ঘুষ বাণিজ্যে অযোগ্য ও মেধাহীনদের নিয়োগে খাগড়াছড়ির প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙ্গে পড়েছে


খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে প্রাথমিক শিক্ষায় মেধার চরম অবনতি ঘটেছে। সরকার দলীয় নেতাদের কোটা ও ঘুষের মাধ্যমে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিটি শিক্ষক নিয়োগে ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়া হয়েছে। জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পরবর্তী চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ও মংসুইপ্রু চৌধুরীর আমলে এ ঘুষ বাণিজ্য চরম আকার ধারণ করে।
এ বাণিজ্যে নিয়োগকর্তারা আঙুল ফুলে কলাবাগান বনে গেছেন। তবে অনেকে সয়-সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা দিয়েও চাকুরি না পেয়ে নি:স্ব হয়েছেন। আবার মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে টাকার বিনিময়ে চাকুরি জুটলেও নিয়োগ জটিলতায় পড়ে বেতন ছাড়া বছরের পর বছর চাকুরি করতে গিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন অনেক শিক্ষক।
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা চেয়ারম্যান থাকাকালীন প্রতিজন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিল। পরে তিনি এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে তার মনোনীত চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী ও মংসুইপ্রু চৌধুরীর আমলে বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত।
শুধু শিক্ষক নয়, জেলা পরিষদের হস্তান্তরিত কৃষি, স্বাস্থ্য বিভাগ, যুব উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেও শত শত নিয়োগ হয়েছে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে।
অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খাগড়াছড়িতে ৬ দফায় প্রায় ১২ শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। তার মধ্যে অধিকাংশই নিয়োগ পেয়েছেন টাকার বিনিময়ে। নেতাদের কোটায় মেধাহীন দলীয় নেতাকর্মীরা। তবে টাকা দিতে হয়েছে সব চাকুরি প্রত্যাশীদের অধিকাংশ নেতাকর্মীকেও। নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় ফেল করেছেন এমন ব্যক্তিও চাকুরি পেয়েছেন টাকার বিনিময়ে।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম বন্ধের দাবিতে সে সময় মিছিল ও প্রতিবাদ হলেও কোন প্রতিকার পায়নি। অনেকে আবার প্রলোভনে পড়ে সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা দিলেও চাকুরি পায়নি।
জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবে স্থানীয় প্রতিমন্ত্রী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা পালিয়ে যাওয়ার পর নি:স্ব ভুক্তভোগীরা এখন মুখ খুলতে শুরু করেছে।
কমল বিকাশ ত্রিপুরার অভিযোগ, তার স্ত্রী লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর জেলা পরিষদের সে সময়কার চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী নিজে ফোন করেন। বলেন, চাকুরি পেতে হলে ২০ লাখ টাকা দিতে হবে।
কমল বিকাশ ত্রিপুরা স্ত্রীর চাকুরির জন্য জমি বন্ধক দিয়ে ১০ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন।প্রথম দফায় ১০ লাখ টাকা দেন। চাকুরি হলে অবশিষ্ট টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চাকুরি হয়নি। অনেক দেনদরবার করেও টাকা ফেরত পায়নি।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে শিক্ষক নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে খোদ পলাতক সাবেক পার্বত্য মন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার অডিও তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। প্রায় তিন মিনিটের এ অডিও-তে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ঘুষ বাণিজ্যের মধ্যস্থাকারীকে বলেন, চাকুরি পেতে হলে জনপ্রতি শিক্ষককে ২০ লাখ টাকা করে দিতে। সে সাথে আগে কৃষি বিভাগের নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তির কাছ বকেয়া টাকাও আদায় করে দিতে মধ্যস্থাকারীকে বলা হয়। তবে ঐ মধ্যস্থতাকারীর পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি।
এনসিটিবি লেখক প্যানেলের ককবরকের টিম লিডার ও লেখক-গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, বিগত দিনে খাগড়াছড়িতে অস্বচ্ছতার মাধ্যমে মেধাহীনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে খাগড়াছড়ির প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। তিনি খাগড়াছড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে জেলা পরিষদকে দায়িত্বশীল হওয়ার অনুরোধ জানান।
সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে এক মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদ টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যতটুকু এসেছে ও দিচ্ছে প্রচুর তহবিল তসরূপ করা হয়েছে। এখানে উন্নয়নের টাকা সঠিক ভাবে খরচ হয়নি। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। কারো বিশেষ একটা সুবিধা নিয়ে অন্যায় করবে, নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি করবে। টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগ করবেন, অথচ সে শিক্ষক স্কুলে পড়াতে পারে না। এভাবে চলতে পানে না।
তিনি নির্বাচনের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদকে জনপ্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উপর জোর দেন।
এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের পড়ন্ত বেলায় খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে আরো ৩শ৩৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার মধ্যে ঘুষ বাণিজ্যের নিয়ম বহি:ভূত নিয়োগ দেওয়ায় শতাধিক সহকারী শিক্ষক দেড় বছর ধরে বেতন না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন পার করছে।
এ বিষয়ে আব্দুল মুনাফ নামে এক ভুক্তভোগীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিডিয়ার সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সময় হলে বলবো। একইভাবে ভুক্তভোগী খাগড়াছড়ি সদরের নুনছড়ি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী উনুচিং চৌধুরী ও দীঘিনালার রামরতন কার্বারী পাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শিপু ত্রিপুরার সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, কথা বলতে উপরের নিষেধ আছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো: শফিকুল ইসলাম বলেন, নিয়োগ কর্তাদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে শতাধিক নিরপরাধ শিক্ষক। ঘটনা খুবই মানবিক। চাকুরি করছেন অথচ বেতন পাচ্ছেন না।ভুক্তভোগীরা প্রায় তার কাছে এসে মানবেতর জীবন-যাপনের কথা জানান। তিনি অবশ্যই বিচার হওয়া দরকার মনে করেন।
প্রাথমিক শিক্ষার প্রথম স্তর। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মেধাকে প্রাধান্য দিয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে ও আরো দায়িত্বশীল হবে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদ এমনি প্রত্যাশা সচেতন মহলের।