গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ যেন ঘুমধুম সীমান্তবাসীর নিত্যদিনের সঙ্গী
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু মিয়ানমার সীমান্তে শূন্যরেখায় ৪ হাজার রোহিঙ্গার বসবাস। পাশাপাশি ঘুমধুম ইউনিয়নের বসবাসকারী রয়েছে ৩০ হাজার জনসাধারণ।
কথায় আছে, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।’ তবে আমাদের এখানে শুধু সন্ধ্যা বা রাতে নয়, সকাল-দুপুর-বিকাল, সব সময়ই ওপার (মিয়ানমার) থেকে আসা গোলাগুলির শব্দ কানে বাজে। যে কারণে ভয় এখন অভয় হয়ে দাঁড়িয়েছে!’ বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রুর বাইশফাঁড়ির বাসিন্দা নুরুল হক এপারের সীমান্ত এলাকার চিত্র বর্ণনায় এ কথা জানিয়েছেন।
কেমন আছেন জানতে চাইলে মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা তুমব্রুর বাইশফাঁড়ি পাড়ার বাসিন্দা নূরুল হক বলেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের দুই পক্ষের গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে কান সয়ে গেছে যেন! বরং গুলির শব্দ না শুনলেই অবাক লাগে।
ঘুমধুমের রেজু গর্জন বুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছৈয়দ হামজা গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তিনি জানান, পাহাড়ের পেছনে মিয়ানমারে প্রতি দিনই গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। তাই এখন আর ভয় কাজ করে না। কারণ, এখানে গোলাগুলি এখন নিত্যদিনের ঘটনায় রূপ নিয়েছে।
সীমান্তের পাশে বসবাস ওকসাইন চাকমা বলেন, ‘সীমান্তে যাওয়া-আসার সুযোগে প্রায়ই কাঁটা তারের বেড়া থেকে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সেনাবাহিনীর পোশাকে লোকজনকে হাঁটতে দেখা যায়। কিন্তু আসলে তাঁরা কারা, সেটা বুঝা যায় না। আমরা শুনেছি, সেখানে আরকান আর্মি (এএ)-এর সঙ্গে সেদেশের সেনাবাহিনীর যুদ্ধ চলছে। প্রকৃত পক্ষে তাও বিশ্বাস করা মুশকিল।’
প্রায় মাসখানেক যাবত বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু পয়েন্টের বাংলাদেশ-মিয়ানামার সীমান্তে উত্তেজনা চলছে। এ অবস্থায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নো-ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা।
সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী স্থানীয় লোকজনের মাঝেও এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে। যদিও সতর্ক অবস্থানে থাকার কথা স্বীকার করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি।
সরেজমিনে লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, সীমান্তবর্তী তুমব্রু ইউনিয়নের ৮ হাজারের বেশি মানুষ মিয়ানমারে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় প্রতিনিয়ত। এর মধ্য ছয় হাজারের বেশি মানুষ গোলাগুলির শব্দে কেঁপে উঠেন।
মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সবচেয়ে বেশি শব্দ ঘুমুধুম ইউনায়নে শুনতে পান হেডম্যান পাড়া, রেজু গর্জন বুনিয়া, বাইশ ফাঁড়ী ও শূন্যরেখার বসবাসরত রোহিঙ্গারা। হেডম্যান পাড়ায় ২৫-৩১টি চাকমা পরিবার রয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই জুম, ধান ও রাবার বাগানে চাষাবাদ করে জীবন চলে।
হেডম্যান পাড়ার অন্যথাইন বলেন, ‘দেখেন এখনও গুলির শব্দ পাচ্ছি। এভাবে প্রতিদিন চলছেই। আসলে সেখানে কী হচ্ছে- সেটা বলা যাচ্ছে না। আমরা শুধু গুলির শব্দ পাই। মাঝেমধ্যে আকাশপথে হেলিকপ্টার ও যুদ্ধ বিমান দেখতে পাই। আর সীমান্তে কাঁটাতাঁরের বেড়ার ফাঁকে দেখা মেলে সেনাবাহিনীর পোশাকে কাঁধে অস্ত্র নিয়ে দলে দলে হাঁটছেন তারা।’
অন্যথাইন আরও বলেন, ‘গোলাগুলির কারণে ইতোমধ্যে আমাদের প্রায় ৬০০ মানুষের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি ভয়ে অনেক পরিবার তাদের বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদে কাছাকাছি স্বজনদের বাড়িতে রেখে এসেছেন।’
স্থানীয় ইউপির ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য মোহাম্মদ আলম জানান, সীমান্তের ওপাড়ে প্রতিদিনই গোলাগুলি হচ্ছে। এখন পাহাড়ে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। তার এলাকার বেশিরভাগই মানুষ চাষাবাদ করে সংসার চালায়। কিন্তু সীমান্তে গোলাগুলির কারণে অনেকে বেকার হয়ে আছেন। ভয়ে সেখানে তারা যাচ্ছে না। আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকেরাও চলাচলে সতর্ক করেছে।
জানা যায়, গত পাঁচ বছর ধরে ওই সীমান্তের শূন্যরেখা কোনাপাড়ায় বসবাস করে আসছেন চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সম্প্রতি মর্টার শেল-গোলা ছোড়ার পাশাপাশি সীমান্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের ঘটনায় নো ম্যানস-ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের ওপরও চলাচলে সতর্ক করেছে সেখানকার দায়িত্বে থাকা বিজিবি।
নো ম্যানস-ল্যান্ডে দায়িত্বে থাকা বিজিবির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সীমান্তের অবস্থা খুব খারাপ। এখানে লোকজনের চলাচলে সতর্ক করা হয়েছে। জরুরি কাজ না থাকলে এখানকার লোকজনকে ঘোরাফেরা না করতে বলা হয়েছে।
নো ম্যানস-ল্যান্ডে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা দিল মোহাম্মদ জানান, সোমবারও (১২ সেপ্টেম্বর) বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গুলির শব্দ পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে কিছু সময় গোলাগুলি বন্ধ থাকলেও সোমবার রা ৯টার পর থেকে ফের গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। আসলে এ ‘গুলি খেলার’ শেষ কবে হবে, তার কোনও হিসেব নেই।
দিল মোহাম্মদ বলন, আমাদের শিবিরের শিশু ও নারীরা ভয়ে থাকে। আর আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ‘সীমান্তে প্রায় একমাস ধরে চলছেই গোলাগুলি। কোনও পরিবর্তন আসেনি। মিয়ানমার আইন লঙ্ঘন করে চলছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় আমার এলাকার মানুষের অনেক সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে চাষিরা কষ্টে আছেন। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে।’
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের জানান, আমরা রাষ্ট্রীয় এবং সব পর্যায়ে এ গোলাগুলির প্রতিবাদ করছি। আমরা মনে করি, এই ধরনের গোলা যেন না আসে সে ব্যাপারে মিয়ানমার সংযত হবে। কোনও গোলা যেন আর আমাদের সীমান্ত এলাকায় এসে না পড়ে সেজন্য খেয়াল রাখার জন্য তাদের বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, সীমান্তে বেশ কয়েকটি ঘটনার কারণে আমরা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ বিষয়টি অবহিত করেছি। প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। এরকম ঘটনা যেন পরবর্তীতে না ঘটে সেজন্য খেয়াল রাখার কথা বলা হয়েছে।