parbattanews

গাছে বেঁধে মেম্বারের নেতৃত্বে গৃহবধূকে রাতভর মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন: একমাস পর ভিডিও ভাইরাল

কনকনে শীতের রাতে গাছের সাথে বেঁধে হাজারো জনতার সামনে প্রকাশ্যে মধ্য যুগীয় কায়দায় মেম্বারের নেতৃত্বে নির্যাতনের শিকার হওয়ার একমাস পরও হুমকিতে ঘর ছাড়া গৃহবধূ মুখ খুলতে পারছেনা। দেরিতে হলেও এলাকার কিছু যুবক গোপনে ওই নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করা অংশটি অবশেষে ভাইরাল হয়ে পড়ায় বর্বর এ ঘটনা আর ধামাচাপা থাকেনি। প্রকাশ হয়ে পড়ার পর অবশেষে নির্যাতিতা গৃহবধূ ও তার স্বামী মুখ খুলতে শুরু করেছে। আলোচিত এ ঘটনার ভিকটিম কক্সবাজারের চৌফলদন্ডীর ৬নং ওয়ার্ড এর বেদার মিয়ার স্ত্রী নুর আয়েশা।

চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ড মেম্বার মোহাম্মদ মিয়া জঙ্গীর নেতৃত্বে একদল মানুষরূপী পশু রাতভর এ গৃহবধূকে নির্যাতন চালায়। হায়েনারা অন্ধকার রাতে রাস্তার গাছের সাথে রশি দিয়ে বেঁধে ওই গৃহবধূকে তার স্বামী, সন্তান, স্বজন ও প্রতিবেশীদের সামনে নির্যাতন চালালেও প্রভাবশালী মেম্বার ও তার পশু রুপি হায়েনা দলের ভয়ে কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার সাহস করেনি। ওই গৃহবধুকে কেউ কেউ বেধড়ক পিটাচ্ছে, কেউ শাড়ি-ব্লাউজ ধরে টানা হেচড়া করছে, আবার কেউ গৃহবধূর স্পর্শ কাতর স্থানে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি করে চলেছে। মহিলার পরিবারের সদস্যদের দেখে দেখে চোখের জল ফেলা ছাড়া কোন উপায় ছিলনা

সরেজমিনে জানা যায়, গত ২৯ ডিসেম্বর মধ্যরাতে স্থানীয় মেম্বার মোহাম্মদ মিয়া জঙ্গীর নেতৃত্বে একদল স্থানীয় দূর্বৃত্ত গৃহবধূ নুর আয়েশাকে তার ঘর থেকে টেনে হেচঁড়ে বের করে রাস্তার পাশে গাছের সাথে বেঁধে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে।পরে একই এলাকার জাগির হোছন নামের একজনকেও তার পাশাপাশি গাছের সাথে বেঁধে তার সাথে মহিলার অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে মধ্যরাত থেকে ভোররাত পর্যন্ত একনাগারে চলে এই পৈশাচিক নিপিড়ন ও ওই নারীর শ্লীলতাহানি। পরে ভোররাতে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে যেন কোন আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারে কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেয় এবং হুমকিতে ঘর ছাড়া হয়ে যায়।

দেরিতে হলেও ওই ঘটনার ভিডিও চিত্র ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে, মুহূর্তে সেটি ভাইরাল হয়ে যায়। এতে চারদিকে নিন্দা, ঘৃণা ও ধিক্কার জানানোর পাশাপাশি ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে এবং ওই পাশবিক নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি ওঠে।

সরেজমিনে ওই নারী নির্যাতনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেই দিন মধ্যরাত ২টার দিকে স্থানীয় মেম্বার মোহাম্মদ মিয়া জঙ্গীর লেলিয়ে দেয়া দূর্বৃত্তের দলের সদস্য একই গ্রামের কবির আহমদ, ইলিয়াস, শাহাবুদ্দিন, রাশেল, এরশাদ চৌকিদার এরশাদ, দফাদার জহির, রণি, রাজু ও আমির হোসেন পাক হানাদার বাহিনীর মত আচমকা রাতের আঁধারে ওই গৃহবধূর ঘরের দরজা আঘাতের পর আঘাত করতে থাকে।এক পর্যায়ে ঘুমন্ত নুর আয়েশার শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্বামী বেদার দরজা খুলে দিলে হায়েনারা নুর আয়েশার বিরুদ্ধে পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ তুলে তাকে টেনেহেচঁড়ে ঘর থেকে বের করে রাস্তার একটি গাছের সাথে বেঁধে পৈশাচিক কায়দায় লাঠিপেঠা শুরু করে। তার অর্ধনগ্ন শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে শ্লীলতাহানি করে এবং হাজারো মানুষের সামনে তারা আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করে উপভোগ করে।এ নারী তাকে রক্ষার আকুতি জানালেও প্রভাবশালী মেম্বার চক্রের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ বা রক্ষার সাহস করেনি।

মধ্যরাত পর্যন্ত দফায় দফায় চলে এই নির্যাতন। নির্যাতনের শিকার গৃহবধূর স্বামী-সন্তানরা অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে দেখেছে ওই নিপিড়নের চিত্র, ফেলেছে চোখের পানি। নির্যাতিতার স্বামী বেদার মিয়া বলেন, আমার স্ত্রী সেদিন আমার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল। পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটি মেম্বারের সাজানো নাটক। দীর্ঘদিন ওই চক্রটি আমি প্রতিবন্ধী হওয়ার সুযোগে আমার স্ত্রীকে কুপ্রস্তাব দিয়ে প্ররোচিত করত। সে প্রস্তাবে ব্যর্থ হয়ে নানা অযুহাতে, আর অভিযোগে আমার পরিবারকে নিগৃহীত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। জাগির হোসেনের সাথে তার স্ত্রীর পরকিয়া নেই বলে দাবি করে এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করে বলেন, তার স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে নেয়ার সময় মেম্বার তাকেও মারধর করে।

নির্যাতিতা নুর আয়েশা বলেন, আমার স্বামী একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধি। সেই সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে এলাকার চিহ্নিত কতিপয় লম্পট ও দূর্বৃত্ত আমাকে নানাভাবে উত্যক্ত করে আসছে। তারা সফল না হওয়ায় স্থানীয় জাগিরকে জড়িয়ে আমার সাথে পরকীয়া প্রেমের মুখরোচক গল্প বানায় এবং সেদিন ওই নাটকটি মঞ্চস্থ করে। মূলত জাগিরও ওই দূর্বৃত্তদলের একজন সদস্য। আবার তারা সকলে মেম্বারের পোষা দলের সদস্য হওয়ায় মেম্বার তাদের সাথে তাল মিলিয়ে এ নির্যাতনে প্ররোচিত করে। তার উপস্থিতিতে তাকে রাতভর নির্যাতন করলেও সে তা বন্ধ করেনি।উল্টো সেও তার কাপড় টানতে থাকে।

ভিকটিম কান্না জড়িত কন্ঠে আরো বলেন, ওই দিন থেকে সে হুমকিতে নিরাপত্তাহীনতায় এবং এক মাস যাবত ঘর ছাড়া ছিল।এক সপ্তাহ পূর্বে প্রাণের মায়া ছেড়ে স্বামীর ঘরে ফিরলেও রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। মেম্বার ও তার দলের সদস্যদের অব্যাহত হুমকি, শুধু তাকে এবং তার স্বামীকে দিচ্ছে না।তার শ্বশুর পক্ষের লোকজনকেও দেয়ায় তারাও আতঙ্কে এ ঘটনার বিচার না চাওয়ার জন্য তাকে বারবার অনুরোধ করছে। আইনিভাবে তাকে সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসলে, তিনি বর্বরোচিত ঘটনার বিচার চাইবেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

ঘটনার বিষয়ে চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওয়াজ করিম বাবুল বলেন, তিনি ওই ঘটনা জানেন না। কেউ তাকে অভিযোগও দেয়নি ।

অভিযুক্ত মেম্বার মোহাম্মদ মিয়া জঙ্গীর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি ঘটনার সাথে জড়িত নন দাবি করে বলেন, নির্যাতন থেকে ওই মহিলাকে বাঁচাতে সেদিন এগিয়ে আসি। দেরিতে হলেও এই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয়ে পড়ায় ইতোমধ্যে পুরো এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কক্সবাজার মডেল থানার ওসি (তদন্ত) বিপুল চন্দ্র দে বলেন, এখনো এরকম কোন অভিযোগ পাননি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন।

স্থানীয়দের দাবি, যত বড় অপরাধই করুক না কেন, এভাবে মায়ের জাত একজন নারীকে এই শীতের রাতে ঘরে থেকে স্বামী ও সন্তানদের সামনে নির্যাতন করে বাইরে এনে রাস্তার গাছের সাথে বেঁধে মধ্যযুগীয় কায়দায় রাতভর অজস্র মানুষের সামনে প্রকাশ্যে এমন নারী নির্যাতনের সাথে জড়িতরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, এদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

Exit mobile version