এভারেস্ট বেজক্যাম্পের পথে হাঁটতে হাঁটতে বান্দরবানের কথা মনে পড়ল বাবর আলীর

fec-image

চমরী গাইয়ের গলায় ঝোলানো ঘণ্টির টুংটাংই অ্যালার্মের কাজ করল। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ পথে বেরিয়ে প্রথমেই পড়ল ঝুলন্ত ব্রিজ। এখান থেকেই পাইনগাছের রাজত্ব শুরু। মিনিট বিশেকের মধ্যে ফাকদিংয়ের জনপদ ছাড়িয়ে টকটক। আজকের গন্তব্য অবশ্য শেরপা রাজধানী বলে খ্যাত নামচে বাজার। চলছি দুনিয়ার সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্টের পাদদেশে অবস্থিত বেজক্যাম্পের দিকে। নাকে আসছে জুনিপার ঝোপ পোড়ানোর তীব্র সুগন্ধ। চোখ ধাঁধাচ্ছে রডোডেনড্রন। সেই যে ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’। নেপালের জাতীয় ফুল।

আর মনে পড়ছে দেশের পাহাড়ের কথা। প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিক থেকে দুটি জায়গার মধ্যে অনেক বৈসাদৃশ্য। আবার সমতলের তুলনায় দুই জায়গার জীবনযাত্রাই অনন্য। অনেক কিছুই এখানে সহজে পৌঁছায় না। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো এর মধ্যে অন্যতম। তারপরও দুনিয়ার দুর্গমতম প্রান্তে ভ্রমণপিপাসুদের প্রয়োজনীয় সেবাটুকু পৌঁছে দেওয়ার তাগিদ নেপালের ট্রেকগুলোতে দেখা যায়। এ জায়গাতেই আমরা বেশ পিছিয়ে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগ—দুটোই বেশ অপ্রতুল।

নেপালের মতো আমাদের পার্বত্য অঞ্চলেও কয়েকটি ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণা করে সেখানে ৩ থেকে ১০ দিনের ট্রেক চালু করা যেতে পারে। শারীরিক শ্রমের আনন্দের পাশাপাশি আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অনন্য ঐতিহ্য চাক্ষুষ করার সুযোগও পেয়ে যাবেন ট্রেকাররা। পাড়াগুলোতে ন্যূনতম সুবিধাসহ হোম স্টে চালু করা গেলে বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদেরও আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের অনন্য ভূখণ্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাবে। কমিউনিটি ট্যুরিজমের এই মডেল চালু করে নেপালের দুর্গম ট্রেকগুলোতেও স্থানীয় পাহাড়িরা স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমাদের দেশেও এটি চালু করা গেলে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে জেরবার জনগোষ্ঠীগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা আছে।

বলা হয়ে থাকে পর্যটন আর সংরক্ষণের সম্পর্ক বৈরী। তারপরও এই দুটির সহাবস্থান যে সম্ভব সেটা নেপালের অনেক ট্রেকে গেলেই বোঝা যায়। পর্বতারোহীদের পাশাপাশি ট্রেকার তথা পর্বত-পদযাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধার দিকেও নেপালের সরকারের নজর থাকে বেশ। অন্যদিকে যেকোনো অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা প্রকৃতিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করি। নির্বিচার প্রকৃতিকে সংহার করতে আমাদের হাত একটুও কাঁপে না। রাস্তা নামক সভ্যতার উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠির ক্ষেত্রে আমরা আরও বেশি নির্বিচার। এ জন্য একরের পর একর পাহাড় কিংবা বনভূমি উজাড় করতেও পিছপা হই না। রাস্তা হওয়ার ফলে স্থানীয় লোকেদের সুবিধা নিশ্চয়ই হয়। কিন্তু ঝিরি-ঝরনার ওপর মসৃণ পিচ ঢেলে পাহাড়ের অধিবাসীদের জীবনধারণের পানির উৎসও যে আমরা বুজিয়ে দিচ্ছি, সেটা মাথায় থাকে না। এ ক্ষেত্রে ঝিরি বা নদীর এপার-ওপারকে সংযুক্ত করা সাসপেনশন ব্রিজগুলো হতে পারে উপযুক্ত সমাধান। নেপালের যেকোনো ট্রেকজুড়েই দেখা যায় এহেন সাসপেনশন ব্রিজের রাজত্ব। অবশ্য রাস্তা হলেই পিলপিল করে আসবে মানুষ। দুর্গম কোনো জায়গায় গিয়ে আমরা প্রকৃতি বেশি আর মানুষ কম দেখতে চাই। কোথাও গিয়ে প্রকৃতি কম আর মানুষ বেশি হলেই মুশকিল। এ ভারসাম্যটা অবশ্য নেপালও ঠিক রাখতে পারে না সব সময়।

ওই তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম সব জায়গায় চলতে থাকলে রাস্তা গড়ার হিড়িকে অদূর ভবিষ্যতে পাহাড়ে প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড বলে আর কিছু থাকবে না। এমনিতেই নিরাপত্তার কারণে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বেশির ভাগ জায়গাতেই আজকাল ট্রেক করার সুযোগ সীমিত। নেপাল যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার জন্য কিছু ট্রেকে রাস্তা তৈরি করলেও দূষণের হাত থেকে রক্ষার জন্য বেশ কিছু ট্রেকে ক্যাটারপিলারের বিষদাঁত বসাতে দেয়নি। সেগুলো এখনো বিশ্বজোড়া অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ সারিতেই থাকে। শিল্প হিসেবে পর্যটন বহুমুখী একটি শিল্প। এই শিল্পের বহুমুখিতা নিজেদের সামগ্রিক উন্নয়নের পক্ষে আনাই হোক অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের লক্ষ্য।

সূত্র: প্রথম আলো

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন