পরীক্ষার আগের ভোর রাতেই পার্বত্যনিউজের কাছে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র চলে আসে

খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ

খাগড়াছড়িতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার প্রশ্নে  কোন আপস নয় বলে সাফ ঘোষণা দিয়েছিলেন খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু। সে সাথে কোন অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ পেলে সরাসরি তাকে জানানোর অনুরোধ করেছিলেন।কিন্তু জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের এমন হুঁশিয়ারী সত্ত্বেও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের আভিযোগ উঠেছে।

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারী) খাগড়াছড়ি সদরের ৫ টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়া পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ কেন্দ্রে এক প্রার্থীকে লিখিত উত্তর পত্র সরবরাহ করার অভিযোগে মুহাম্মদ সাজু নামে এক সাংবাদিক আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদ হোসেন। পাশাপাশি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট হচ্ছে।

খাগড়াছড়ির সাংবাদিক ও লাইভ সিএইচটির বার্তা সম্পাদক সাইফুল ইসলাম এমডি মেহেদী হাসানের পোস্ট আংশিক কপি করে তার ফেসবুক প্রোফাইলে লেখেন,

“শিরোনাম টা যথেষ্ট মজার ছিলো…

সোর্স কমেন্ট বক্সে দেয়া আছে! আপনারাও দেখে অন্যকে দেখার সুযোগ করে দিন। দলবদ্ধ হয়ে বিনোদন নিই….

#আবেদন_ফি_ফেরত_চাই

পার্বত্য জেলা পরিষদের আওতাধীন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ খাগড়াছড়ি (২০১৭)পরিক্ষা হল আজ ১৯/০২/২০২১।

অনেক জল্পনা-কল্পনায় বিভোর ছিলাম এ পরিক্ষা নিয়ে। আশায় বুক বেধে ছিলাম বর্তমান সরকারের স্বচ্ছতা দেখে। গত কিছুদিন আগে জেলা প্রশাষকের কার্যালয়ের নিয়োগ আমাকে আরো আগ্রহী করে তোলে পরিক্ষাটি দিতে।

কিন্তু আজ পরিক্ষার হলে গিয়ে আমার চোখ কপালে উঠে গেলো। পরিক্ষাটি দিব না-কি দিব না, ভাবতেই ঘন্টা পার করে দিয়েছি।

প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিলো নিশ্চিৎ। আমার পাশেই একজন চাকমা মেয়ে (রোলঃ১৫১* ) হুবহু উত্তর খাতায় লিখে এনেছে আগ থেকেই। ২ ব্রেঞ্চ আগে বসা আরেকজন চাকমা মেয়ে (রোল দেখি নি) হুবহু হাতে, রানে কাপরে উত্তর লিখে এনেছে।

পরিক্ষার হল থেকে বের হলাম, পরিচিত এক বড়ভাইয়ের হাতে দেখি দুইটা চিরকুট। হাতে নিয়ে দেখলাম হুবহু উত্তর।

ভাইয়া, আপনিও প্রশ্ন পাইছেন?

আরে না, আমার পাশে একজন চাকমা মেয়ে এগুলো নিয়ে আসছে। ও লেখার পর আমাকে দিছে।

বাহঃ ভালইত… দেখি ধরেন, এগুলোর একটা ছবি নেই।

ছবি তুললাম।

প্রিয় দেশবাসী, আপনাদের সমিপে চিরকুটগুলো পেশ করলাম।

আর হ্যা, যা দেখলাম সবই আমাদের আদরের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কারবার!

আর হ্যা, এমনটি হবে জানলে পরিক্ষা দিতে আসা বইকি, আবেদনই করতাম না।

আমি আমার পরিক্ষা ফি, যাতায়াত খরচ সহ যাবতীয় টাকা ফেরত চাই।”

পরীক্ষার্থী সায়নি শর্মা লিখেছেন, “আমিও আজকে পরীক্ষার হলে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম ভাইয়া। আমার আশেপাশে বসা সবাই দেখি একি কাজ গুলোই করলো।এইসব হবে আগে জানলে হয়তো আমিও যেতাম না ।এখানে মেধার মূল্য নাই মূল্য আছে টাকার।”

ফরিদ উদ্দীন লিখেছে, “ যেখানে জেলা পরিষদ ঢোল বাজিয়ে নকল ও দুর্নীতির আশ্রয় পরিহার করে পরীক্ষা নেয়ার ডায়লগ দিয়েছেন, সেখানে রাতের আঁধারে প্রশ্ন কিছু মানুষের মুঠো ফোনের মাধ্যমে বাতাসে ঘুরছে, হল রুমের শিক্ষক মহোদয়গণ আগে থেকে বুকিং সেখানে সাংবাদিক ভাইয়ের দোষ দিয়ে কি আর করা..।”

এদিকে পরীক্ষার আগের দিন ভোর রাতেই একটি সূত্র পার্বত্যনিউজ অফিসে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষা কমিটির লোকেরা ম্যাসেঞ্জারে উত্তরসহ প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দিয়েছে বলে অভিযোগ করে। তার মতে, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান পরীক্ষায় যোগ্যতার কথা বললেও জেলার এক শীর্ষ রাজনীতিকের প্রশ্রয়ে পরীক্ষার সাথে সংযুক্ত একটি চক্র ও চিহ্নিত কিছু শিক্ষকের সহায়তায় জনপ্রতি ১৩-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে এই প্রশ্ন ফাঁস কাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। তবে উচ্চমূল্যের এই প্রশ্ন কিনতে অনেকেই গ্রুপ করে টাকা সংগ্রহ করেছে। আর এতেই ফাঁসের বিষয়টি প্রকাশিত হয়ে পড়ে। তবে এ ব্যাপারে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার কোনো খবর নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

প্রমাণ স্বরূপ সূত্রটি রাতেই পার্বত্যনিউজের কাছে হাতে লেখা দুইসেট উত্তরসহ প্রশ্নপত্রের ছবি প্রেরণ করে। কিন্তু হাতে লেখা হওয়ায় পরীক্ষা শুরু না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। তবে পার্বত্যনিউজ বিষয়টি আইন শৃঙ্খলার সাথে জাড়িত স্থানীয় একটি সংস্থার নজরে আনে।

এরপর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রশ্নপত্র মিলিয়ে দেখা যায় রাতে পার্বত্যনিউজের হাতে আসা উত্তরসহ প্রশ্নপত্রের সাথে পরীক্ষার হলে দেয়া প্রশ্নপত্রের হুবহু মিল রয়েছে।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও একাধিক পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, কেন্দ্রে প্রবেশের সময় অনেক পরীক্ষার্থী মুঠোফোন ও উত্তর নিয়ে প্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাইরে  থেকে যেসব উত্তর লিখে এনেছে তার হুবহু প্রশ্নপত্রে ছিল। মুঠোফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেট ও বাহির থেকেও উত্তর জানানোর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও  উত্তরপত্র সরবরাহ করতে এসে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আটক হওয়া ব্যক্তির কাছে যে উত্তরপত্রটি ছিল তাতেও প্রশ্নের সাথে মিল রয়েছে।

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা মুঠোফোনে ফোনে দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা তিনি জানেন না। তবে পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ম বর্হিভূত ভাবে প্রবেশের অভিযোগে একজনকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আটক করেছে বলে শুনেছেন।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমি এই নিয়োগের অনিয়ম রোধে সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলাম। আমি আমার মোবাইল নম্বর দিয়েছিলাম, যাতে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে আমাকে সকলে জানাতে পারে। আমি গত ১ মাস আমার বাড়িতে কাউকে সাক্ষাৎকার দেইনি। তারপরও যদি এমন কিছু হয়ে থাকে চেয়ারম্যান হিসেবে এ ব্যর্থতা আমার।

আবেগাক্রান্ত হয়ে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, আমি ভাল কিছু করার ইচ্ছা নিয়ে জেলা পরিষদে এসেছিলাম। কিন্তু আমার মনে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমি যাওয়ার পথ খুঁজছি।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, .জেলায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে  ১শ ৮৬টি  শূন্য সহকারী শিক্ষক পদের বিপরীতে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে  খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। মামলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও করোনাকালীন সংকটের কারণে দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর বন্ধ ছিল এ নিয়োগ কার্যক্রম। এ নিয়োগে চাকরীর জন্য আবেদন করেন ৩ হাজার ৫ শ ৬৭ জন। কিন্তু শুক্রবার পরীক্ষায় অংশ নেয় ২ হাজার ৬শ ৫২ জন পরীক্ষার্থী।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ন্যস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮৬ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের আগে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। অনেকে টাকা দিয়েও চাকুরি পাননি এমন অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার প্রশ্নে  কোন আপস নয় বলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপ’র ঘোষনায় জেলার সচেতন মহলে আশার সঞ্চার হলেও  প্রাথমিক শিক্ষার মতো স্পর্শকাতর এ বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে প্রতিবারে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ বরাবরের মতো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন