ফলোআপ

যেভাবে ফাঁস হলো খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র

fec-image

পার্বত্যনিউজে প্রশ্নফাঁসের সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় পাহাড়ে তোলপাড়।। সোশ্যাল মিডিয়ায় ও টেলিফোনে অভিনন্দন

এ যেন সর্ষের ভেতর ভূত। আর সে ভূত হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্বরত চিহিৃত শিক্ষকদের সিন্ডিকেট। এ যেন বেড়ায় ক্ষেত খায়। তারা নানা কৌশলে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র সরবরাহ করে। হাতিয়ে নেয় মোটা অংকের অর্থ। একার পক্ষে এ ভূত তাড়ানোর সম্ভব না। বরং যিনি এ ভূত তাড়ানোর চেষ্টা করবেন, তিনিই বিপাকে পড়বেন। আর এই সিন্ডিকেট হচ্ছে পরীক্ষা কেন্দ্রে দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষকরা।

পরীক্ষার সিট প্ল্যান হওয়ার পরপরই তারা চাকুরি প্রার্থীদের অনুসন্ধানে নেমে পড়েন। পরীক্ষায় যে কোন উপায়ে পাশ করে দেওয়ার প্রলোভনে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের অর্থ। বিগত দিনগুলোতে এমনটি হয়ে আসছে।। যার কারণে বার বার কলঙ্কিত হচ্ছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিশেষ করে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা।

শনিবার(২০ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টা থেকে প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা স্থায়ী বৈঠকে সাংবাদিকদের সাথে বিভিন্ন বিষযে খোলামেলা আলোচনা করেন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু।

তিনি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সার্বিক সহযোগিতা প্রত্যাশা করে বলেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের যে কোন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার ঘোষণা ইতোমধ্যে দেয়া হয়েছে। প্রয়োজনে পরীক্ষা পরিচালনায় সামনে আরও কঠিন পদ্ধতি অবলম্বন করা হবে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে প্রশ্ন কর্তা ও কেন্দ্র বাইরে শিক্ষক এনে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ভাবছে জেলা পরিষদ। সাংবাদিকদের সাথে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বৈঠক চলে রাত পৌনে ১১টা পর্যন্ত।



খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু দায়িত্ব গ্রহণের পর পরই দীর্ঘ কয়েক বছরের ঝুলে থাকা নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করার পূর্বেই ঘোষণা দিয়েছিলেন খাগড়াছড়িতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার প্রশ্নে কোন আপস নয়। সে সাথে কোন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পেলে সরাসরি তাকে জানানোর অনুরোধ করেছিলেন।

তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের তথ্য থাকলে, পরীক্ষা শুরুর আগে জানালে প্রয়োজনে পরীক্ষা বাতিল করা যেতো। পরীক্ষার আগে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের হুঁশিয়ারীতেও কাজ হয়নি। বরং পবীক্ষা শুরুর সাথে সাথে পরীক্ষার্থীদের হাতে চলে যায় প্রশ্নের উত্তরপত্র। এখন প্রশ্ন হলো, চেয়ারম্যানের এমন কঠোর হুঁশিয়ারীতেও কারা করেছে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা? কিংবা কত টাকার বিনিময়ে? এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্বে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব কাজী মোখলেছুর রহমান ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা টিটন খীসা।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু জানান, ‘ভোর ৪টার দিকে দুই কর্মকর্তা প্রশ্নপত্র তৈরি শুরু করেন একটি বদ্ধ রুমে। এ সময় তাদের মোবাইল ফোন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এর হেফাজতে নেওয়া হয়। সকালে পাচঁ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্নপত্র বুঝে নেওয়ার আগ পর্যন্ত এই দুই প্রশ্নপত্র প্রনয়নকারী ছিলেন অনেকটা বন্দি। কাজেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার খবর গুজব ছাড়া কিছু না। তবে পরীক্ষা কেন্দ্র হতে পরীক্ষা শুরুর পর পর কিছু হয়ে থাকলে আগামীতে আরও সতর্ক থাকতে হবে’।

খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের শিক্ষা নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বাইছে। এ নিয়ে পার্বত্যনিউজে সংবাদ প্রকাশ হলে দেশি-বিদেশী একাধিক ব্যক্তি ম্যাসেজ দিয়ে পর্বত্যনিউজকে ধন্যবাদ জানানোর পাশাপাশি প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে নানা তথ্য দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। তারা খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের দুষ্ট চক্রকে খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক বিচার চেয়েছেন।

নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ফাতেমা মেহের ইয়াসমিন জানান, পরীক্ষার আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি তিনি শুনেননি। আর, পরীক্ষার কেন্দ্রে নিয়ম বহির্ভুতভাবে প্রবেশের অভিযোগে একজনকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আটক করেছে বলে শুনেছেন।

দীর্ঘ প্রতিক্ষিত (২০১৭ সালের) প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) খাগড়াছড়ি সদরের ৫টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ কেন্দ্রে এক প্রার্থীকে লিখিত উত্তর পত্র সরবরাহ করার অভিযোগে মুহাম্মদ সাজু নামে এক সাংবাদিককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাজ্জাদ হোসেন।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও একাধিক পরীক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রে প্রবেশের পর অনেক পরীক্ষার্থী মুঠোফোন ব্যবহার করে ইন্টারনেট ও বাহির থেকেও উত্তর জানানোর অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও উত্তরপত্র সরবরাহ করতে এসে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাজ্জাদ হোসেনের কাছে আটক হওয়া ব্যক্তির কাছে যে উত্তরপত্রটি ছিল তাতেও প্রশ্নের সাথে প্রায় মিল রয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের কিছু শিক্ষক বছরের পর বছর খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় পরীক্ষার্থীদের কৌশলে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। সিট বসানোর পর চিহিৃত এ সিন্ডিকেটের শিক্ষকরা নিজেরা পরীক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন।

সূত্রটি মতে, প্রশ্নপত্র সরবরাহের ঐ সকল দুর্নীতিবাজ শিক্ষকরা মোবাইল ফোনে ছবি তুলে বাইরে পাঠিয়ে দেন। বাইরে অপেক্ষামান অভিজ্ঞ কিছু ব্যক্তি প্রশ্নের উত্তর দ্রুত লেখে পাঠিয়ে দেন ঐ শিক্ষকের মোবাইলের ম্যাসেঞ্জারে। এর পর উত্তরপত্র পৌছে যায় পরীক্ষার্থীর কাছে।

তবে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের এবারের শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সাথে পরিষদের একজন কর্মকর্তাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। যদিও পরিষদের চেয়ারম্যান এধরনের সুযোগ ছিল না বলে জানিয়েছেন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে ন্যস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১৮৬ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। এ নিয়োগে চাকরী প্রত্যাশি ৩ হাজার ৫ শ ৬৭ জন আবেদন করেন। কিন্তু মামলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও করোনাকালীন সংকটের কারণে দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর বন্ধ ছিল এ নিয়োগ কার্যক্রম। অবশেষে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষায় অংশ নেয় ২ হাজার ৬শ ৫২ জন পরীক্ষার্থী।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের আগে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। অনেকে টাকা দিয়েও চাকুরি পাননি এমন অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে শিক্ষক নিয়োগে যোগ্যতার প্রশ্নে কোন আপস নয় বলে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মংসুইপ্রু চৌধুরীর ঘোষণায় জেলার সচেতন মহলে আশার সঞ্চার হলেও কেন্দ্রে দায়িত্বরত কিছু অসাদু শিক্ষক প্রাথমিক শিক্ষার মতো স্পর্শকাতর শিক্ষক নিয়োগে আবারও কলঙ্ক লেপন করে দিলো।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন