parbattanews

গুইমারাতে প্রশাসনের আশ্বাস সত্ত্বেও পরিকল্পিতভাবে পরিস্থিতি অবনতি ঘটানো হচ্ছে

স্টাফ রিপোর্টার, খাগড়াছড়ি:
খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার দূর্গম কুকিছড়া এলাকায় পরিত্যাক্ত সেনাক্যাম্পের পরিত্যাক্ত জায়গায় নব নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির ও মুর্তি ভাংচুরের ঘটনার একদিন পর বুধবার দুপুরে উপজেলার চান্দামুনি বৌদ্ধবিহারে এলাকাবাসী ও ভিক্ষু সংঘদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভা করেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জন প্রতিনিধিরা।

মতবিনিময় সভায় গুইমারা সেনা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এ কে এম সাজেদুল ইসলাম, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মো. শাহেদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আহমার উজ্জামান, মাটিরাঙ্গা সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্ণেল নওরোজ, সিন্দুকছড়ি সেনা জোনের অধিনায়ক লে. কর্নেল রুবায়েত মাহামুদ হাসিব, জেলা পরিষদ সদস্য মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পংকজ বড়ুয়া, উপজেলা চেয়ারম্যান উশেপ্রু মার্মা, খাগড়াছড়ি বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি বাসন্তী চাকমা, গুইমার সদর ইউপি চেয়ারম্যান মেমং মারমা, হাফছড়ি ইউপি চেয়ারম্যান চাইথোয়াই চৌধুরীসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।


এ বিষয়ে আরো পড়ুন:


মতবিনিময় সভার আগে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘদের সাথে গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এ কে এম সাজেদুল ইসলাম, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মো. শাহেদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. আহমার উজ্জামান সিনিয়র কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে কুশল বিনিময় করে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘদের অন্ন ও বস্ত্রদান করে তাদের নিকট থেকে আর্শিবাদ কামনা করেন তিনি ।

এ সময় তারা এলাকাবাসী ও ভিক্ষুসংঘদের কথা শোনেন। তাদের দাবী অনুযায়ী আগামী দুই এক মাসের মধ্যে উক্ত স্থানে নতুন করে বিহার নির্মাণ ও বুদ্ধ মুর্তি স্থাপনের আশ্বাস প্রদান করেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা।

এসময় বুদ্ধ ধর্ম গুরুদের মধ্যে দেয়ানপাড়া মিশন বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ সংজ্ঞ রত্ন মহাথের, জ্যোতিসারা ভান্তে, কুকিছড়া পালিতুল সুরক্ষিত বৌদ্ধ বিহারের প্রধান আগাচারা ভিক্ষু, নাক্রাইপাড়া বৌদ্ধা বিহারের প্রধান ক্ষেমাছাড়া ভিক্ষু প্রমূখ উপস্থিত থেকে জেতবন বৌদ্ধ বিহারের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তব্যকালে ধর্মগুরুরা বলেন, মন্দিরটি যদিও নিজস্ব জমিতে স্থাপিত না হয়ে সরকারী খাস জমিতে স্থাপন হয়েছে। তথাপিও উক্ত জমিটি জেতবন বৌদ্ধ বিহারের নামে বন্দোবস্তি দিয়ে নতুন করে মন্দির ও মূর্তিটি স্থাপনের জন্য অনুরোধ জানানো হয় ।

মত বিনিময় সভায় গুইমারা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম সাজেদুল ইসলাম বলেন, সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে বিহার সহ অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির নির্মাণ করেছে, সংস্কার করেছে, উন্নয়নে সহায়তা দিয়েছে, কাজেই সেই সেনাবাহিনী কোনো মন্দির ধংস করতে পারে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অশুভ শক্তির নাম ইউপিডিএফ। তারা উন্নয়নের বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে, সম্প্রীতির বিরুদ্ধে। নানা রকম অপচেষ্টার মাধ্যমে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও শান্তি বিনষ্ট করতে চায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিক্ষুদের দাবী মেনে স্থানীয় প্রশাসন জেতবন বৌদ্ধ বিহার সংলগ্ন ৫ একর জায়গা বিহারের নামে স্থায়ী বন্দোবস্তি দিয়ে নতুন করে বিহার নির্মাণ করে দেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে গতকাল যেসকল সাধারণ উপজাতীয় গণমাধ্যমের সাথে কথা বলে সত্য তথ্য তুলে ধরেছে তাদেরকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মীদের পক্ষ থেকে হুমকি দেয়া হয়েছে। তাদেরকে জোর করে সমাবেশের সামনে রাখা হচ্ছে, নজরে রাখা হচ্ছে।

ফলে আজ অনেকেই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতে রাজী হননি। তবে মোবাইলে তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পার্বত্যনিউজকে বলেন, অপশক্তিরা বিহার ও মুর্তি ভেঙে খারাপ কাজ করেছে। প্রবারণা পূর্ণিমার এই ক্ষণে বিষয়টি আমাদের মনে আঘাত দিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন নতুন করে বৌদ্ধ মূর্তি গড়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়ায় আমরা খুশী। কিন্তু পাহাড়ের একটি অপশক্তি এটা মানতে পারছে না। ১ টার বদলে ৫টি মন্দির গড়েও তাদের সন্তুষ্ট করা যাবে না। কারণ তাদের লক্ষ্য ভিন্ন।

তারা আসলে মন্দির ভাঙা ইস্যুটিকে পূঁজি করে তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করতে চায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দল গোছানো, নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা, জনগণের সমর্থন আদায় করতে এই ইস্যুটি তারা কাজে লাগাতে চায়। একই সাথে শক্তিমান ও তপন জ্যোতি হত্যা মামলার আসামী হওয়ায় গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে থাকা তাদের কর্মীদের আবার মাঠে নামাতে চাইছে। এরসাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেকে জড়িত রয়েছে। ফলে সামনে পরিস্থিতি আরো অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে তার অভিমত।

সাধারণ পাহাড়ীদের অনেকের কাছেই বিষয়টি পরিস্কার হলেও তাদের কিছুই করার নেই বলে জানায় এ সূত্রটি।

এদিকে চান্দেমুনি বৌদ্ধবিহার এলাকায় আলোচনা সভা চলাকালে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের ব্যানারে রামসু বাজার এলাকা থেকে এসে গুইমারা বাজারে বিক্ষোভ মিছিল করে শত শত নারী ও পুরুষ।

বিক্ষোভ মিছিলের খবরটি আলোচনা সভা স্থলে জানাজানি হলে তাৎক্ষণিক উপস্থিত জ্যোতিস্বারা ভিক্ষু এসব আঞ্চলিক রাজনীতির বিরোধিতা করে বলেন, ঘটনা যেভাবেই হোক না কেনো আমরা সমাধানের জন্য জেলার সর্বোচ্চ প্রশাসনসহ আলোচনায় বসেছি। যারা এসব করছে তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ।

পরে চান্দামুনি বৌদ্ধ বিহার থেকে এসে ভিক্ষুসংঘ, প্রশাসনের লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তারা জ্যোতিস্বারা ভান্তের মাধ্যমে পাচঁটি দাবি তুলে ধরেন। অবশেষে জেলা প্রশাসকের অনুরোধে বিক্ষোভকারীরা সড়ক ছেড়ে বাড়ি ফিরে যান ।

তবে এ ঘটনা নিয়ে উপজেলার সাধারন লোকজনের মাঝে ভয়ভীতি ও আতঙ্ক কাজ করছে । নিরাপত্তাবাহিনী সূত্র জানিয়েছে, উপজেলার গুরুত্বর্পূর্ণ স্থানগুলোতে যৌথবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, কোন রকম অপ্রীতিকর ঘটনা সৃষ্টিকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফের নেতৃত্বে মোটর সাইকেল যোগে লোকজন এনে গুইমারা রামসুবাজার, নতুনপাড়া এলাকায় সংঘবদ্ধ করে রাখা হয় এবং দূর থেকে আসা লোকজনদের যাতায়াত ভাড়া ও প্রদান করা হয়।

গতকাল রাত থেকে পরিকল্পনা অনুযায়ী গুইমারা উপজেলার সকল পাড়ার বাইরে ও মহালছড়ি ,মাটিরাংগা মানিকছড়ি ,লক্ষীছড়ি ,খাগড়াছড়ি সদর এলাকা থেকেও লোকজন এনে জড়ো করা হয় বলে জানা যায়।গুইমারার পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে পরিকল্পিতভাবে বাইরে থেকে লোক এনে উত্তেজনা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, গুইমারা উপজেলার হাফছড়ি ইউনিয়নে গত সোমবার দিবাগত রাতে বৌদ্ধ মন্দির ও মুর্তি ভাংচুর করেছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার পর এলাকা জুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে, শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপত্তাবাহিনীকে নিয়ে অপপ্রচার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় যৌথ বাহিনীর বিশেষ টহল জোরদার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. শাহেদুল ইসলাম বলেন ,দেশে হিন্দু ,মুসলিম ,বৌদ্ধ সবাই বসবাস করবে এদেশটি সকলের। এরই নাম বাংলাদেশ। যে ঘটনা হয়েছে তা অনাকাঙ্ক্ষিত উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সুস্থ সমাধানের জন্য সকলের সহযোগিতা ও সময় প্রয়োজন । স্থায়ী সমাধান ও দাবী পূরণের জন্য জনপ্রতিনিধি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বসে মতামত প্রেরণের জন্য অনুরোধ জানান এবং সবশেষে তিনি বিক্ষোভকারী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস প্রদান করেন।

Exit mobile version