অনুসন্ধানী প্রতিবেদন

খাগড়াছড়িতে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের বিরোধিতা করে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ইউপিডিএফের অপপ্রচার

fec-image

পনেন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রী চিরনদেবী ও ছেলে জনি ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে জানান, যে জমিতে  সেনাবাহিনী  ক্লিনিকটি স্থাপন করছে সেটা খাস ও অপ্রয়োজনীয় জমি। তারা খাস জমিতে ভোগ দখল করে বসবাস করছেন ।

খাগড়াছড়িতে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের বিরোধিতা করে সেনাবাহিনীর  বিরুদ্ধে  বিভিন্নভাবে অপপ্রচার করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় একটি কুচক্রিমহল নির্মাণাধীন গৃহভাংচুর ও ভূমি বেদখলের অভিযোগ তুলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির চেষ্টাসহ ক্লিনিক স্থাপন প্রতিরোধ করতে চাইছে ।

সেনাবাহিনীর মহালছড়ি জোনের উদ্যোগে দুর্গম পঙ্খীমুড়া, ধমনীঘাট এলাকায় সরকারী খাস জমিতে স্থাপন করা হচ্ছে  কমিউনিটি ক্লিনিকটি। এনিয়ে  বিক্ষোভ মিছিল, অবরোধসহ প্রতিবাদ ও ক্লিনিক স্থাপন প্রতিরোধমূলক  নানান কার্যক্রম করছে ত্রিপুরা স্টুডেন্ট ফোরাম বাংলাদেশসহ  আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন নেতাকর্মীরা।

ইউপিডিএফ সংশ্লিষ্টদের দাবি, ‘সনেরঞ্জন ত্রিপুরা নামে জমিটির দলিলপত্র রয়েছে। তিনি বাগান সৃজন করে জমিটি ভোগ দখলে রয়েছেন। সম্প্রতি সেখানে সনেরঞ্জন ত্রিপুরার র্নিমাণাধীন ঘরটি ভেঙ্গে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের  সাইনবোর্ড স্থাপন করেছে সেনাবাহিনী’।

নির্মাণাধীন নয়নাভিরাম জালিয়াপাড়া-মহালছড়ি সড়ক।

 

অপরদিকে সেনাবাহিনী সূত্র জানান, খাগড়াছড়ি  রিজিয়নের অধীনে মহালছড়ি জোনের উদ্যোগে করোনাকালীন সময় থেকে ওই এলাকায় বসবাসরত অসহায় জনগণের প্রস্তাবিত ওই ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা সেবা, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও বিনামূল্যে ওষধ সরবরাহ ও  মানবিক সহায়তা কার্যক্রম দেওয়া হচ্ছে। গোষ্ঠী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে  অসহায় (অসুস্থ) রোগিদের এ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত ক্লিনিকের  জায়গাটি সরকারী (খাস)। সেখানে সনে রঞ্জন নামে কোন লোকের দলিল পত্রের জমি নেই। ওই এলাকার মানুষের মানবিক সহযোগিতার লক্ষে ক্লিনিকটি করা হচ্ছে।

একটি ক্লিনিক স্থাপন ওই এলাকার সাধারন মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো। ক্লিনিক স্থাপনের একটি কমিটিও  রয়েছে। একটি কুচক্রি মহল নিজেদের হীন স্বার্থে ক্লিনিকটি স্থাপনে বিরোধিতা করে অপপ্রচার করছে। এটাকে ইস্যু করে বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশ করে সেনাবাহিনীকে বির্তকিত  করার অপচেষ্টা করছে। বিষয়টি দুঃখজনক।

বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পার্বত্যনিউজ সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। গুইমারা উপজেলার জালিয়াপাড়া থেকে মহালছড়ি পর্যন্ত আনুমানিক ২৪ কি.মি নতুন সড়ক নির্মাণ করেছে সেনাবাহিনীর ১৯ ও ২০ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন। বিরোধিত কমিউনিটি ক্লিনিকটি স্থাপন করা হচ্ছে, গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের পঙ্খীমোড়া পাড়ায় উক্ত সড়কের পাশে। পরিদর্শনকালে ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনীর কমিউনিটি ক্লিনিকের একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।সেখানে তাঁবু টানিয়ে সেনাবাহিনী চিকিৎসকদের স্থানীয় উপজাতীয়দের চিকিৎসা দিতে দেখা যায়।

স্থানীয়দের বক্তব্যে জানা যায়, সেখানে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য  ওই এলাকার লোকজন  ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ইতিপূর্বে আবেদন করেছে । স্থানীয় কারবারি সুষমা চাকমাকে সভাপতি করে ক্লিনিক স্থাপনের একটি বাস্তবায়ন কমিটিও গঠিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পূর্ব থেকেই ওই স্থানে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে।

জমিটির কাগজপত্র অনুসন্ধান করে দেখা যায়, দাবীকৃত জমিটি মুলতঃ পনেন্দ্র ত্রিপুরা নামে এক লোক ২০০২ সালে বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য আবেদন করেন। এরপর তিনি মারা যান। ফলে তার নামে বন্দোবস্তি হয়নি। সেকারণে জমিটি এখনো খাস বা সরকারি সম্পত্তির আওতায় রয়ে গেছে। তাছাড়া জায়গাটি পরিমাপ করলে নব নির্মিত সড়কের জায়গার মধ্যেই পড়ে। উক্ত জমির কাছাকাছি পনেন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রী ও সন্তানরা বসবাস করেন। সেজমিও খাস। বৈধ কাগজপত্র নেই। পনেন্দ্র ত্রিপুরার মারা যাওয়ার ১২ বছর পর তার স্ত্রীকে বিয়ে করে সেখানে বসবাস করছেন সনে রঞ্জন ত্রিপুরা। তার নামেও কোন দলিলপত্র নেই।

সনে রঞ্জন ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে জানান, পনেন্দ্র ত্রিপুরা পাচঁ একর জমি বন্দোবস্তি পাওয়ার আবেদন করেছিলো। তিনি মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রীকে বিয়ে করে প্রস্তাবিত ক্লিনিকের পাশেই তারা বসবাস করছেন। পনেন্দ্র ত্রিপুরার  আবেদন ও ভোগদখল  মূলে তিনি জমিটি দাবি করছেন।

এ ব্যাপারে সিন্দুকছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেদাক মারমা পার্বত্যনিউজকে জানান, সিন্দুকছড়ির দূর্গম পঙ্খীমুড়া, ধুমনীঘাট  ও ঠান্ডাছড়ি এলাকার মানুষ স্বাস্থ্য সেবায় একটু  বেশি অবহেলিত। ওই এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন হোক। যেহেতু এখনো উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। ক্লিনিক স্থাপনের জন্য ইতিপূর্বে স্বাস্থ্যখাতসহ বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ওই এলাকার একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করায় চিকিৎসা সেবায় জনগণ উপকৃত হবে।উন্নয়ন সকলের প্রয়োজন। উন্নয়নের জন্য জমিও প্রয়োজন। জমির নিয়ে  জটিলতা থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে শেষ করা হবে।

ক্লিনিক স্থাপন কমিটির সভাপতি স্থানীয় সুষমা কারবারী পার্বত্যনিউজকে জানান, এ এলাকার অসুস্থ রোগীদের দুরের মহালছড়ি উপজেলা সদরে যেতে হয়। একটি ক্লিনিকের জন্য তারা বিভিন্ন দপ্তরে আবেদন করেছেন। সেনাবাহিনী একটি  ক্লিনিকটি স্থাপন করায় চিকিৎসা সেবায় তাদের অনেক বড় উপকার হয়েছে।

পনেন্দ্র ত্রিপুরার স্ত্রী চিরনদেবী ও ছেলে জনি ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে জানান, যে জমিতে  সেনাবাহিনী  ক্লিনিকটি স্থাপন করছে সেটা খাস ও অপ্রয়োজনীয় জমি। তারা খাস জমিতে ভোগ দখল করে বসবাস করছেন ।

স্থানীয় মৌজা প্রধান সুইনুপ্রু চৌধুরী (সাবেক চেয়ারম্যান) পার্বত্যনিউজকে জানান, সনে রঞ্জন ত্রিপুরার নামে কোন জমি নেই। তবে পনেন্দ্র ত্রিপুরা নামে এক লোক ২০০২ সালে ওই জমিটি বন্দোবস্তি পাওয়ার আবেদন করেছেন। পরে তিনি মারা যাওয়ায় সেই আবেদন নিয়ম অনুযায়ী বাতিল হয়ে গেছে। ক্লিনিক স্থাপনে জমির বিষয়টি, মৌজা প্রধান, ভূমি অফিস, জেলা প্রশাসক নিরসন করে দিতে পারেন।

মহালছড়ি সহকারী কমিশনার (ভূমি)তাহমিনা আফরোজ ভূইয়া পার্বত্যনিউজকে জানান, সনে রঞ্জন ত্রিপুরা নামে কোন লোকের পক্ষ থেকে ক্লিনিক স্থাপনের জমিটি তার ব্যক্তি মালিকানাধীন- এ ধরনের অভিযোগ বা দাবি তিনি পাননি।  সনে রঞ্জন ত্রিপুরার  নামে অফিসে কোন রেকর্ড বা দলিল পত্র আছে বলে তার জানা নেই।

খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে জানান, আপনি জানেন পাহাড়ে একটি গোষ্ঠী আছে যারা সবকিছুতে উষ্কানী দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। এখানেও সেই কাজটি হচ্ছে। আমি শুনেছি, ওই জায়গায় কারো ব্যক্তিগত জমি নেই। স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবেন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, পাহাড়ে উন্নয়নের বিরোধিতা করার জন্য একটি মহল এখানে সব সময় কাজ করে।

এদিকে পার্বত্য নাগরিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির পার্বত্যনিউজকে জানান, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর  প্রতিটি উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে বিরোধিতা করে। সড়কের পাশে সরকারি খাস ভূমিতে বাঁশ দিয়ে ঘর নির্মাণ করে আবার নিজেরাই সে ঘরটি ভেঙেছে। আর দোষারোপ করছে সেনাবাহিনীকে । মিথ্যা গুজব রটিয়ে ক্লিনিক স্থাপনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার  নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি।

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা আলমগীর হোসেন পার্বত্যনিউজকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে বিরোধ আসলে মূল ইস্যু নয়। সম্প্রতি সেনাবাহিনী যে সড়কটি নির্মাণ করেছে তার চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মেরিন ড্রাইভের মতো। এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ইতোমধ্যেই আশপাশের জনগণ প্রতিদিন ভিড় করছে। সড়কটি চালু হলে বাংলাদেশের পর্যটনখাতে একটি নতুন সংযোজন ঘটবে এবং সড়কের দু’পাশে অনেক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে। ইউপিডিএফ শুরু থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটক আগমণের বিরোধী অবস্থান নিয়ে পর্যটন উন্নয়নের বিরোধিতা করে আসছে।

তিনি আরো বলেন, ইউপিডিএফ সাজেক পর্যটন কেন্দ্রের বিরোধিতা করে সফল না হলেও আলুটিলা কেন্দ্রিক পর্যটন প্রকল্পের বিরোধিতা করে সফল হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিকের বিরোধিতা করা হচ্ছে টেস্ট কেস হিসেবে। কেননা, ইতোমধ্যেই তাদের সমর্থকেরা ওই সড়কের দুইপাশে বিভিন্ন স্থানে খাস জমিতে বাঁশ, খুঁটি নিয়ে জমা করেছে।

এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার আহমেদের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি প্রশ্ন শোনার পর ফোন সংযোগ কেটে দেন। এরপরে আরো কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।

এদিকে একই ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাসের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ইউপিডিএফ, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনী
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন