খাগড়াছড়িতে তীব্র পানির সংকট: কঠিন বাস্তবতার শিকার ৭ গ্রামের মানুষ

খাগড়াছড়িতে ৭টি গ্রামের প্রায় ৭০০ পরিবার তীব্র পানির সংকটে রয়েছে। নদীসহ ছোট-বড় খাল ও ঝর্না শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার ৪নং পেরাছড়া ইউনিয়নের কাপতলা পাড়া, ভাঙ্গামুড়া,পূর্ণবাসন পাড়াসহ ৭টি গ্রামের প্রায় ৭'শ পরিবারের বসবাস। এ পাড়ার একমাত্র পানির উৎস হলো দুটি ছড়া ও ছোট ছোট ৩টি কুয়া। তীব্র খরার কারণে কুয়ার পানি শুকিয়ে গেছে। এখন নালার নোংরা পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে তাঁদের।
কাপতলা পাড়ার আশপাশের গ্রামের লোকজনেরও একই অবস্থা। এ বছর ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকেই দেখা দিয়েছে পানির সংকট। ওই এলাকার খাওয়ার পানির ভরসা ছড়ার পাড়ে কুয়া। বর্ষায় সময় বৃষ্টির পানিতে কিছুটা সংকট কেটে গেলেও শুষ্ক মৌসুম এলে বেড়ে যায় পানির ভোগান্তি।
এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন তীব্র পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জেলার চেঙ্গী নদীসহ ছোট-বড় খাল ও পাহাড়ি ঝরনা শুকিয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার লোকজন বলেছেন, কেবল খরা নয়, নির্বিচার গাছ কাটা, প্রাকৃতিক বন উজাড় করে অতিরিক্ত সেগুনগাছ লাগানোর কারণে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
শচী রানী ত্রিপুরা জানান, আমরা ভোর ৪টায় ঘুম থেকে উঠে পাহাড় ডিঙিয়ে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি আনতে হয়। বহু বছর ধরেই ডিসেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত এটি তাদের প্রতিদিনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাঝেমধ্যে ভাবেন একদিন পানির কষ্ট দূর হবে, সুপেয় পানির ব্যবস্থা হবে তবে সে আশাও এখন ছেড়ে দিয়েছেন। বর্ষাকাল ছাড়া পাড়ার বহু লোকজন কূয়া থেকে পানি ব্যবহার বুঝেশুনে করেন। শুধুমাত্র বৃষ্টির মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি তাঁদের জন্য আশীর্বাদ। তবে সেটিও বাড়ির পার্শ্ববর্তী ঝিরি আর কূয়া থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। সেটি মোটেও সুপেয় সুপেয় পানি নয়।
জগমালা ত্রিপুরা জানান, আমাদের সংসারে দৈনিক প্রয়োজন হয় অনেক বেশি। যখন যার সময় হয়, তখন তিনি দৈনন্দিন ব্যবহারের পানি নিয়ে আসেন। অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। কমপক্ষে ২থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগে একবার পানি আনতে। পানি আনতে গিয়ে কূয়ায় গিয়ে অপেক্ষা করে থাকতে হয়। কুয়ার পানিও প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
ভাগ্য লক্ষী ত্রিপুরারও একই অবস্থা। প্রতিদিন তাঁদেরও ভোরবেলায় ছুটতে হয় পানির জন্য। তাঁদের পানির জন্য যেতে হয় দুটি পাহাড় পার হয়ে দেড় কিলোমিটার দূরে। ভোরে না গেলে পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তখন পানি নিয়ে আসতে আসতে রোদ উঠে যায়। রোদ উঠে গেলে কষ্ট বেড়ে যায় দ্বিগুণ।
গত শনিবার সকালে খাগড়াছড়ি সদর থেকে প্রায়১ ০কিলোমিটার দূরে কাপতলা পাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছোট কুয়া বাঁধ দিয়ে পানি ধরে রেখেছিলেন এলাকবাসীরা। কিন্তু সেটাও এখন শুকিয়ে গেছে। এলাকবাসীরা যে কূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতো, সেটাও ধীরগতিতে পানি উঠে। অনেকে ৩-৪কিলোমিটার দূরে গিয়ে আনতে না পেরে দাঁড়িয়ে পানির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছেন কয়েকজন নারী ও শিশু।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আমাদের কুয়া ছাড়া পাড়ায় কোনো সুপেয় পানির ব্যবস্থা নেই। ছোট পাথরের ১টি কুয়া থেকে গ্রামের সবার পানি ব্যবহার করতে হয়। ডিসেম্বর থেকে জুন মাস পর্যন্ত বৃষ্টি না থাকায় ও তীব্র তো কুয়ায় পানি ওঠে না।। তাই বাধ্য হয়েই অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রাপ্ত মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, এলাকায় সবচেয়ে বেশি সমস্যা যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি, এখানে পানির সমস্যা বেশি। কারণ এখানে যে পানির উৎসগুলো রয়েছে, সেই উৎসগুলো এখন নাই। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে কি কি উপায়ে পানি দেওয়া সুযোগ রয়েছে সেটা দেখার ব্যাপার আছে। পার্বত্য জেলা পরিষদ বা অন্যান্য যে কর্তৃপক্ষগুলো রয়েছে, তারা যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমাদের এই এলাকাবাসী পানি সুবিধা পাবে।
সমাজকর্মী বিনোদন ত্রিপুরা বলেন, তাদের এখানে ডিসেম্বরের পরপরেই বর্ষা মৌসুম শেষ হলে এলাকাবাসীরা চরম পানির সংকটে পড়ে। জুন মাস পর্যন্ত তাদের এখানে তীব্র পানির সংকট দেখা দেয়। তারা বহুদূরে গিয়ে ছড়ার পানি সংগ্রহ করতে হয়।
এতে করে এখানকার স্থানীয়দের পানির জন্য কঠিন সময় অতিক্রম করতে হয়। প্রায় ৬মাস পাহাড়ের পানির উৎস একেবারেই কম থাকে। এখানকার পানির সমস্যাগুলো জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরের সুদৃষ্টি কামনা করছি,যেন এই এলাকার জন্য পানির সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা হয়।
জেলা প্রশাসক এবি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান, আমাদের পাহাড়ের অন্যতম একটি বড় সমস্যা হচ্ছে সুপেয় পানির অভাব। পাহাড়ের মূল পানির উৎস হচ্ছে ছড়া এবং কূয়ার পানি। এখানে আসলেই ভূগর্ভস্থ পানি পাওয়া যায় না। এটি নিয়ে কাজ করছি।
এখানে যারা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা যারা আছেন,আমরা তাদের সাথে কথা বলেছি। কিভাবে আমরা এটি দূর করতে পারি, আমরা যেসব অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে। সে সকল এলাকায় আমরা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প স্থাপন করতে পারি। এখানে আসলেই সব জায়গায় পাম্প স্থাপন করা ঠিক হবেনা।
এই সিজনে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সেজন্য প্রাকৃতিক আধারকে ব্যবহার করতে পারি। সেজন্য আমাদের বেশ কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। ছড়ার পানিকে সংরক্ষণ করে বৃষ্টির পানি আধারকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে পারি।
সে বিষয়ে আমাদের প্রস্তাব দেওয়া আছে,আমাদের উচ্চ পর্যায়ে। যেটি ইতিমধ্যেই আলোচনা হয়েছে। সেটি হয়তো আমরা দিকনির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আর আমাদের যারা উন্নয়ন সহযোগী আছেন তাদের কাছ থেকে সাড়া পেলে খুব দ্রুত আমরা পদক্ষেপ নেবো। তবে স্থানীয়ভাবেও আমাদের প্রচেষ্টা চলছে বিভিন্ন জায়গায়।
আমরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারদেরকেও বলেছি ছোট প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে যাতে আমরা যেন পানির সংকট দূর করতে পারি,সে বিষয়ে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে।