parbattanews

এম এন লারমা হত্যার দায় কার?

২০১০ সালের ১০ নভেম্বর ‘এম এন লারমা হত্যা : দায়ী সন্তু লারমা নাকি প্রীতি কুমার চাকমা—?’ শিরোনামে সামহোয়্যারইনব্লগ.নেট-এ একটি ব্লগ লিখেছিলাম। একই লেখা পরের দিন আপ করেছিলাম আমারব্লগ.কম-এ। লেখাটি ছিল অসম্পূর্ণ এবং লেখার শেষে সেটি উল্লেখ করে আরো একটি পর্বের মাধ্যমে শেষ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলাম। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক বিষয়টি পরে আর মনে ছিল না। ফলে দ্বিতীয় পর্বটিও আর লেখা হয়ে উঠেনি। সম্প্রতি উৎপল খীসার লেখা একটি বই হাতে এসেছে। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তথা এম এন লারমা হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত নিয়ে ‘ফিরে দেখা শান্তি বাহিনীর গৃহযুদ্ধ স্বপ্নের অপমৃত্যু’ শিরোনামের বইয়ের শেষে যুক্ত তথ্যসূত্র আমার সেই লেখাটির কথা আবার মনে করিয়ে দিল। লেখক আমার লেখার উল্লেখযোগ্য অংশই উনার বইয়ে যুক্ত করেছেন এবং তার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকারও করেছেন তথ্যসূত্রের তালিকায় তা উল্লেখ করে। সে জন্য লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

লেখক আমারব্লগ.কম থেকে আমার লেখাটি সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু ব্লগটি চালু না থাকায় এখন আর মূল লেখাটি সেখান থেকে দেখা সম্ভব নয়। তবে যে কেউ চাইলে সামহোয়্যারইনব্লগ.নেট থেকে এটি দেখে নিতে পারবেন। যাহোক, সেদিন এম এন লারমা হত্যাকা-কে ঘিরে পাওয়া যেসব তথ্য-উপাত্ত আমার হাতে ছিল তার ভিত্তিতেই লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব লিখে শেষ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে বিষয়টি একই ধারাবাহিকতায় শেষ করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। তবে জনাব খীসার বইটিতে এম এন লারমা হত্যাকা-কে নিয়ে প্রচুর তথ্য-উপাত্ত এবং তার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ আছে। সেসব ঘিরে সৃষ্টি হওয়া নানা রহস্য এবং অমীমাংসিত বেশ কিছু বিষয়ে যৌক্তিক প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। লেখকের সকল বর্ণনা এবং বিশ্লেষণের সাথে একমত হতে না পারলেও তিনি যেসব যৌক্তিক এবং স্পর্শকাতর প্রশ্ন তোলার সাহস দেখিয়েছেন তাতে তাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

আমার পূর্বের লেখাটির সাথে উৎপল খীসার বই থেকে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধৃতি যুক্ত করে করে দিলে এম এন লারমা হত্যাকাণ্ড ঘিরে সৃষ্ট রহস্য এবং তার ভিত্তিতে ওঠা কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন পাঠকদের মনে কিছুটা হলেও আলো ফেলতে পারে। সে কারণেই আজকের এই প্রয়াস। পূর্বের লেখাটির উদ্ধৃতি শুরু: রাঙ্গামাটি কমিনিস্ট পার্টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমা ছিলেন একজন মাওবাদী নেতা। আর একারণেই তিনি মাও সেতুংয়ের ‘বন্ধুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ উক্তির উপর অবিচল আস্থা রেখে গঠন করেছিলেন সশস্ত্র সংগঠন শান্তিবাহিনী। এম এন লারমা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণপরিষদ সদস্য এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় তার প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল বেশ আলোচিত। এর পর বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করলে তিনি যোগদেন বাকশালে। কিন্তু ’৭৫ সালের পট-পরিবর্তনের পর চলে যান আন্ডারগ্রাউন্ডে। শেষ পর্যন্ত আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাকালেই ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর শান্তিবাহিনীর আন্তকোন্দলে ৮ জন সঙ্গীসহ নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

তার মৃত্যুর পর তৎকালীন শান্তিবাহিনীর বিবদমান গ্রুপ দু’টির প্রধান যথাক্রমে সন্তু লারমা এবং প্রীতি কুমার চাকমা আলাদা আলাদাভাবে লিফলেট প্রকাশ করে পরস্পরকে দোষারোপ করে এ ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। সন্তু লারমার বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর এবং প্রীতি কুমার চাকমার বিবৃতি প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালের ২৩ জানুয়ারি। কিন্তু কী ছিল তাদের সেই বিবৃতি দু’টিতে? সে সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই জানা নেই। তাছাড়া বিবৃতিতে যাদের দোষারোপ করা হয়েছিল হত্যার জন্য কী তারাই দায়ী ছিল নাকি এর সাথে জড়িত ছিল আরো কোন শক্তি? তাও জানা নেই অনেকের। তাই তখনকার বিভিন্ন প্রকাশনা এবং ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্টদের অভিজ্ঞতার আলোকে পরবর্তীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ এবং বই পুস্তক থেকে তথ্য উপাত্ত নিন্মে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

সন্তু লারমা তার ছাপানো বিবৃতিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘— পার্টির অভ্যন্তরে একশ্রেণীর ক্ষমতা লিপ্সু, দুর্নীতিপরায়ণ, স্বার্থান্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃস্থানীয় কর্মী আন্দোলনের বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলাতে না পেরে এবং নিজেদের দুর্বলতা, দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহার ঢাকার উদ্দেশ্যে সর্বোপরি ক্ষমতায় উচ্চভিলাসী হয়ে পর্টির সর্বময় ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় নিয়ে এক উপদলীয় চক্রান্ত শুরু করতে থাকে। এই উপদলীয় চক্রান্তের হোতা হলো-প্রীতি কুমার চাকমা (প্রকাশ), ও দেবজ্যোতি চাকমা (দেবেন)। পরবর্তীতে দেশী-বিদেশী, আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ও রাজনৈতিক দালালদের খপ্পরে পড়ে এদের সঙ্গে চক্রান্তে জড়িত হয়ে পড়ে ভবতোষ দেওয়ান (গিরি), ত্রিভঙ্গিল দেওয়ান (পলাশ), সনৎ কুমার চাকমা (সাগর), যতীন্দ্র ত্রিপুরা (নির্মল)।

—অবশেষে বিভেদপন্থী চতুঃচক্রীরা যখন কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রচ- আক্রমণে ও ক’টনৈতিক চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়লো তখন জাতীয় বেঈমানরা উদ্ভূত সমস্যা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিরসন করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে বাধ্য হলো। আন্দোলন তথা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পার্টি অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ শান্তিপূর্ভাবে নিরসনের জন্য পার্টি ও বিভেদপন্থীদের এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বৈঠকে ক্ষমা করা ও ভুলে যাওয়া এই নীতির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।–

কিন্তু গোপনে গোপনে শান্তি চুক্তির অন্তরালে গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্র আবার দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ও রাজনৈতিক দালালদের চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়ে নিজেদের হীন ও সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে অনেক জঘন্যতম ষড়যন্ত্র করে বসে। উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে গৃহীত সকল সিদ্ধান্ত লংঘন করে ১০ নভেম্বর ৮৩ জাতীয় বিশ্বসঘাতকরা, প্রতিক্রিয়াশীল বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-পলাশ চক্র অতর্কিত হামলা পরিচালনা করে জাতীয় ইতিহাসে এক কলঙ্কিত ইতিহাস রচনা করলো।—’

অপরদিকে প্রীতি কুমার চাকমা ‘জাতির উদ্দেশ্যে জনসংহতি সমিতি’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রচার পত্রে উল্লেখ করেন, “পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য সমস্যা নিরসনকল্পে বিগত ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৮২ সালে ৮ দিনব্যাপী সম্মেলনে বিরাজমান পরিস্থিতির ওপর প্রতিনিধিগণ বিশদ আলোচা পর্যালোচনা করে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গকে আহ্বান জানান। আলোচনা পর্যালোচনায় এটা সুষ্পষ্ট হয়ে ওঠে যে পার্টিতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাসহীনতা ও সর্বোপরি বাস্তব বিবর্জিত মনগড়া রাজনৈতিক তত্ত্ব বিরাজমান। এসব পার্টি থেকে দূর করে দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ কর্মসূচী গ্রহণের ওপর জোর আহ্বান জানানো হয়।—

লারমা চক্র তাদের ভিতশক্ত করে ফেলার উদ্দেশ্যে কাউকে প্রমোশন দিয়ে, কাউকে আর্থিক সুযোগ দিয়ে এবং আরও নানা ধরনের উপায় অবলম্বন করে কর্মীদের মধ্যে ঐক্যে ফাটল ধরাতে সম্মেলনের পর পরই ব্যাপকভাবে তৎপরতা শুরু করে দেয়। পার্টির সাংগঠনিক কাজের অজুহাত দেখিয়ে কতিপয় তোষামোদকারী ও সুবিধাভোগী কর্মীকে কম্যান্ড পোস্ট বি, ১ নং সেক্টর ও ২ নং সেক্টরে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করে সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে। এসব প্রতিনিধিগণ পার্টির সর্বপ্রকার নিয়ম শৃঙ্খলা লংঘন করে নানা ধরনের কূটকৌশল অবলম্বন করে বিভিন্ন স্তরের কর্মীদেরকে লারমাচক্রে টেনে আনার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়।—

পার্টির এহেন সংকটকালে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে শ্রীগিরি সামনাসামনি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যাবতীয় বিবাদ বিসংবাদ ও মত পথের পার্থক্যের অবসান করে পার্টির মধ্যে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেন। শ্রীলারমা লোক দেখানো ভাবে এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং শ্রীগিরিকে পার্টির সদর কার্যালয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। শ্রীগিরি উক্ত উদ্দেশ্যে যথাসময়ে ১৯৮৩ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে পার্টির সদর কার্যালয়ে উপস্থিত হন। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয়- তাঁর সঙ্গে সমস্যা সমাধানের কোন প্রকার আলোচনা বৈঠক না করে তাঁকে আটক করে রাখা হয় এবং তাঁর উপর মানসিক নির্যাতন চালানো হয়।–

—১৯৮৩ সালের ১৪ জুন মঙ্গলবার, কসাল ১১.১৫ ঘটিকায় বিশেষ সেক্টর হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করে লারমাচক্র ভ্রাতৃঘাতি সংঘর্ষের জন্ম দিয়ে দেশ ও জাতিকে সম্পূর্ণ এক অনিশ্চিত অবস্থায় ঠেলে দেয়। এতে অস্ত্রগুরু অমৃতলাল চাকমা (বলি ওস্তাদ) এবং কর্পোরাল তরুণ নির্মমভাবে নিহত হন এবং ক্যাপ্টেন সরজিৎসহ অপর চারজনকে বন্দী করে নির্মমভাবে পাশবিক নির্যাতন করা হয়। এ সঙ্গে আমরা প্রয়াত লারমার ২৩-৫-৮৩ইং তারিখে সন্তুকে লেখা একটা চিঠির অংশ বিশেষ তুলে ধরলাম— ‘তুমি, আমি ও মিহির আলোচনা করেছি অনেক। শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান, না অশান্তিপূর্ণভাবে সমাধান- এ দুই পথ থেকে কোন পথ বেছে নেওয়া হবে। অনেক কথাই হয়েছিল। তবে যে কথা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল- অশান্তিপূর্ণভাবে সমাধান এবং তা করতে হলে পূর্ণ সফলতা অবশ্যই প্রয়োজন।’—
— এদতসত্ত্বেও জাতীয় সংহতি ও ঐক্য পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে ২৩ ও ২৮ জুলাই, ১৯৮৩ সন এবং ১ আগস্ট, ১৯৮৩ সন তারিখে পর পর তিনবার লারমা চক্রের সঙ্গে আমরা বৈঠকে মিলিত হয়েছি। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় এই পরিস্থিতিকে শান্ত ও স্বাভাবিক করতে পারস্পরিক সামরিক আক্রমণ ও হুমকি প্রদর্শন বন্ধ রাখতে ও পরস্পর বিরোধী প্রচারণা বন্ধ করতে তারা যেমনি রাজি হতে পারেনি, তেমনি শ্রীগিরিকে আটক অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠান করে পরিস্থিতিকে শান্ত ও স্বাভাবিক করতেও রাজি হয়নি।—
পরিশেষে তাদরে দাম্ভিকতাকে খর্ব করার জন্য ১৩ আগস্ট, ১৯৮৩ তারিখে লারমা চক্রের অস্ত্রাগার দখল করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে লারমার নিকট আমাদের পুনঃ ঐক্য স্থাপনের সদিচ্ছার কথা আবারও জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, লারমা উত্তেজিত হয়ে প্রলাপ বকতে শুরু করেন। অতঃপর তিনি তাঁর অনুগামী সেনাবাহিনীকে এমর্মে নির্দেশ জারি করেন- আমার হুকুম, তোমরা যেখানে পাও বাকিদেরকে গুলী করো- হত্যা করো, সহায় সম্পত্তি যা পাও বাজেয়াপ্ত করো। তাদেরকে ক্ষমা করা হবে না। ফলে তার সেনাবাহিনীর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকে।—’ পূর্বের লেখাটির উদ্ধৃতি শেষ।

উৎপল খীসা তার বইয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘দুই ষাঁড়ের উন্মত্ত দৌড় প্রতিযোগিতা’ দিয়ে জেএসএস’র মধ্যে সৃষ্ট মত-বিরোধ, ভাঙ্গন এবং তার পরিণতিতে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমার হত্যার মূল কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। একই অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, ‘দল গঠনের প্রথম ৭-৮ বছর মাও সেতুংয়ের আদর্শে পরিচালিত হলেও পরবর্তী সময়ে সেই বিপ্লবী আদর্শিক লাইন থেকে ক্রমে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। পৃ. ১১’ এ সময় ‘জনসংহতি সমিতির মধ্যে বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনা দর্শন আদর্শ কৌশলে প্রভূত ঘাটতি থাকায় জুম্মদের গোটা লড়াইটা কার্যত পরিচালিত হয়েছিল প্রীতি ও সন্তুÑ দুই অন্ধ ষাঁড়ের উন্মত্ত পাল্লা দিয়ে দলীয় ক্ষমতার মসনদে বসবার, আঁকড়ে থাকবার ভূতুড়ে দৌড় হিসেবে। সন্তু ও প্রীতি নিজেদের, জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকার মুক্তি অর্জন করতে গিয়ে উন্মত্ত হয়ে পড়েছিলেন পরস্পরকে পরাজিত করাবার, থামার উদ্গ্র কামনা-বাসনায়। পৃ. ১১’

কিন্তু ‘প্রীতি ও সন্তু: দুই ষাঁড়ের অন্ধ উন্মত্ত দৌড় প্রতিযোগিতা থামাতে তিনি (এম এন লারমা) যথার্থ নেতার ভূমাকা পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাঁর উচিৎ ছিল- বিপ্লবী রাজনৈতিক দলের চেতনা নীতি শৃঙ্খলা আদর্শের ভিত্তিতে দল পরিচলানা করা। — সংকটকালে তাঁর ভূমিকা হওয়া উচিৎ ছিল ত্রিনয়ন, ত্রিলোকের। অথচ তিনি দেখেছিলেন কেবল এক নয়নে। তখন দ্বিতীয় এবং তৃতীয় চোখ ছিল থেকেও না থাকবার, দেখেও না দেখবার মতন। যার কারণে একচোখা নীতির ভিত্তিতেই তিনি সন্তু লারমাকেই ফিল্ড কমান্ডারের দায়িত্ব দিলেন, পরে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পদে বসালেন। — তিনি নির্ভর করেছিলেন, করতে বাধ্য হয়েছিলেন সন্তু লারমার মতন প্রশ্নবিদ্ধ একরোখা, স্বেচ্ছাচারী, উগ্র, হটকারী অগণতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিবিপ্লবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উপর। পৃ. ১৭’ আসলে ‘এম এন লারমা দল পরিচালনার ক্ষেত্রে তখন পদে পদে পদে ভুল করেছিলেন। যে ভুলই তাকে মৃত্যুর পথে তিলে তিলে ধাবিত করেছিল। পৃ. ১৯’

দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাত শুরু হয়ে যাওয়ার পর চূড়ান্ত আক্রমণটি যেন অবধারিতভাবেই এগিয়ে আসছিল। ১৯৮৩ সালের ৮ নভেম্বর এটাও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, প্রীতিকুমার গ্রুপ ৯ কিংবা ১০ নভেম্বর বাঘমারা ঘাঁটি আক্রমণ করে লারমা গ্রুপকে নিঃশেষ করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। যে ঘাঁটিতে এম এন লারমা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। একই ঘাঁটিতে আছিলেন তার ছোট ভাই সন্তু লারমা, যিনি শান্তি বাহিনীর ফিল্ড কমান্ডার এবং একই সাথে পার্টির ভারপ্রাপ্ত সভাপতিও। কিন্তু আগে থেকে নিশ্চিত আক্রমণের কথা জানা থাকার পরও রহস্যজনক কারণে সেদিন ঘাঁটির নিরাপত্তা রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বরং রূপায়ণ দেওয়ানের নেতৃত্বে চৌকস একটি দলকে ঘাঁটি থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল বিদ্রোহীদের একটি ঘাঁটির উদ্দেশে। অপর দিকে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তিত্ব ‘ঊষাতন তালুকদার (যিনি পরবর্তীতে পার্টির মনোনয়নে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন) একপ্রকার জবরদস্তি করে নিজ পরিবারের সাথে ছুটিতে যাবার কারণে নিরাপত্তা জোরদার করার কাজটায় ভাটা পড়ে যায়। এরপর সন্তু লারমাও আর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। পৃ. ৫১’ তারপরও যারা বাঘমারা ঘাঁটির নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন তাদের নেতা ছিলেন ভিক্টর বাবু ও সুবীর ওস্তাদ। কিন্তু ১০ নভেম্বর ভোর রাতে যখন প্রীতি গ্রুপের লোকেরা ঘাঁটি আক্রমণ করে তখন প্রথম ফায়ারের শব্দ শুনেই তারা পালিয়ে গিয়েছিলেন।

এসব ঘটনা উপস্থাপন করে লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, ‘প্রীতি কুমারদের এমন হামলার ঘটনা সম্পর্কে আগাম সংবাদ লাভের পরও কেন ঊষাতন তালুকদার দলের একজন সিনিয়র নেতা হয়ে নিজেদের, দলের, নেতাদের মহাসঙ্কট বিপর্যয় ঘটতে যাচ্ছে জেনে এবং দলের কমান্ড অমান্য করে দলের সবচেয়ে বড় নেতা এম এন লারমাকে অসুস্থ অবস্থায় বিপদের মুখে ফেলে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে পারিবারিক ছুটিতে গিয়ে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখলেন? তার এমন হটকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে কি কারোর কোন হাত ছিল? তিনি কি কোন দলীয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইন্ধনে এমন নগ্ন স্বার্থবাদী ভূমিকা সেদিন রেখেছিলেন? পৃ. ৫৫’ অপরদিকে দলের প্রাণভোমরা রূপায়ণ দেওয়ান কেন তার দল নিয়ে অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে বাঘমারা ঘাঁটি এলাকা পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন? কার নির্দেশে এমন হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তিনি কি সন্তু লারমার দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন সেদিন? পৃ. ৫৫’ ‘ভিক্টর বাবু, সুবীর ওস্তাদও কি তাহলে সেদিন সন্তু লারমার তালিম পাঠ করতেই প্রথম ফায়ারিংয়ের সাথে সাথে পালিয়েছিলেন? পৃ. ৫৫’ এসবের ধারাবাহিকতায় তিনি প্রশ্ন রেখে লিখেছেন, ‘সঙ্গতকারণে এমন প্রশ্ন জাগে যে, এম এন লারমার দীর্ঘদিন যাবৎ অসুস্থতায় ভোগা এবং নিরাময় না হবার মূলেও কি অন্যকারোর হাত ছিল? পৃ. ৫৯’

লেখক এসব প্রশ্ন তোলার পর মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘এম এন লারমাদের নির্বিঘ্নে হত্যা করতে প্রীতিদের সহায়তা করেছিলেন সন্তু লারমা মীরজাফরদের মতন- স্বীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই। তাই এটা ধ্রুব সত্য যে, এম এন লারমাদের হত্যায় প্রীতি এবং সন্তু উভয়ই সম্পৃক্ত, দায়ী। একজন নিজের ক্ষমতার রাস্তা পরিষ্কার করতে হত্যা করেছেন, আরেকজন নিজের ক্ষমতার রাস্তা পরিষ্কার করতেই উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইতিহাসে এমন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বহু নজির খুঁজে পাওয়া যায়। পৃ. ৬০’

এ প্রসঙ্গে লেখকের সর্বশেষ অধ্যায় থেকে উল্লেখ করা যায়, ‘এমতাবস্থায় জুম্মরা কেবল ভাঙল- আর ভাঙতেই থাকল। যারা গড়তে চাইল তাদের এক এক করে হত্যা নির্মূল করতে অনুসারীদের লেলিয়ে দিলেন- মৃত্যুকূপে ছুঁড়ে ফেলতে কার্পণ্য করলেন না। সে তিনি (সন্তু লারমা) করতে পারলেন- কারণ তিনি ছিলেন আপন স্বার্থ ক্ষমতার লোভে অন্ধ। তিনি তো তার আপন ভ্রাতা এম এন লারমার মতন জুম্ম সেবক নন, জুম্ম মুক্তির চেতনা আদর্শের পথিক নন। তিনি হলেন ক্ষমতার উগ্র প্রতিভূ শাসক, শোষক। যার জন্য তিনি আপন বড় ভাইদের পরিবারকে পর্যন্ত চরম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছেন। এই অবস্থায় তার মুখে জুম্ম দরদ, চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াই, অসহযোগ প্রভৃতির কথা বলা মানেই হলো চলমান প্রতারণা বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিক নাটকের নিত্যনতুন পর্ব সংযোজন। পৃ. ৮২’

পাঠক, এ লেখায় আমাদের নিজস্ব কোনো পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি কিংবা মন্তব্য নেই। বরং এখানে আছে জেএসএস এবং শান্তি বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এম এন লারমার হত্যার সাথে সম্পৃক্ত পক্ষ এবং বিক্ষের বক্তব্য, পাল্টা বক্তব্য। একই সাথে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত এবং কাছ থেকে দেখা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের স্মৃতি কথা অবলম্বনে রচিত উৎপল খীসার বিশ্লেষণ এবং মতামতকে পাশাপাশি রেখে ঘটনাকে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আরও বড় পরিসরে অনুসন্ধানের মাধ্যমে সম্ভব হলে প্রয়োজনীয় মন্তব্যসহ বিস্তারিত লেখার প্রত্যাশা রেখেই আজকের লেখাটি শেষ করছি।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ

Exit mobile version