমার প্রযোজনা করেন। ‘রংবাজ’কে অ্যাকশন সিনেমা বললেও কম বলা হয়। এখনকার অবাস্তব ও আজগুবি অ্যাকশনমুক্ত এই সিনেমাটি ছিল সেই সময়ের সমাজচিত্রের জন্য একটি ক্লাসিক সিনেমাও। মোট ৩০০টি বাংলা ও উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এই অভিনেতা পৃথিবী ছাড়েন ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট।

পেশায় ব্যাংকার বুলবুল আহমেদ ছিলেন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে আসা একেবারেই ব্যতিক্রম একজন নায়ক। ইন্ডাস্ট্রিতে যাকে কখনোই হিরোসুলভতার সঙ্গে বিচরণ করতে দেখা যায়নি। সত্তর দশকের নিপাট ভদ্রলোক স্বভাবের এই অভিনেতার ঝুলিতেও আছে বেশকিছু কালজয়ী সিনেমা। ‘দেবদাস’ সিনেমাটিতে অভিনয় করে প্রথমবারের মতো বড় তারকা খ্যাতি পান তিনি। এই অভিনেতা ২০১০ সালের ১৫ জুলাই পৃথিবী ছাড়েন।

ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে সত্তর দশকের একেবারে শুরুতে আসা আবুল খায়ের জসিম উদ্দিন চলচ্চিত্রে জসিম নামেই পরিচিত। প্রথমে খল নায়ক হিসেবে তুমুল জনপ্রিয় হন এবং যে মানের অভিনয় করেছেন এখনো অপ্রতিদ্বন্দ্বী তিনি। ‘রংবাজ’ সিনেমায় ছিলেন অ্যাকশন ডিরেক্টর। অনেকেই তাকে বাংলা চলচ্চিত্রের অ্যাকশনের পথপ্রদর্শক হিসেবে মনে করেন। পরে নায়ক হিসেবেও বেশকিছু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দিয়েছেন। মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। জনপ্রিয় এই অভিনেতার অকাল প্রয়াণ ঘটে ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর।

ঢাকাই চলচ্চিত্রে স্টাইলিশ নায়ক হিসেবে পরিচিত জাফর ইকবাল। তার ক্যারিয়ারের শুরু সত্তরের মাঝামাঝিতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এই অভিনেতা ১৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাফর ইকবাল ছিলেন ভালো গিটারিস্ট ও ভোকালও। ষাট দশকেই ছাত্রাবস্থায় গড়েছিলেন নিজের ব্যান্ডদল। সুরকার আলাউদ্দিন আলী তাকে দিয়ে বহু চলচ্চিত্রে কাজ করিয়েছিলেন। তার জনপ্রিয় কিছু গানের মধ্যে ‘সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারও ঘরনি’ (ধারণা করা হয় এটি ববিতাকে নিয়েই গাওয়া), ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’, ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও’ অন্যতম। চিত্রনায়িকা ববিতার বিপরীতে তিনি অনেকগুলো সফল বাণিজ্যিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ববিতার সঙ্গে তার জীবন-রসায়নও ছিল ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে নিয়মিত আলোচনার খোরাক। এই অভিনেতা পৃথিবী ছাড়েন ১৯৯২ সালের ৮ জানুয়ারি।

‘উত্তম কুমার’খ্যাত রহমানের (আবদুর রহমান) ঢাকাই সিনেমায় অভিষেক ঘটে ষাট দশকের আগেই। ১৯৫৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ঢাকা, করাচি ও লাহোরে বাংলা, উর্দু ও পশতু ভাষার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। এ দেশের চলচ্চিত্রে সফল জুটি হিসেবে শবনম-রহমান জুটিই প্রথম।

এহতেশামের ‘এ দেশ তোমার আমার’ দিয়ে যাত্রা করা রহমান যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে তখন একপর্যায়ে সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারান তিনি। এরপর থেকেই তার ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ে। অন্যান্য জনপ্রিয় অভিনেতাদের থেকে পিছিয়ে পড়েন। কিছু চলচ্চিত্রের পরিচালনাও করেছেন তিনি। এই অভিনেতা ২০০৫ সালের ১৮ জুলাই একেবারেই নীরবে নিভৃতে প্রয়াত হন।

ষাট দশকের আরেক তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা আজিম। প্রকৃত নাম নূরুল আজিম খালেদ রউফ। ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে লোককাহিনী নির্ভর ও প্রণয়ধর্মী চলচ্চিত্রে প্রধান অভিনেতা হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। এগুলোর মধ্যে ‘রাজধানীর বুকে’, ‘হারানো দিন’, ‘ডাকবাবু’, ‘সাইফুল মুল্ক্ বদিউজ্জামাল’, ‘সাত ভাই চম্পা’ এবং ‘ভানুমতি’ অন্যতম। অভিনয়ের বাইরে সিনেমার পরিচালনাও করেছেন তিনি। এই অভিনেতা ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ পৃথিবী ছাড়েন।

অন্যদিকে লোককাহিনীভিত্তিক সিনেমার আরেক জনপ্রিয় নায়ক আব্দুস সাত্তার লোকান্তরিত হন ২০২০ সালের ৫ আগস্ট। ৭০ দশকের এই অভিনেতা ১১০টি সিনেমায় অভিনয় করেন।

ষাট ও সত্তর দশকের নায়করা তো এই পৃথিবী ছাড়ার পথে আছেনই সেইসঙ্গে ইতোমধ্যে আশি দশকেরও জনপ্রিয় অভিনেতা অকাল প্রয়াত হয়েছেন। এর মধ্যে মান্না এবং সালমান শাহ অন্যতম।

সূত্র: যায়যায়দিন

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন