বিশেষ সম্পাদকীয়

কোনো অপশক্তির কাছেই মাথানত করবে না পার্বত্যনিউজ

fec-image

স্পন্ডলাইটিস ও আর্থারাইটিসের ব্যথায় গত দেড় মাস যাবত অনেকটা শয্যাশায়ী। নিরুপায় হয়ে বা বিশেষ প্রয়োজনে যে বেরুইনি তা নয়। কিন্তু সেটা পেইন কিলার ও সাপোজিটরির সাহায্যে। দীর্ঘদিন একটি অসুখ থাকলে মনের উপর যে চাপ পড়ে আমার মধ্যেও সেটা অনুভূত হচ্ছিল।

এর মধ্যেই গত ১৭ মার্চ দিনটি বিশেষ ছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিনে করোনা আতঙ্কের মধ্যেও সর্বত্র উৎসবের ছোঁয়া ছিলো। এ উপলক্ষ্যে পার্বত্যনিউজও বিশেষ সংবাদ ও প্রবন্ধ প্রকাশ করে। এর মধ্যে গবেষক মাহের ইসলাম লিখিত ‘উপজাতিদের অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান’ শীর্ষক প্রবন্ধটি ছিলো সম্পূর্ণ মৌলিক ধাঁচের লেখা। সে কারণে নিউজ পোর্টাল হলেও লেখাটি আমরা লিড স্টোরি করি।

১৭ মার্চ সকাল ১০টার কিছু পরে হঠাৎ আমার মোবাইলে একটি কল আসলো। যুক্তরাষ্ট্রের নম্বর থেকে। নম্বরটি +12103686336। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলা একসেন্টে একজন বললেন, আপনাদের পার্বত্যনিউজের সাইটের কি হয়েছে?

আমি বললাম, কিছুই হয়নি তো, ঠিকই আছে?

সামনেই ল্যাপটপ খোলা ছিলো। সাইট রিলোড দিতেই দেখলাম, সাইট লোড হচ্ছে না। ভদ্রলোককে বললাম, মনে হয় কিছু সমস্যা হতে পারে। ঠিক করে দিচ্ছি এখনই। এতোদুর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ধন্যবাদ।

আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, সাইট ঠিক হবে না। আমি আপনাদের সাইট হ্যাক করেছি। ঠিক করতে পারবেন না। বিস্ময় ও রাগ একসাথে সৃষ্টি হলেও সামলে নিয়ে শুধুলাম, কেন?

তিনি বললেন, ‘উপজাতিদের অধিকার রক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান’ শীর্ষক লেখাটি কেন ছেপেছি? সেই জন্য তিনি হ্যাক করেছেন।

জানতে চাইলাম, আপনার আপত্তির কারণ কি?

তিনি বললেন, ‘উপজাতি’ কেন লিখেছেন? ‘আদিবাসী’ লিখুন, সাইট ওপেন করে দেবো।

আমি বললাম, লাগবে না। আমরা ঠিক করে ফেলবো।

তিনি বললেন, দেখেন পারেনি কিনা? ফোন কেটে দিলেন। বুঝলাম, যাকে ভদ্রলোক বা পাঠক ভেবেছিলাম, তিনি আসলে একজন হ্যাকার।

আমি আমাদের সার্ভার মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারকে ফোন দিয়ে বিষয়টা জানালাম। তিনি আধা ঘণ্টা সময় চাইলেন। এর মধ্যেই সাইট ঠিক হয়ে গেলো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। কিন্তু ১০ মিনিটের মাথায় আবারও সাইট ডাউন হয়ে গেলো। আবার হ্যাকারের ফোন।

: সাইট তো ঠিক করেছিলেন, রাখতে পারলেন। পারবেন না। আমাদের দাবী মেনে নিন। সাইট ছেড়ে দেবো। ফোন কেটে দিলেন।

আবারো সাইট ঠিক করলাম। আবারো কিছুক্ষণ পর ডাউন হয়ে গেলো। আবারো হ্যাকারের ফোন। এভাবে ৫/৬বার ইঁদুর-বেড়াল খেলার পর হ্যাকার বললো, আপনার সাথে ব্যাক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু আমাদের আঘাত লাগে এমন শব্দ কেন ব্যবহার করেন। আপনার অনলাইনের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ ক্যাটাগরি বাদ দিতে হবে।

আমি বললাম, দেখুন, আমরা সংবিধান অনুযায়ী ‘উপজাতি’ শব্দ ছাড়াও, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা’ শব্দগুলো ব্যবহার করি। আপনার আবেগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে এই শব্দগুলোর যেকোনোটি ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু তার দাবী ‘আদিবাসী’ই লিখতে হবে। আমি বললাম, সাংবিধানিক, ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিকভাবে এটা তো ঠিক নয়। আমরা সেটা পারবো না। এরপর বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, শান্তিচুক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যুক্তিতর্ক চললো। কিন্তু তিনি উত্তর না দিতে পারলে এসবের ধার ধারেন না।

তিনি বললেন, আমরা আমাদের আদর্শের জন্য কাজ করছি। আমাদের একটাই দাবী।

আমি বললাম, পার্বত্যনিউজও একটি সুনির্দিষ্ট আদর্শ ধারণ করে। আমাদের পক্ষেও সম্ভব নয় আদর্শের সাথে আপোষ করা।

সারাদিন এভাবে বার ত্রিশেক আমরা আমাদের সাইট আপ করেছি এবং প্রত্যেকবার তিনি ডাউন করেছেন। ১৭ মার্চ দিবাগত রাত ১টার সময় তিনি ফোন করে বললেন, সর্বশেষ বার বলছি, আপনি রাজী হলে সাইট ছেড়ে দেবো। এবারে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে আমি বললাম, আপনার যা করার করতে থাকুন। আমি আপনাদের কোনো দাবী মানবো না।

সেদিন সারারাত আর সাইট আপ করতে পারিনি। এদিকে পাঠক, শুভানুধ্যায়ী, সাংবাদিকসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফোন, ম্যাসেঞ্জারে টেক্সট, পার্বত্যনিউজ দেখছি না কেন? উত্তর দিতে জেরবার আমি ও হেড অফিসের সাংবাদিকবৃন্দ।

সকালে কিছু সময়ের জন্য সাইট আপ করতে পারলেও তিনি আবার ডাউন করে ফোন দিয়ে বললেন, আমি তো বলেছি, আপ করে লাভ নেই। আপনাদের সাইটে দেখলাম রিয়েল এডসেন্স লাগানো আছে। চলে গেলে আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমার দাবী মেনে নিন।

কী বলবো! এমনিতেই স্পন্ডলাইটিস ও আর্থারাইটেসর ব্যথায় কাতর। তার উপর এই নতুন যন্ত্রণা! স্ত্রী বললেন, ফোন কেটে দাও। দিলাম। সে বললো, আর ওর ফোন আর রিসিভ করো না। সে পেয়ে বসবে। পরের দিনও কেটে গেলো। একপর্যায়ে বিদেশী এক্সপার্টদের সহায়তা নিলাম। অবশেষে গতকাল বিকেল থেকে সাইটটা একটু একটু করে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসতে লাগলো। গত মাঝরাতে পুরোপুরি হ্যাকারকে আটকানো সম্ভব হলো।

পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ হ্যাকারদের এডভেঞ্চারিজমের একটা সাধারণ প্রবণতা পার্বত্যনিউজ হ্যাক করা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রায়ই এ অপচেষ্টা রুখতে হয়েছে। দুইবছর আগে একবার ১৭ দিনের জন্য সাইট ডাউন ছিলো। সে কারণে অন্য অনেক সাইটের চেয়ে পার্বত্যনিউজের গঠন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক উন্নত করা হয়েছে। সার্ভার মিররিং, রিয়েলটাইম দুইটি ব্যাকআপ ছাড়াও স্ক্রিপ্টের নিরাপত্তা অনেক উন্নত করা হয়েছে।

ফলে অনেক চেষ্টা করেও আমাদের সার্ভারের নিরাপত্তা ভাঙতে পারেনি হ্যাকার। এমনকি স্ক্রিপ্টের মধ্যেও প্রবেশ করতে পারেনি। রিয়েল টাইম ডবল ব্যাক আপ থাকায় ডাটা নিয়েও কোনো উদ্বেগ ছিলো না। তবে হ্যাকার অনেকটা বিশেষ কায়দায় সাইট লোড হতে দিচ্ছিলেন না। এ এক দীর্ঘ যুদ্ধ।

অবশ্য পার্বত্যনিউজ মানেই লড়াই। যারা আমার কাছের বা পরিচিত মানুষ এবং আমাদের সকল প্রতিনিধিরা জানেন, আমি সবসময় বলি, পার্বত্যনিউজ মানে এক লড়াই। আদর্শের লড়াই। দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। কাজেই এ লড়াইয়ে নানারকম প্রতিবন্ধকতা, হুমকি, ঝুঁকি থাকবে। যারা পার্বত্যনিউজে কাজ করেন, আমার সেই সব সহকর্মীদের প্রতিনিয়ত এসবের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি কৃতজ্ঞ যে, তারা এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও আমাদের সাথে রয়েছেন। অবশ্য অনেকে টিকতে না পেরে চলেও গিয়েছেন। তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা- তারা ছিলেন তো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখিতে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগে আমাকে বিভিন্ন ধরণের অনেক হুমকি মোকাবেলা করতে হয়েছে। আমার উপর সরাসরি হামলার চেষ্টাও হয়েছে একাধিকবার। এখনো এমন কোনো সপ্তাহ নেই যে, কোনো না কোনোভাবে আমার উপর হুমকি আসে না। তবে মুসলমান হিসেবে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আমার ব্যাপারে যেকোনো সিদ্ধান্ত আসমান থেকে আসবে। জমীন থেকে নয়। এই গভীর বিশ্বাস আমাকে প্রবল শক্তি দেয়- যা সকল হমুকিকে উপেক্ষা ও পাত্তা না দিতে বিপুল সাহস যোগায়।

শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্যনিউজ তার লক্ষ্য, আদর্শ ও উদ্দেশ্য থেকে এক মুহুর্তের জন্য বিচ্যুত হয়নি। আমাদের এই অবিচল ও অটুট মনোভাব একসময় (পথ ভিন্ন হলেও) ভিন্নমতাবলম্বীদেরকেও আমাদের ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল করেছে। সেকারণে পার্বত্যনিউজ শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও সবচেয়ে পঠিত গণমাধ্যম।

শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, সারাদেশের মানুষের কাছেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে জানার, দেখার ও অধ্যয়ন করার সবচেয়ে জনপ্রিয় ডিজিটাল জানালায় পরিণত হয়েছে। এরজন্য পাঠক, সাংবাদিক, শুভানুধ্যায়ী সকলের অবদান রয়েছে।

অন্যদিকে একই আদর্শের ভিত্তিতে পার্বত্যনিউজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পর দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টিকারী রোহিঙ্গা ইস্যুতেও একইভাবে তৎপর রয়েছে। পার্বত্যনিউজের ৮ জন প্রতিনিধি বিশেষভাবে সরাসরি রোহিঙ্গা ইস্যু দেখভাল করেন। ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দেশের অন্য যেকোনো গণমাধ্যমের চেয়ে পার্বত্যনিউজে সর্বাগ্রে অধিক সংবাদ প্রকাশিত হয়।

পার্বত্যনিউজের কাছে সর্বাগ্রে দেশ। দেশের সার্বভৌমত্ব। যেকোনো পরিস্থিতিতেই পার্বত্যনিউজ তার আদর্শের সাথে নূন্যতম আপোষ করবে না। কোনো অপশক্তির কাছে যেকোনো পরিস্থিতিতেই মাথা নত করবে না। আমাদের চেতনায় আছে, যতোবার মারবে, ততবারই জন্মাবো এই মাটিতে। এই মাটি আমার। কোনো অপশক্তির কাছে এর এককণাও ছেড়ে দেবো না কোনোকিছুতেই।

সম্পাদক ও প্রকাশক, পার্বত্যনিউজ।


লেখকের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক আরো লেখা

 

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: পার্বত্যনিউজ, পার্বত্যনিউজ হ্যাকিং
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন