গাজায় যাওয়ার পথে

গ্রেটা থুনবার্গের ত্রাণের জাহাজ ঘুরিয়ে দিয়েছে ইসরায়েল

fec-image

ফিলিস্তিনি অঞ্চলে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর চেষ্টা করার সময় রোববার “মেডলিন” নামের ত্রাণবাহী জাহাজটিকে ইসরায়েলি বাহিনী আটকে দিয়েছে বলে দাবি করেছে ওই জাহাজে থাকা ব্যক্তিরা।

জাহাজটি মিশরের উপকূলের কাছাকাছি ছিল বলে জানা গিয়েছে।

গাজার প্রথম ও একমাত্র নারী মৎস্যজীবী মেডলিনের নামে এই ইয়টের নামকরণ করা হয়েছে। ইয়টটি গত পহেলা জুন ইতালি থেকে যাত্রা করে।

পরে ৬ই জুন ইতালির সিসিলি উপকূল থেকে গাজার উদ্দেশে রওনা হয়। কিন্তু ইসরায়েলি বাহিনী সেটিকে থামিয়ে দেয়।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানায়, জাহাজটি এখন “নিরাপদে ইসরায়েলের উপকূলের দিকে যাচ্ছে।”

জাহাজে ১২ জনের একটি দল ছিল, যার মধ্যে ছিলেন সুইডিশ জলবায়ু অ্যাকটিভিস্ট গ্রেটা থুনবার্গ, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি সদস্য রিমা হাসান, এবং আল জাজিরার ফরাসি সাংবাদিক ওমর ফায়াদ।

বাকি সদস্যরা হলেন: ইয়াসেমিন আকার, ব্যাপ্টিস্ট আন্দ্রে, থিয়াগো আভিলা, পাস্কাল মরিয়েরাস, ইয়ানিস মুহাম্মদি, সুয়াইব ওর্দু, সেরজিও তোরিবিও, মার্ক ভ্যান রেনেস এবং রেভা ভিয়ার্ড।

এই ইয়টে যারা আছেন, তাদের মধ্যে সুইডেন, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং তুরস্কের নাগরিকরা আছেন।

“মেডলিন”এ থাকা ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি-ফিলিস্তিনি সদস্য রিমা হাসানের দল এক্স অ্যাকাউন্টে জানায়, ইসরায়েলি সেনারা “স্থানীয় সময় রাত ২টায় আন্তর্জাতিক জলসীমায় জাহাজের সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে।”

সুইডিশ জলবায়ু কর্মী গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, “ইসরায়েল সমর্থক বাহিনী তাদেরকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় থামিয়ে অপহরণ করেছে।”

“আমি আমার বন্ধু, পরিবার এবং সহযোদ্ধাদের অনুরোধ করছি সুইডিশ সরকারকে চাপ দিন যেন তারা আমাকে এবং অন্যদের দ্রুত মুক্ত করে,” তিনি এক ভিডিও বার্তায় বলেন।

অন্যদিকে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের এক্স অ্যাকাউন্টে জানায়, সবাই “অক্ষত” আছে এবং তারা “নিরাপদে ইসরায়েলের উপকূলের দিকে যাচ্ছে।” এবং “পরে তারা তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবে”।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজের মতে, ইয়টটি বর্তমানে ইসরায়েলের আশদোদ বন্দরের দিকে যাচ্ছে।

এটি ইসরায়েলের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত একটি শহর, যা গাজা উপত্যকার উত্তর দিকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মেডলিনকে “সেলফি ইয়ট” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছে এটি “সেলিব্রিটিদের”ইয়ট।

ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রিডম ফ্লোটিয়ার কর্মীরা, যার মধ্যে গ্রেটা থুনবার্গও আছেন, তারা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরে আছেন এবং তাদের খাবার ও পানি দেয়া হচ্ছে।

তারা এই দলটির সমালোচনা করে বলেছে, “তারা কেবল প্রচারের উদ্দেশ্যে একটি মিডিয়া নাটক সাজাতে চেয়েছে – যেখানে এক ট্রাকেরও কম সহায়তা ছিল।”

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “গাজা উপত্যকায় সহায়তা পাঠানোর উপায় আছে – সেগুলোর মধ্যে ইনস্টাগ্রাম সেলফি নেই।”

এ বিষয়ে ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন বলেছে, জাহাজটি প্রতীকী পরিমাণে সহায়তা বহন করছে, যার মধ্যে আছে চাল ও শিশুদের দুধের পাউডার।

আগের এক সাক্ষাৎকারে, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ফরাসি-ফিলিস্তিনি সদস্য রিমা হাসানের এএফপি-কে বলেছেন: “আমরা অস্ত্রধারী না।আমাদের এখানে কেবল মানবিক সহায়তা আছে।”

এদিকে পশ্চিম তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাহাজে থাকা কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এক্স অ্যাকাউন্টের এক পোস্টে তারা জানিয়েছে, “গাজা উপত্যকার ওপর আরোপিত অবরোধ ভাঙতে যে আন্তর্জাতিক কর্মীরা চেষ্টা করছেন সংহতি জানিয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। তাদের এই প্রচেষ্টাকে “মর্যাদাপূর্ণ” বলে আখ্যা দেয়া হয়।

ফ্রিডম ফ্লোটিয়া কোয়ালিশন, যারা গাজার উদ্দেশ্যে মেডলিন নামের ইয়টটির যাত্রার আয়োজন করেছে, তাদের পোস্ট করা ভিডিওতে জার্মান অ্যাকটিভিস্ট ইয়াসমিন আকার বলেন,

“স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর ‘রাসায়নিক পদার্থ’ ফেলা হয়েছে”, এবং ‌এতে তার চোখ জ্বালাপোড়া করছে।

ভিডিওটি শেষ হবার আগেই শোনা যায়, তিনি বলছেন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী “নৌকাটি থামিয়ে দিয়েছে”।

এছাড়া আরেকটি রেকর্ড করা বার্তায়, তিনি বলেন, তিনি এবং তার দল “গাজায় যাওয়ার পথে সমুদ্রে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী অথবা তাদের সহযোগী, যারা ফিলিস্তিনি গণহত্যায় জড়িত, তারা তাদেরকে অপহরণ করেছে”।

গত কয়েক ঘণ্টায়, ফ্রিডম ফ্লোটিয়া কোয়ালিশন টেলিগ্রাম চ্যানেলে মেডলিনে থাকা কর্মীদের আগে থেকে রেকর্ড করা ভিডিও বার্তাগুলো পোস্ট করছে।

ইসরায়েল আগেই সতর্ক করে বলেছিল, মেডলিন গাজায় পৌঁছাতে চাইলে সেনাবাহিনী “প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে”।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, ইসরায়েল গাজার চারপাশে থাকা সমুদ্র অবরোধ ভাঙার যেকোনো প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশনও বলেছে,”মেডলিন ইসরায়েলের যেকোন সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য প্রস্তুত।”

ইসরায়েলের এই সমুদ্র অবরোধ ২০০৭ সাল থেকে চলছে। কাটজের দাবি, “হামাসের কাছে অস্ত্র পৌঁছানো বন্ধের জন্য” এবং “নিরাপত্তার জন্য এই অবরোধ অপরিহার্য,” কারণ ইসরায়েল ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে ধ্বংস করতে চায়।

অন্যদিকে হামাস বলেছে, মেডলিন-কে থামানো আন্তর্জাতিক আইনের “স্পষ্ট লঙ্ঘন”।

এক বিবৃতিতে, ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীটি দাবি করেছে, নৌকায় থাকা কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে, এবং তারা ইসরায়েলকে তাদের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে বলে।

এরপর বিবৃতিতে তারা জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা এই ঘটনার নিন্দা জানায় এবং গাজাবাসীর ওপর থেকে অবরোধ তুলে নিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় ।

জাতিসংঘের অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ প্রতিনিধি ফ্রানচেস্কা আলবানিজ গাজা উপকূলে ইসরায়েলের সামুদ্রিক অবরোধ চ্যালেঞ্জ করতে আরো জলযানকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি তার এক্স অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “ম্যাডলিনকে অবশ্যই অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। প্রতিটি ভূমধ্যসাগরীয় বন্দরের উচিত গাজায় সহায়তা, সংহতি এবং মানবতা নিয়ে নৌকা পাঠানো। তারা একসাথে যাত্রা করবে – একতাবদ্ধ হলে তাদের থামানো যাবে না।”

তিনি যুক্তরাজ্য সরকারকেও আহ্বান জানান “দ্রুত সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা চাইতে” এবং “নৌকা ও ক্রুদের অবিলম্বে মুক্ত করতে ব্যবস্থা নিতে।”

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, তিনি ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফ-কে নির্দেশ দিয়েছেন যখন ইয়টটি ইসরায়েলে পৌঁছাবে, তখন যেন মেডলিনের কর্মীদের ৭ই অক্টোবরের “নির্মম হামলার” ভিডিও দেখানো হয়।

তখন এক্স অ্যাকাউন্টে তার পোস্টে, গ্রেটা থুনবার্গ ও মেডলিনে থাকা অন্যান্য কর্মীদের বিরুদ্ধে হামাসকে সমর্থন করার অভিযোগ আনেন এবং বলেন, তাদের জন্য “উপযুক্ত” হবে এ ভিডিও দেখা, যাতে তারা বুঝতে পারে হামাস নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের ওপর কী ধরনের নৃশংসতা চালিয়েছে– তাদের বিরুদ্ধে নয়, বরং তাদের রক্ষা করতে ইসরায়েল যুদ্ধ করছে”।

২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর, হামাস – যাকে যুক্তরাজ্যে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তারা ইসরায়েলে হামলা চালায়, যেখানে প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হন এবং আড়াইশ’র বেশি মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যায়।

হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরায়েলের পাল্টা সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।

ফ্রিডম ফ্লোটিয়া কোয়ালিশন নিজেদের “মানুষের জন্য তৃণমূল সংহতি আন্দোলন” হিসেবে পরিচয় দেয়, তারা “গাজার ওপর ইসরায়েলের অবৈধ অবরোধ শেষ করতে” কাজ করছে বলে দাবি করে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন