ক্ষণিকের অতিথি
১৯৮২ সালের মার্চ মাসের কোনো এক দিন। আমি তখন সেনাবাহিনীতে একজন লেফটেন্যান্ট, ৩৬ ই বেঙ্গলে চাকরি করি। আমি আমার বি কোম্পানি নিয়ে খাগড়াছড়িস্থ ভাই-বোন ছড়ার ৫ মাইল উত্তরে কুরাদিয়া ছড়া এলাকায় একটা ক্যাম্প স্থাপন করার কাজে নিয়োজিত। ক্যাম্প স্থাপনকালে কোম্পানির সকলে আমরা তাঁবু খাটিয়ে যে যার তাঁবুতে অবস্থান করছি।
এক রাতে ডিনারের কিছু পর তাঁবুতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমার ছোট ট্রানজিস্টরটার টিউনিং নব ঘুরাচ্ছি এবং একটা মিউজিক স্টেশন খুঁজে পাবার চেষ্টা করছি। ওই রাতে আমাদের কোন অপারেশন ছিল না। অতএব একটু রিলাক্সড মুডে ছিলাম।
হারিকেনের আলো কমিয়ে রেখেছিলাম। চোখে একটু তন্দ্রা এসে গিয়েছিলো। হঠাৎ ফোঁৎ ফোঁৎ করে দু’বার কানের পাশে কিসের যেন আওয়াজ পেলাম। ঘুম ছুটে গেল। মাথাটা বাম দিকে একটু কাত করে দেখার চেষ্টা করলাম, তাঁবুর ভিতরে কেউ ঢুকে পড়ল কি-না। একই সময়ে ভাবছিলাম তাঁবুর উভয় দিকের প্রবেশ পথ দুটো আমি নিজ হাতে বন্ধ করেই তবে বিছানায় এসেছি। তাহলে এর মধ্যে কেউ ঢুকবেই বা কী করে?
কিন্তু জ্বল জ্বল করছে ও দুটো কী? ওখান থেকেই আবার ফোঁৎ করে একটা অস্ফুট শব্দ বেরুল এবং জ্বল জ্বল করা জিনিস দুটো একটু নড়ে উঠল। মাথাটা আরেকটু উঁচু করে দু-চার বার চোখের পলক ফেলে ওখানে কী দাঁড়িয়ে আছে তা ভালো করে বুঝার চেষ্টা করলাম। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম, ওটা একটা চার-পেয়ে জন্তু, শিয়াল। আমি যেভাবে ওকে দেখছি, ঠিক একইভাবে সেও আমাকে বিস্ময়ের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে।
বিছানায় সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতেই শিয়ালটি তাঁবুর পেছনের প্রবেশ পথের দিকে দিল এক দৌড়।
তাঁবুর সামনের ও পিছনের প্রবেশ পথ দুটির পাল্লা জুতার ফিতার মতো করে পেঁচিয়ে আটকানো। তবে প্রবেশ পথের আইলেটগুলির ফাঁক দিয়ে বাইরের চাঁদনী রাতের আলো সামান্য দেখা যাচ্ছিল। শিয়াল ভেবেছিল, ওখানে হয়তো সে কোনো ওপেনিং পাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না।
মুখে প্রচণ্ড গুতা খেয়ে সমারসল্টের মতো করে উল্টে পড়লো। আমার কাছে অবস্থা তখন বেগতিক মনে হোল। হাতের কাছে আছে ছোট্ট একটা ট্রান্জিস্টর ও হারিকেন। ওকে থামাতে এ দুটোর কোনটিই কাজে আসবে না। সাথে আর আছে আমার সর্ব সময়ের সঙ্গী, গুলি ভর্তি একটা এসএমজি।
সমারসল্ট খেয়ে প্রাণীটি অধিক উত্তেজিত হয়ে পড়েছে বুঝতে পারলাম। সে আর সময় ক্ষেপণ না করে এবার সামনের প্রবেশ পথের দিকে ছুটল। ওদিকের প্রবেশ পথের আইলেটগুলার ফাঁক দিয়েও বাইরের আলো একটু একটু দেখা যাচ্ছিলো।
ওখানে গিয়েও সে ভীষণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলো এবং উল্টা দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। এবারে কী করবে ভাবছে।
ভীষণ উত্তেজিত সে। ওর যেহেতু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, এখন আমাকেই না আক্রমণ করে বসে!
এসএমজি হাতে নিলাম ঠিকই, কিন্তু আমি জানি, এটার ব্যবহার বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, আমার তাঁবুর বাইরেই সৈনিকদের তাঁবু। গুলি করলে তাদের গায়েও লাগতে পারে। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই শিয়ালটা তাঁবুর পিছনের প্রবেশ পথের দিকে আরেকবার অধিক বেগে ছুটল এবং আবারও একটা সমারসল্ট খেল!
তৃতীয় বার ধাক্কা খাবার পর পণ্ডিত মশাই সম্ভবত সম্বিৎ ফিরে পেল। তার মনে পড়ে গেল যে সে ভিতরে ঢুকেছিল কীভাবে।
অতএব, এবারে দৌড় না দিয়ে ত্রস্ত ও ধীর পায়ে সামনের প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে গেল এবং মাথা মাটির সাথে মিশিয়ে তাঁবুর দুই পাল্লার সংযোগ স্থলের মাঝে নাক গলিয়ে উপরের দিকে ঠেলে উঁচু করল, তারপর তাঁবু থেকে বেরিয়ে যেতে সমর্থ হলো।
শিয়াল তার বুদ্ধিমত্তাটা একটু দেরীতেই প্রয়োগ করল। আর আমি অন্তত হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।