গোয়ালন্দের ঘটনার দায় কার?


রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে মূলত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। একটি ঘটনা নুরা পাগলা একজন ভণ্ড প্রতারক যিনি নিজেকে ইমাম মাহাদী দাবি করতেন এবং তার বিরুদ্ধে একসময় অপকর্ম নাই যা করার অভিযোগ ছিল না। তার এইসব অপকর্মের বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালের দিকে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তিনি মুচলেকা দিয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে ২৩ আগস্ট রাজধানীতে একটি হাসপাতালে তিনি মারা গেলে তার পরিবার ও মুরিদগণ তাকে গোয়ালন্দে নিয়ে তার আখড়ায় সমাহিত করে।
তার কবরটিকে কাবা শরীফের মত উঁচু করে এবং কাবা শরীফের মতো রং করে নির্মাণ করে এবং তার ভক্তরা সেখানে তাওয়াফ ও সিজদাহ করতে শুরু করে। সেই কাবা সদৃশ কবরকে সেজদাহ করতো তার ভক্ত ও অনুরাগীরা। বাইরে ইমাম মাহাদী আলাইহিস সালামের মাজার লিখে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়। বেঁচে থাকতে তিনি কুরআনকে মনগড়া বলতেন, নিজের নামে কালেমা চালু করেছিলেন, নিজের নামে দরুদ শরীফ পড়াতেন। নিজেকে কখনো নবী বা ঈসা আলাইহিস সালাম দাবি করতেন। আবার কখনো ইমাম মাহদী দাবি করতেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকার ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাদের সাথে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরাও প্রতিবাদ করতে শুরু করে। এ নিয়ে তারা স্থানীয় প্রশাসন ও গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সমাধান করার দাবি জানায়। কিন্তু প্রশাসন কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় এবং ওই মাজারে ইসলামের নামে বিভ্রান্ত আকিদা প্রচার করায় জনগণ ক্রমশ ক্ষুব্ধ হতে শুরু করে। তারা একের পর এক প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করে। এরপর স্থানীয় জনগণ সাংবাদিক সম্মেলন করেও সরকার ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিন্তু প্রশাসন তাদের কর্ণবাদ না করায় তারা আল্টিমেটাম দেয়। তাতেও প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
তৃতীয় ঘটনা হচ্ছে, এরই একপর্যায়ে শুক্রবার মুসল্লীরা হামলা করে উক্ত মাজার ভেঙে ফেলে এবং তার লাশ তুলে পুড়িয়ে দেয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে একজন মারা যায়। কিন্তু গণমাধ্যমে পুরো ঘটনার একটি অংশ আংশিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে রিপোর্টিং করা হয়েছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আমি পুরো ঘটনার তিনটি অংশেরই তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং বিরোধিতা করছি। একই সাথে দোষীদের শাস্তি দাবি করছি। কিন্তু এই ঘটনার জন্য অনুঘটক হিসেবে আমি স্থানীয় প্রশাসনকে দায়ী করছি। কেননা ইসলামের নামে উক্ত অনাচার যখন সেখানে চলছিল স্থানীয় জনগণ শুরুতে প্রশাসনকে জানিয়েছিল। বারবার জানিয়েছিল। প্রশাসন যদি উদ্যোগ নিয়ে এই বিভ্রান্ত কর্মকাণ্ড উচ্ছেদ করত তাহলে এই সমস্যা হতো না। এ কারণে আমি ঘটনার পেছনে প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করি।
বাংলাদেশের মিডিয়াতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেষের ঘটনাটি আলোচিত হয়েছে। ঘটনার একপেশে নিউজ হয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও একপেশে সমালোচনা হচ্ছে। গতকাল রাত থেকে দেখলাম অনেক সুশীল সমাজ, জনপ্রিয় ফেসবুকার, প্রগতিশীল ধর্মীয় চিন্তক এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিজেদের উদার চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করতে তৎপর হয়েছে। তাদের দাবি একটি স্বাধীন দেশে যে কেউ যেকোনো মত প্রচার করতে পারে। এখানে সবার ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। সবাই নিজ নিজ ধর্ম ও মত স্বাধীনভাবে পালন ও প্রচার করতে পারে। কেউবা আবার আরেক পা বাড়িয়ে বলছেন, এটা তো কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয় যে, রাষ্ট্র কারো ধর্ম বিশ্বাসে ও ধর্মীয় রীতিতে আঘাত করবে?
ধরুন এখনো যদি কোথাও কেউ নিজেকে ইমাম মাহাদী দাবি করা শুরু করে তাহলে মুসলমানদের কর্তব্য কি? এখন যদি কোথাও কেউ কাবা শরীফের আদলে কারো কবর নির্মাণ করে তা তাওয়াফ ও সিজদা করা শুরু করে তাহলে মুসলমানদের কর্তব্য কি? অবশ্যই স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে দেশবাসীকে সচেতন করে চাপ সৃষ্টি করা। গোয়ালন্দের ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি এই কাজটি অত্যন্ত জোরালো ভাবে করেছে। কিন্তু তারপরও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তারা আল্টিমেটাম দিয়েছে। তবুও প্রশাসন নীরব থেকে দিনের পর দিন ইসলামের নামে এই অনাচার চলতে দিয়েছে। আমি শেষ ঘটনাকে সমর্থন না করেও বলছি, মূলত প্রশাসনিক জনগণকে এই রাস্তায় ঠেলে দিয়েছে, এই রাস্তা বেছে নিতে বাধ্য করেছে।
শেষোক্তদের আমার কাছে আমার প্রশ্ন, কোনো মুসলিম যদি নামাজ পড়ে ও দেব দেবীর পূজা করে এবং তিনি যদি একই সাথে নামাজ ও দেব দেবীর পূজাকে ইসলাম বলে প্রচার করে অনুসারীদের আহ্বান করেন বা পালন করতে বলেন তার ব্যাপারে রাষ্ট্রের বিধান কী হবে? আপনি হয়তো বলবেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এটা চলতে পারে। আপনার কাছে প্রশ্ন, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে কোনো হিন্দু যদি হিন্দুদের গরু জবাই কে বৈধ বলে, মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী বলে গ্রহণ করাকেও হিন্দু ধর্ম মত বলে প্রচার করে এবং তার অনুসারীদের এটা পালন করতে উৎসাহিত করে, তাহলে ভারতের প্রতিক্রিয়া কী হবে?
মুক্ত স্বাধীনতার দেশ ফ্রান্সে মাঝে মাঝেই কুরআন পোড়াতে দেখি। কিন্তু সেখানে কখনো বাইবেল বা তাওরাত পুড়াতে দেখিনি। কেউ যদি ঘোষণা দিয়ে সেখানে উক্ত দুটি কেতাব পড়াতে চায় তাহলে তার পরিণতি কী হবে? কিংবা কোনো ক্রিশ্চিয়ান যদি তার অনুসারীদের মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ নবী হিসেবে মেনে নেয়ার আহ্বান জানান ক্রিস্টিয়ান হিসেবে বহাল থেকেই, তাহলে কী করা হবে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর আরবের বিভিন্ন প্রান্তে বেশ কিছু মানুষ নবী দাবি করেছিল নিজেদের। তাদের ব্যাপারে মুসলিম খলিফাগণ কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? এদের অনেকের লাশই কিন্তু পুড়িয়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এদেশে খেলাফত ব্যবস্থা বা শরিয়া আইন চালু নেই। সে কারণে এভাবে কোনো লাশ পোড়ানো সমর্থনযোগ্য নয় এবং আইনগতভাবে ভয়ানক অপরাধ। সম্রাট আব্রাহা মক্কার কাবা ধ্বংস করে নিজের জন্য নিজের নামে একটি কাবা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ আবাবিল পাঠিয়ে আব্রাহাকে ধংস করে দিয়েছেন। পৃথিবীতে কাবা একটাই থাকবে – এ ঘটনার মাধ্যমে মহান আল্লাহ আমাদের এ শিক্ষাই দিয়েছেন।
যেকোনো ব্যক্তি তার নিজের ধর্ম পালন করতে পারে। এই স্বাধীনতা তার আছে। কিন্তু এই স্বাধীনতা যদি অন্যের স্বাধীনতাকে আঘাত করে অর্থাৎ কারো ধর্ম প্রচারণা যদি অন্য কোনো ধর্মের উপর আঘাত হানে সেটা রাষ্ট্র চলতে দিতে পারে না। কেননা এতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকে। মুসলমানরা সবসময় প্রচার করে মূর্তিপূজা হারাম। কিন্তু এদেশের বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মূর্তি পূজা করে থাকে। মুসলমানরা এর বিরোধিতা করে না। কিন্তু কোন মুসলিম যদি মসজিদ বানিয়ে তার মধ্যে মূর্তি স্থাপন করে এবং সেটাকে মুসলমানদের মসজিদ বলে প্রচার করে, এটা অবশ্যই চলতে পারে না এবং চলতে দেয়া যায় না।
চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যখন কিছু মানুষ মসজিদ বানাতে চাইলো আমি এর তীব্র প্রতিবাদ করেছিলাম। পরবর্তীকালে রাষ্ট্র এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। এজন্য রাষ্ট্র ধন্যবাদ পাবার যোগ্য। কিন্তু চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ বানানো যদি অন্যায় হয়, গোয়ালন্দে ভন্ড ইমাম মাহদীর মাজারে কাবা বানিয়ে ইসলামের নামে তাওয়াফ করা কেন অন্যায় হবে না? চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ বানানোর ব্যাপারে রাষ্ট্র কঠোর হতে পারলে গোয়ালন্দে ভন্ড ইমাম মাহদীর মাজারে কাবা বানিয়ে তাওয়াফ করার ব্যাপারে রাষ্ট্র নীরব থাকলো কেন? চন্দ্রনাথ পাহাড়ের মসজিদ বানানোর প্রস্তাবকে যারা অন্যায় বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল তাদের অনেকেই দেখি এখানে উল্টে গেছে? আসলে ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলে সুশীল ও প্রগতিশীল হওয়ার লোভ দমন করা অনেকের জন্যই কঠিন! আমরা একটা অদ্ভুত সমাজে বসবাস করছি যেখানে ইমাম মাহদী দাবী করার ভন্ডামি কোন দোষ নয়! মিথ্যা কাবা প্রতিষ্ঠা করা দোষ নয়! মিথ্যা কাবা তাওয়াফ করে মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা দোষণীয় নয়! কিন্তু এগুলোকে ধ্বংস করাটাই কেবলমাত্র দোষ!! আমার বিচারে তিনটাই দোষ! তিনটা নিয়েই কথা বলা উচিত।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের ক্ষেত্রে করণীয় কী? উত্তরে বলা যায়, কেউ যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মীয় অবমাননাকর পোস্ট দেয় তখন তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কী কোনো ব্যবস্থা নেয়, নাকি চুপ থাকে? নাকি বলে, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। অতএব যার যেমন খুশি, যে যেমন খুশি ধর্ম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতে পারো, এখানে রাষ্ট্রের কিছু করার নেই। বাংলাদেশে যে সাইবার নিরাপত্তা আইন রয়েছে সেখানে এ ব্যাপারে কী বলা হয়েছে? রাষ্ট্র এতদিন এ ধরনের ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় অন্যের ধর্ম আঘাত করে পোস্ট দেয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র কি সাইবার নিরাপত্তা আইনে ব্যবস্থা নেয়নি? তাদের বিরুদ্ধে কি মামলা হয়নি? তাদেরকে কি আটক করা হয়নি? অসংখ্য হয়েছে।
তাহলে সাইবার দুনিয়ায় কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে লিখলে কোনো ধর্মকে অবমাননা করলে যদি রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তাহলে বাস্তব দুনিয়ায় কেউ যদি কোন ধর্মের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে অন্যের ধর্মকে আঘাত করে তাহলে রাষ্ট্র তার বিরুদ্ধে চুপ থাকবে কেন? সাইবার দুনিয়ায় যেটা অবৈধ বাস্তব দুনিয়ায় সেটা বৈধ হবে কেনো? কেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর পরেও এই সমস্যা নিরসনে প্রশাসন ব্যবস্থা নিল না? যদি তারা ব্যবস্থা নিতো তাহলে আজকের এই ঘটনা অবশ্যই ঘটত না। তাহলে এই ঘটনার জন্য প্রকৃত দায়ী কে? নাকি রাষ্ট্রই নীরব থেকে মব সৃষ্টিতে উৎসাহিত করছে?
লেখক : সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

















