parbattanews

কানিজের মেজর হওয়ার পথে বাধা হতে পারেনি হুইলচেয়ার

কানিজ ফাতিমার কর্মস্থল সাভার ক্যান্টনমেন্টে। তাঁর কক্ষের বাইরে নতুন নামফলক বসেছে। নামের আগে যোগ হয়েছে নতুন পদবি—মেজর। মেজর কানিজ ফাতিমা। ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ৪ জুন ক্যাপ্টেন কানিজ ফাতিমাকে এই মেজর র‌্যাঙ্ক ব্যাজ পরিয়ে দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ।

৫ জুন সাভার ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। হুইলচেয়ারে বসে কাজ করছিলেন তিনি। কুশল বিনিময়ের পর বললেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুরু থেকেই সহযোগিতা করছে বলেই আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। প্রতিষ্ঠান আমাকে সাপোর্ট করেছে, প্রতিষ্ঠানের কাজে লাগতে পারি, সে জন্য নিজেও সংগ্রাম করেছি।’

কানিজ বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধীনে ৩৩ এসটি ব্যাটালিয়নে কর্মরত। তাঁর কর্মজীবনের শুরুও এখানে। কানিজ ফাতিমা শোনালেন সেই গল্প।

২০১১ সাল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন কানিজ। এরপর বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তিনি। ২০১২ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রশিক্ষণের সময় এক দুর্ঘটনায় তাঁর মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে যায়। অসুস্থ কানিজকে চিকিৎসার জন্য আনা হলো ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। চিকিৎসা চলে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে। এরপর থাকলেন সাভারের সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড বা সিআরপিতে। এভাবে চিকিৎসা নিতে হয় প্রায় এক বছর।

২০১৩ সালে সেনাবাহিনী কানিজকে ৬৯ বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বিশেষ বিবেচনায় কমিশন প্রদান করে। কমিশনপ্রাপ্তির ২০ দিনের মাথায় বাবাকে হারান। পরিবারে দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় তিনি। বড় মেয়ে হিসেবে পরিবারের দায়িত্বও তুলে নেন কাঁধে। কানিজ বলছিলেন, ‘পরিবার ও পেশা—দুটিই আমাকে শক্ত হতে সাহায্য করেছে। দুর্বল বা পিছিয়ে থাকার কোনো উপায় ছিল না। আমার পেশাটি চ্যালেঞ্জিং, এখানে সফল হতে হলে মানসিকভাবে শক্ত হতেই হবে।’

কর্মক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে কানিজ বললেন, অন্য দশজনের চেয়ে কাজের ক্ষেত্রে তাঁর পার্থক্য হলো—অন্যরা শারীরিক কসরত, খেলাধুলা করছেন। তিনি এ কাজগুলো করতে পারছেন না। তবে অফিসের ডেস্কে বসে নির্দেশনা দেওয়া, নেতৃত্ব দেওয়া, অফিশিয়াল নথিপত্রের কাজগুলো করছেন তিনি। এর মাধ্যমেই তিনি তাঁর মেধাকে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেন। পেশাসংক্রান্ত বই পর্যালোচনার যে প্রতিযোগিতা, তাতে এ পর্যন্ত দুবার পুরস্কার পেয়েছেন কানিজ।

কানিজ ফাতিমার জন্ম ১৯৯০ সালে। কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার ভিংলাবাড়ি গ্রামে তাঁদের বাড়ি। তাঁর বাবার নাম কামাল উদ্দিন সরকার ও মায়ের নাম সালমা বেগম। কুমিল্লার বদিউল আলম হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং বদিউল আলম ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে বিএসসি ইন মিলিটারি স্টাডিজে ডিগ্রি নেন।

কানিজ জানালেন, সেনাবাহিনীতে কাজ করবেন, এ স্বপ্নটা দেখেছিলেন ছোটবেলায়। কুমিল্লায় তাঁদের বাসার পাশেই সেনাবাহিনীতে কর্মরতদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ হতো। তবে ছোটবেলায় মেয়েদের সেখানে প্রশিক্ষণ নিতে দেখেননি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০০ সালে সেনাবাহিনীতে প্রথম নারী অফিসার নিয়োগ প্রদান শুরু করেছিলেন। এই সুযোগটা হাতছাড়া করেননি কানিজ। কানিজ পরিবারের প্রথম মেয়ে, যিনি এ ধরনের চ্যালেঞ্জিং পেশাকে বেছে নিয়েছেন। বললেন, ‘সেনাবাহিনীর পোশাক গায়ে দেওয়ার পর যে অনুভূতি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সেনাবাহিনীর পোশাকটা যাতে গায়ে থাকে, তার জন্যই প্রতিদিন সংগ্রাম করি।’

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা না থাকলে কর্মক্ষেত্রে অনেক দূর চলে যেতেন, তেমনটা মনে করেন না কানিজ। তাঁর মতে, তিনি স্বাভাবিক গতিতেই সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে তিনি ভালো আছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী—এ পরিচয়ে আলাদা চ্যালেঞ্জের মুখে এখনো পড়তে হয়নি।

সেনাবাহিনীতে আসতে আগ্রহী মেয়েদের উদ্দেশে কানিজ বললেন, সেনাবাহিনীর কাজ চ্যালেঞ্জিং, তবে নারীদের জন্য অসম্ভব কিছু না। তবে মেয়েরা সব কাজ করতে পারে—এটা মনে রাখতে হবে। নিজেকে সেভাবেই প্রস্তুত করতে হবে।

আর শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে কানিজের পরামর্শ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। দুর্বলতাটা প্রথমে ঝেড়ে ফেলতে হবে। মানসিকভাবে শক্ত হলে অন্য যেকোনো প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব, তা মনে রাখতে হবে।

কানিজ ফাতিমা আলাপের সময় তাঁর এ পর্যন্ত আসার পেছনে যাঁদের অবদান আছে, তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেনাবাহিনী প্রধান, বর্তমান জিওসি, সহকর্মী, পরিবারের সদস্যসহ অনেককেই রাখলেন সে তালিকায়।

৩৩ এসটি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর মো. মফিজুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, ‘ক্যাপ্টেন কানিজ এখন মেজর কানিজ। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যক্তিগত শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে দিয়েছেন কানিজ। শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকার পরও কর্মক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়, তারও উদাহরণ তৈরি করেছেন কানিজ। এটি আমাদের ইউনিট তথা সেনাবাহিনীর জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। সেনাবাহিনীতে কর্মরত নারীরা কানিজকে দেখে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হবেন।’

সূত্র: প্রথমআলো

Exit mobile version