করিডর নয়, রাখাইনে রোহিঙ্গা সংকট কাটবে সেফজোন করলে

fec-image

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পৌঁছাতে ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার যে আলোচনা চলছে, তা নিয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, করিডরের চেয়ে রাখাইনে সেফজোন করলে কাটবে রোহিঙ্গা সংকট।

আর কক্সবাজারের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সংকট দূর না করে এবং প্রত্যাবাসন শুরু না করে হঠাৎ করে কেন করিডোর দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তা তাদের বোধগম্য নয়।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, করিডরের আগে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল (সেফজোন) গড়তে হবে। এ ছাড়া যে করিডরের আলোচনা চলছে, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

কারণ আগে যেমন মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈরী ছিল, তেমনি এখনও সেখানকার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি তাদের ভূমি থেকে উৎখাত করছে। এজন্য করিডোর দেওয়ার পাশাপাশি রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের মাধ্যমে সেফজোন করার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের আরাকান আর্মির চলমান যুদ্ধে রাখাইনের বেশিরভাগ অঞ্চল আরাকান আর্মির দখলে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে চলতি বছরের প্রথমার্ধে গৃহযুদ্ধে রাখাইন বা আরাকান রাজ্যে দুর্ভিক্ষ হতে পারে

এমন আশঙ্কায় মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশকে করিডোর দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘ। যুদ্ধরত রাখাইন রাজ্যে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে আরাকান আর্মির উত্থানে সীমান্তে জটিল পরিস্থিতির মধ্যে করিডোর দেওয়া নিয়ে এখন রোহিঙ্গা ও জেলার মানুষের মধ্যে চলছে আলোচনা।

রাখাইনে মানবিক করিডর প্রতিষ্ঠার বিষয়ে গত ২৭ এপ্রিল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, মানবিক করিডরের বিষয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার ওই বক্তব্যের সপ্তাহ না পেরোতেই সরকারের ভিন্ন অবস্থানের কথা জানান জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।

গত রবিবার ঢাকার এক সেমিনারে খলিলুর রহমান বলেন, মানবিক করিডর কিংবা অন্য কিছু নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়নি। এই দুই ধরনের বক্তব্যে বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।

কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিয়ানমারের জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মি দুই পক্ষই রোহিঙ্গাদের স্বার্থবিরোধী।

তাদের নির্যাতনে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করলে মিয়ানমারের আরাকান বা রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডোরে আমাদের আপত্তি নেই।

তবে সীমান্তে চোরাচালান, দেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। করিডোরের পেছনে অন্য কোনও কিছু থাকলে তা প্রত্যাখ্যান করবে কক্সবাজারের সুশীল সমাজ।’

কক্সবাজার নাগরিক ফোরামের সভাপতি আ ন ম হেলাল উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মানবিক সহায়তার জন্য সীমিত আকারে করিডোরকে আমরা স্বাগত জানাবো।

কিন্তু করিডোর দেওয়া নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একেক ধরনের বক্তব্য আমাদের দ্বিধায় ফেলছে। শুধু আরাকান আর্মির সুবিধার জন্য কিংবা অন্য কোনও উদ্দেশ্যে করিডোর দেওয়া আমরা সমর্থন করি না।

আমাদের প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে নানা ধরনের কথা শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্য চাই আমরা।’

রোহিঙ্গাদের সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি মোহাম্মদ জোবায়ের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করিডোর স্থাপনের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য একটি সেভজোন করতে হবে।

এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সহজ হবে। কারণ মিয়ানমার সরকার ও আরাকান আর্মি উভয়ে রোহিঙ্গা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। রাখাইনে রোহিঙ্গারা থাকতে না পারলে করিডোরের মাধ্যমে মানবিক সহায়তা কোনও কাজে আসবে না।

যদি রাখাইনে জাতিংঘের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি নিরাপদ ও টেকসই সেফজোন করা যায়, তাহলে রোহিঙ্গারা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়বে।’

একই কথা বলেছেন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সদস্য নূর মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘রাখাইনে মানবিক করিডোরের চেয়ে এখন বেশি জরুরি সেফজোন তৈরি।

জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি সেফজোন দূর করতে পারে রোহিঙ্গা সংকট। এতে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনও শুরু করা যাবে। সেফজোন হয়ে গেলে স্বেচ্ছায় বাংলাদেশ ছেড়ে মিয়ানমারে চলে যাবেন রোহিঙ্গারা।’

তবে করিডর বিষয়ে সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের কাছে কোনও তথ্য নেই। শরণার্থীবিষয়ক কমিশনার ও সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জানান, মানবিক করিডর নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা চললেও এ বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে পৃথক পাঁচটি ট্রানজিট কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর বাইরে করিডর নিয়ে তার কাছে কোনও তথ্য নেই।

আরআরআরসি কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত দেড় বছরে এক লাখ ১৮ হাজার রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে এসেছেন। ইতিমধ্যে তাদের নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে।

তাদের কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বসবাসের জন্য ঘর বরাদ্দ চেয়ে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে ইউএনএইচসিআর। গত সপ্তাহে আরআরআরসি কার্যালয়কে এ চিঠি দেয় ইউএনএইচসিআর। কিন্তু সেই চিঠির সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ।

এ অবস্থায় গত দেড় বছরে আসা রোহিঙ্গাদের নতুন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসেছেন গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। চলতি বছরের প্রায় প্রতিদিন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছেন বলে জানা গেছে। যেকোনোভাবে অবশ্যই অনুপ্রেবেশ ঠেকাতে হবে।

গত দুই মাস ধরে রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস

বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন। এ সময় সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।

পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত। এরপর করিডর নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।

সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা সংকট
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন